সফল নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ বারবার আসে না

আরও একটা বছর শেষ হতে চলেছে। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে শুরু হয়ে গেছে দিনগণনা, অথবা বলা যায় ক্ষণগণনা। আর মাত্র দু-তিনটি দিন বাকি। প্রশান্ত মহাসাগরীয় কোনো একটি দ্বীপে নতুন বছরের সূর্য প্রথম দেখা যাবে এবং দুনিয়াজুড়ে উৎসবের মাতামাতি শুরু হবে আগের মাঝরাত থেকে, যখন ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছোঁবে। গণমাধ্যমে আমরা পড়ব এবং শুনব সালতামামি—কেমন কাটল বছরটা। অর্জন, স্খলন, প্রাপ্তি আর বিসর্জনের ব্যালান্সশিট নিয়ে কাটাছেঁড়া চলবে কয়েক দিন।

সাপ্তাহিক বিচিত্রা একসময় কভারস্টোরি করত—বছরের আলোচিত চরিত্র। পশ্চিমের দেশগুলোতে গণমাধ্যমে এটা একটা নিয়মিত রেওয়াজ। আমাদের এখানেও তার চল দেখা যায় সীমিত আকারে। প্রশ্ন হলো, এ বছরের প্রধান আলোচিত বিষয় কী? এ নিয়ে থাকবে নানা মুনির নানা মত। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধানত কাজ করবে সামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি।

২০১৭ সালটা বাঙালি জীবনে কেমন কাটল, এ নিয়ে সবাই একমত হবেন, এটা ভাবা যায় না। মুদ্রাস্ফীতি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল, পদ্মা সেতু—এমনতর বিষয়গুলো হয়তো ঘুরেফিরে আসবে। ব্যাংক লোপাটও বাদ যাবে না। কিংবা মওদুদ আহমদের ‘বাড়ি বেদখল’ কিংবা বেসিক ব্যাংকও আলোচনার শীর্ষে চলে আসতে পারে। সম্প্রতি ফারমার্স ব্যাংকের চাষি মালিকদের অবস্থা-দুরবস্থা নিয়েও কথা কম হয়নি। সুতরাং, বিষয়ের কিংবা ইস্যুর ঘাটতি নেই।

সমাজে নানাজনের কাজের ক্ষেত্র ও আগ্রহ ভিন্ন। পরিবেশবাদীদের কাছে রামপাল-রূপপুর একটি বড় ইস্যু। যাঁরা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন, গুম-খুন তাঁদের বিষয়ের তালিকার শীর্ষে থাকবে, এতে সন্দেহ নেই। যাঁদের সন্তান স্কুলে পড়ে, তাঁদের কাছে প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণির প্রশ্নপত্র ফাঁসের কেলেঙ্কারি অনেক দিন আতঙ্কের ফাঁস হয়ে গলায় ঝুলবে।

সবার ওপরে একটি বিষয়ে নাগরিকদের আগ্রহ থাকবে। আর তা হলো ‘রাজনীতি’। বাঙালি রাজনৈতিক প্রাণী। পেটে ভাত বা পকেটে কড়ি না থাকলেও চলে। কিন্তু রাজনীতি ছাড়া বাঙালি জীবন অচল। তবে ইদানীং একটা বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে, যত্রতত্র, চায়ের দোকানে বা বাসে-ট্রেনে লোকজন রাজনীতি নিয়ে খুব সাবধানে কথা বলেন। মানুষের চোখেমুখে একধরনের অস্বস্তি বা ভীতি দেখা যায়। কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলেন, এ নিয়ে অনেকেই তটস্থ। ৫৭ ধারার খড়্গ দিয়ে অনেক কিছুই ঠান্ডা করা গেছে।

বাঙালি স্বপ্নবাজ জাতি। আমরা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। একসময় আমরা স্বপ্ন দেখলাম, মুসলমানের আলাদা দেশ হলে আমরা ভালো থাকব, সুখে থাকব। আমরা ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ হুংকার দিয়ে ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্র তৈরি করলাম। কিন্তু মোহভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। ভাষার প্রশ্নে আমরা উপলব্ধি করলাম, আমরা ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়েছি।

পঞ্চাশ আর ষাটের দশকজুড়ে আমরা স্বপ্ন দেখেছি একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাওয়ার। সে জন্য লড়াই-সংগ্রাম হয়েছে। অগুনতি মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে একটি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা নতুন এক দেশ পেলাম—বাংলাদেশ। কিন্তু শুরুতেই আমরা হোঁচট খেলাম। গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হলো। বৈষম্য বাড়তেই লাগল। স্বপ্ন থেকে গেল অধরা।

কয়েক বছর বিরতি দিয়ে দিয়ে আমাদের দেশে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই হয়। আগে আমরা একসঙ্গে অনেক কিছু চাইতাম। গণতন্ত্রের সঙ্গে সমাজতন্ত্রও চাইতাম। এখন ‘সমাজতন্ত্র’ মোটামুটি বাদ গেছে। এটা কেবল মধ্যবিত্ত বামের বক্তৃতায় আর লেখালেখিতেই আছে। আমরা জানি, সমাজতন্ত্রের যে ধ্রুপদি ধারণা নিয়ে একসময় গলা ফাটিয়েছিলাম, তার ভিত্তিটা এখন ধসে গেছে। দুনিয়া অনেক বদলে গেছে। বদলে গেছে পুঁজিবাদও। যাঁরা নিয়মিত ধর্ম-কর্ম করেন না, তাঁদের অনেকেই অভ্যাস কিংবা সামাজিকতার কারণে ঈদে কিংবা জুমার দিনে বগলে একটা জায়নামাজ নিয়ে মসজিদমুখী হন। সমাজতন্ত্র নিয়ে বলাবলি এখন এ ধরনের একটা রিচ্যুয়ালে গিয়ে ঠেকেছে। ‘গণতন্ত্রই’ এখন আমাদের ধ্যান-জ্ঞান।

