রাজনীতি অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না কেন?

>

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিকাশমান মধ্যবিত্তের ভূমিকা কী, গণতন্ত্রের সংকট এবং সমাজে ধর্মের প্রভাব বিষয়ে তারা কী ভূমিকা পালন করছে, ভবিষ্যতে তাদের ভূমিকা কী হতে পারে? সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিষয়ক ত্রৈমাসিক জার্নাল প্রতিচিন্তা-এর জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৭ সংখ্যায় এ বিষয়ে প্রকাশিত আলী রীয়াজের গবেষণা-নিবন্ধের সারসংক্ষেপ তিন পর্বে প্রকাশিত হবে। আজ প্রথম পর্ব।

বাংলাদেশের রাজনীতি যাঁরা ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেন এবং গত কয়েক বছরের ঘটনাবলির দিকে যাঁরা নজর রেখেছেন, তাঁদের কাছে এটা স্পষ্ট যে দেশে দুটি বড় ধরনের পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে। একটি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকট, অন্যটি রাজনীতি ও সমাজে ধর্মের ব্যাপক প্রভাব। এই দুই প্রবণতার প্রেক্ষাপট হচ্ছে প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। এই প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ১৯৯০ সালের পরে, যখন সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশে একধরনের অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যাকে আমরা গণতান্ত্রিক শাসন বলে চিহ্নিত করি, তার সূচনা হয়। এই রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আড়াই দশক পরে এখন সমাজ ও রাজনীতিতে যে দুই প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি, সেগুলো কি পরস্পর-সম্পর্কিত? সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্বের আলোকে এবং অন্যান্য দেশের এত দিনের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। এটাও বোঝা দরকার যে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির এসব পরিবর্তন সাময়িক না দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী।

উনিশ শতকে পশ্চিমা বিশ্বে ‘সেক্যুলারিজমের’ যে ধারণা বিস্তার লাভ করে, তার আলোকে বলা হয় যে উনিশ ও বিশ শতকে সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সমাজে ধর্মের প্রভাব হ্রাস পাবে। সমাজের অগ্রগতির লক্ষণ হিসেবে ‘আধুনিকায়ন’ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল; ‘আধুনিকায়ন’ ধীরে ধীরে ধর্মকে জনপরিসর থেকে বিদায় করবে, এটাই ছিল মূল যুক্তি। আধুনিকায়ন অবশ্যই কেবল অর্থনীতির বিষয় নয়, এর সঙ্গে যুক্ত সমাজের মূল্যবোধের প্রশ্ন। কিন্তু আধুনিকায়নের যে সীমাবদ্ধ ধারণা সেক্যুলারিজমের বিস্তারের কারণ হিসেবে সবচেয়ে বেশি এবং ক্ষেত্রবিশেষে একচ্ছত্র বলে প্রচারিত হয়েছিল, তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। বিশ শতকের শেষভাগে এসে আমরা দেখতে পেলাম, সমাজ থেকে ধর্মের অবসান তো ঘটেইনি, বরং তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। ধর্মের প্রভাব বেড়েছে, রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে এর আবির্ভাব ঘটেছে। সমাজ ও রাজনীতিতে ধর্মের উত্থান, বিশেষত ‘উন্নয়নশীল’ দেশগুলোতে এই উত্থানের পেছনে রাষ্ট্রের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। এটি কেবল সেসব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, যেখানে রাষ্ট্র নিজেই ধর্মকে সামনে নিয়ে এসেছে; সেখানেও প্রযোজ্য, যেখানে রাষ্ট্র ধর্মকে ব্যক্তিগত পরিসরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

১৯৬০-এর দশকে এই ধারণার ব্যাপক প্রচার শুরু হয় যে গণতন্ত্রের সঙ্গে অর্থনীতির বিভিন্ন ধরনের যোগসূত্র আছে, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশের সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক গভীর। যোগসূত্রগুলোর বিভিন্ন দিকের সারসংক্ষেপ এই রকম: গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অবস্থার দরকার হয় না, অর্থাৎ কেবল ধনী দেশেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে, তা নয়। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন গণতন্ত্রের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে, এই সম্ভাবনার পেছনের কারণ শিক্ষার প্রসার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ এবং নাগরিকের আয়ের বৃদ্ধি ঘটলে কর্তৃত্ববাদী দেশ ক্রমেই গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। এও বলা হয় যে ‘বুর্জোয়ারা না থাকলে গণতন্ত্র হবে না’। যেভাবেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন, (অর্থনৈতিকভাবে) উন্নত দেশে গণতন্ত্র টিকে থাকে।

গণতন্ত্রের পক্ষে মধ্যবিত্তের এই ভূমিকা কেন, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাধারণত যে প্রধান কারণের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে বৈষয়িক লাভ। মধ্যবিত্ত যেহেতু সম্পদের মালিকানা ভোগ করে, সেহেতু তারা চায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক, যেন খামখেয়ালি ব্যবস্থার শিকার হয়ে তাদের কিছু হারাতে না হয়। এই তত্ত্বের প্রমাণ হিসেবে গোড়াতে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষত ইউরোপের উদাহরণ দেওয়া হতো। কিন্তু আশি-নব্বইয়ের দশকে অর্থনৈতিকভাবে সফল বেশ কিছু দেশে আন্দোলনের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানকে এভাবে ব্যাখ্যা করা হয় যে সেসব দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ এবং তাদের চাপের মুখেই গণতন্ত্রায়ণের পথ প্রশস্ত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ১৯৮৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাফল্য উল্লেখ করা হয়। স্যামুয়েল হান্টিংটন গণতন্ত্রের তৃতীয় ঢেউ বা থার্ড ওয়েভ অব ডেমোক্রেসির যেসব কারণ হাজির করেন, তার একটি হচ্ছে নগরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্তের বিকাশ। এসব আলোচনায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এই ধারণাই দেওয়া হয় যে কোনো দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যদি একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি করে, তবে সেখানে গণতন্ত্রায়ণ ঘটে বা তার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, প্রচলিত (কিন্তু একেবারে সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়) তত্ত্বগুলো বলছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ হলে গণতন্ত্র ও ‘সেক্যুলারিজমের’ একটি রূপ প্রতিষ্ঠিত হয় বা তার সম্ভাবনা বাড়ে।