তবে গণতন্ত্রের চেহারাটা সবাই একরকম দেখেন না। এ যেন অন্ধের হাতি দেখার মতো। কারও কাছে গণতন্ত্র হলো পাঁচ বছর পরপর ভোটের লাইনে দাঁড়ানো এবং একটা মার্কায় সিল মারা। তাঁদের কাছে গণতন্ত্রের মাজেজা হলো অবাধে পছন্দের প্রার্থীর মার্কায় সিল মারার স্বাধীনতা। ভোটপ্রার্থীর কাছে গণতন্ত্র হলো অবাধে তাঁর মতো প্রচার করার স্বাধীনতা। তিনিই যোগ্যতম প্রার্থী এবং প্রতিদ্বন্দ্বী সবাই খারাপ, এটা বলার স্বাধীনতা। এ নিয়ে নির্বাচনের সময় রীতিমতো মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। হাজার হাজার টন লিফলেট-পোস্টারে দেশ যায় ছেয়ে। মাইক্রোফোনের শব্দে কয়েক সপ্তাহ কেউ ঘুমোতে পারেন না। এ রকম একটি মৌসুম খুবই নজদিক।

এ দেশে ১৯৭৫ সালে একটা বড় ওলট-পালট হয়ে গেছে। আমরা দীর্ঘদিন প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে উর্দি শাসন দেখেছি। তারপর আমরা গণতন্ত্রের জন্য কতই-না সংগ্রাম করলাম। ১৯৯০ ও ১৯৯৬ থেকে শুরু হয়ে আজ অবধি আমরা বলেই যাচ্ছি, গণতন্ত্র নাই—গণতন্ত্র চাই।

এ দেশে একটা সমস্যা হলো, ভোট পেয়ে গেলে জনপ্রতিনিধিকে আর হাতের নাগালে পাওয়া যায় না। জাতীয় সংসদ সার্বভৌম। সাংসদেরা যা খুশি তা-ই করতে পারেন—এমন একটা ধারণা জনমনে ক্রমেই গেঁড়ে বসেছে। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় আমরা জেনেছি, ব্রিটিশ গণতন্ত্রে হাউস অব কমন্সের অসীম ক্ষমতা। তারা কেবল নারীকে পুরুষ আর পুরুষকে নারী বানাতে পারে না। আমাদের এখানে অবস্থা প্রায় সে রকমই।

তবে ব্রিটিশ গণতন্ত্রের অনেক কিছুই আমরা গ্রহণ করিনি। যেমন ও দেশে নির্বাচনে হেরে গেলে সব দায়দায়িত্ব নিয়ে পরাজিত দলের নেতা পদত্যাগ করেন। এ জন্য ঠেলাঠেলি বা আন্দোলন করতে হয় না। নতুন নেতৃত্ব এসে দলকে নতুন করে সাজান। আমাদের দেশে পরাজিত দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন হওয়া তো দূরের কথা, কেউ পরাজয় স্বীকারই করেন না। বলেন, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে—সূক্ষ্ম কিংবা স্থূল কারচুপি, পুকুর কিংবা সাগরচুরি।

২০১৭ সালজুড়ে ‘গণতন্ত্র’ বিষয়টি জন-আলোচনায় এবং গণমাধ্যমে এসেছে নিয়মিতভাবে। সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়ন নিয়েও কথাবার্তা হয়েছে বিস্তর। গণতন্ত্র না উন্নয়ন—এ রকম একটি বিতর্কও লক্ষ করা গেছে। এর মাধ্যমে একটা ধারণা গেলানোর চেষ্টা চলেছে যে অবাধ গণতন্ত্র আর উন্নয়ন যদি একসঙ্গে পথ চলতে না পারে, তাহলে উন্নয়নের স্বার্থে গণতন্ত্রকে খোজা করে দিলে দোষ কী।

দেশে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর দাবি, তাদের সময় এ দেশে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত রাখতে হলে রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরি। সে জন্য তাদের আরও এক কিংবা দুই টার্ম ক্ষমতায় থাকা দরকার। তা না হলে সব অর্জন ভেসে যাবে। বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর দাবি, ক্ষমতাসীনেরা গণতন্ত্রকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে, উন্নয়নের নামে চলছে লুটপাট। সুতরাং, এই গোষ্ঠীকে উৎখাত করতে হবে। তাহলে সুদিন আসবে।

দুই গোষ্ঠীর তূণে অনেক তির আছে, আছে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য অনেক যুক্তি। রাজনৈতিক দলগুলো অনেকটাই ফেরিওয়ালার মতো। তারা নিজ নিজ পণ্যের গুণগান করে। সব রোগের অব্যর্থ মহৌষধ আছে তাদের ঝুলিতে, যা অন্যের বোঁচকায় নেই। এগুলো দেখতে দেখতে আমাদের চোখে ছানি পড়ে গেছে, কান পচে গেছে। শিগগির এ থেকে মুক্তির সম্ভাবনা নেই।

গণতন্ত্র, সুশাসন ও উন্নয়ন—এর সব কটিই দরকার। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যগুলো থাকলে হবে না। এই তিনের মধ্যে সমন্বয় করে জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ এখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামনে। এটাও মনে রাখতে হবে যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কার্যকর বিকল্প নেই।

আমরা এখন চাতক পাখির মতো নেতৃত্বের দিকে তাকিয়ে আছি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমরা বারবার প্রতারিত হয়েছি, আমাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। সফল নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ বারবার আসে না।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
[email protected]