বাংলাদেশের গত কয়েক দশকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে প্রচলিত হিসাব আমরা দেখি, তাতে আমরা দেখতে পাই যে সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। তার একটা উদাহরণ কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি অ্যাকাউন্টধারী ছিলেন মাত্র পাঁচজন। ২০১৬ সালে তা দাঁড়ায় ১ লাখ ১৯ হাজারের বেশি। বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক পরিমাণে সম্পদ পাচার হচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) হিসাব অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার বা ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৪ সালেই পাচার হয়েছে প্রায় ৯১১ কোটি ডলার বা প্রায় ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা।

বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু এই হ্রাসের হার এখন কমতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে (এইচআইইএস ২০১৬), ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের তুলনায় সর্বশেষ ছয় বছরে (২০১১-১৬) বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্য হ্রাসের গতি কমেছে। আমরা দেখছি সমাজে বৈষম্য বাড়ছে। এই বৈষম্য পরিমাপের একটি পদ্ধতি জিনি সূচক, যেখানে শূন্য হচ্ছে বৈষম্যহীনতা আর এক হচ্ছে সর্বোচ্চ বৈষম্য। জিনি সূচকে দেখা যাচ্ছে, জাতীয়ভাবে ২০০৫ সালে বৈষম্য ছিল দশমিক ৪৬৭। ২০১৬ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৪৮৩। গত কয়েক বছরে নগর এলাকায় এই বৈষম্য বেড়েছে গ্রামের তুলনায় বেশি। তবে গ্রামাঞ্চলে ২০০৫ সালের চেয়ে ২০১৬ সালে উল্লেখযোগ্য অবনতি হয়েছে। জাতীয় আয়ে দরিদ্র এক-পঞ্চমাংশ মানুষের ভাগও কমেছে। ১৯৯১ সালে দরিদ্র ২০ শতাংশের ভাগ ছিল ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ, ২০১০ সালে ৫ দশমিক ২২ শতাংশ। একেবারে দরিদ্র ৫ শতাংশের ভাগ ২০১০ সালে ছিল দশমিক ৭৮ শতাংশ, এখন তা হচ্ছে দশমিক ২৩ শতাংশ। এর বিপরীতে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশের হাতে জাতীয় আয় ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যে কেবল একধরনের বৈষম্যই তৈরি করছে তা নয়, গত কয়েক বছরে এই প্রবৃদ্ধি দেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে খুব আশাব্যঞ্জক সাফল্য দেখাতে পারেনি। দেশে তরুণদের, বিশেষত শিক্ষিত তরুণদের এক বড় অংশ বেকার জীবনযাপন করছে এবং তাদের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ দুই বছরে মাত্র ৬ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, অথচ এই সময়ে দেশের কর্মবাজারে প্রবেশ করেছে প্রায় ২৭ লাখ মানুষ। অর্থাৎ মাত্র দুই বছরে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে ৪৮ লাখ। অথচ ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর চাকরি বা কাজ পেয়েছে ১৩ লাখ ৮০ হাজার মানুষ।

অর্থনীতির এসব প্রবণতার মধ্যেই বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকার বেড়েছে। বোস্টন পরামর্শক গ্রুপ, যার কাজ হচ্ছে বিভিন্ন দেশে ভোক্তা ও বাজারের সম্ভাবনা বিচার করা এবং বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দেওয়া, ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে যে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৭ শতাংশ বা ১ কোটি ২০ লাখ হচ্ছে ‘মধ্য ও বিত্তশালী ভোক্তা’ (‘মিডল অ্যান্ড অ্যাফলুয়েন্ট কনজিউমার’) ; এই ভোক্তা শ্রেণির বার্ষিক বৃদ্ধির হার ১১-১২ শতাংশ; ফলে ২০২০ সালে তা দাঁড়াবে মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ, অর্থাৎ ১ কোটি ৯৩ লাখে; ২০২৫ সালে ৩ কোটি ৪০ লাখে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গবেষক বিনায়ক সেনের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশকে মধ্যবিত্ত বলে বিবেচনা করা যায়, যা ২০২৫ সালে দাঁড়াবে ২৫ শতাংশে (ডেইলি স্টার, ৬ নভেম্বর ২০১৫)। তিনি বলেছেন, এক দশক আগে মধ্যবিত্ত ছিল ৯ শতাংশ, ২০৩০ সালে দাঁড়াবে ৩৩ শতাংশে (ঢাকা ট্রিবিউন, ৬ নভেম্বর ২০১৫)।

তত্ত্বগতভাবে বিবেচনা করলে এবং অন্যান্য দেশের অতীত অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিলে এই বিকাশমান মধ্যবিত্তের ভূমিকা অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক পদ্ধতি ও উদার সামাজিক ব্যবস্থার পক্ষেই থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকট এবং সমাজে ধর্মের প্রসার সে ইঙ্গিত দেয় না। কিন্তু কেন? সেই প্রশ্নের উত্তরের জন্য বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করা দরকার।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।