মানবাধিকার অবহেলিত

গত চার বছরে সরকার পরিচালনার বিভিন্ন দিক নিয়ে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে বিশ্লেষণ। আজকের বিষয় মানবাধিকার
সুলতানা কামাল
সুলতানা কামাল

মানবাধিকার বিষয়টি নিশ্চয়ই আমরা সবাই জানি, বুঝি। রাস্তাঘাট, সেতু, আকাশছোঁয়া ইমারত, ঝলমলে দোকানপাট, অত্যন্ত উচ্চমূল্যের ব্যক্তিমালিকানাধীন বাহন অথবা আর্থসামাজিক সূচকে উন্নয়নের মাপকাঠিতে বেশ ওপরের দিকে স্থান পাওয়া—উন্নতির এসব মাপকাঠিতে মানবাধিকারের বিচার করা যায় না। কারণ, মানবাধিকার প্রকৃতপক্ষে একটি বোধের নাম, যে বোধ মানুষকে মানুষ হয়ে উঠতে শিক্ষা দেয় এবং অপরের মনুষ্য পরিচয়কে স্বীকৃতি দিয়ে সম্মান করার দীক্ষায় দীক্ষিত করে।
মানবাধিকার একটি সমাজে কতটা বিরাজ করছে, তার মাপকাঠি সমাজের একজন মানুষ নিজের জীবনটা কতটা নিশ্চিন্তে যাপন করতে পারছেন। তাঁর আর্থসামাজিক অবস্থান, ধর্ম, বর্ণ, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, লৈঙ্গিক পরিচয় কিংবা বয়স তাঁর আত্মপরিচয়কে ছাপিয়ে যাবে না—এই আশ্বাসে তাঁকে আশ্বস্ত থাকতে হবে। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তাঁর জীবনটা তিনি সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে কোনো রকম হেনস্তা বা হয়রানির শিকার না হয়ে মোটামুটি শান্তিতে যাপন করে যেতে পারবেন। কোনো বিশেষ পরিচয়ের কারণে তাঁকে নিগৃহীত বা অপমানিত হতে হবে না। বা কোনো অজুহাতে দখল করে নেওয়া হবে না তাঁর সহায়-সম্পদ, তাঁকে হতে হবে না বাস্তুহারা, নিতে হবে না দেশত্যাগের মতো চরম সিদ্ধান্ত। মানবাধিকার বলে, মানুষ মানুষ হয়ে জন্মেছে বলেই কিছু অধিকার তার সহজাত। এসব অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না, সে কোনো ব্যক্তিই হোক, কি রাষ্ট্র, কি সমাজ।

আজ অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলতেই হয়, বাংলাদেশ নানা ক্ষেত্রে উন্নয়নের স্বাক্ষর রেখে থাকলেও মানবাধিকারের বিষয়ে যে অবহেলা, উদাসীনতা ও অনগ্রসরতার উদাহরণ রেখেছে, তা খুব কম করে বললেও বলতে হয়, অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

উদ্বেগটা অনেক বেশি গভীর আকার ধারণ করে এ কারণে যে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো কেমন করে যেন সমাজে একটা গ্রহণযোগ্যতা আদায় করে নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বোধ হয় সবচেয়ে আলোচিত বিষয় নারী নির্যাতন। বাংলাদেশে নারীদের এত উন্নতি সত্ত্বেও নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যানে শঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্র কি শিক্ষালয়—সর্বত্র নারী নানা ধরনের অত্যাচার, নির্যাতন আর হয়রানির শিকার হচ্ছে। ১০০ জনের মধ্যে ৮৭ জন নারী কোনো না কোনোভাবে পরিবারের মধ্যেই নির্যাতিত হন। একটি মানবাধিকার সংস্থার হিসাবে শুধু ২০১৭ সালেই ধর্ষণ করা হয়েছে প্রায় ৮০০ জন নারীকে, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৯০ জনেরও বেশি নারীর ওপর। ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, যেটা সরকারেরই একটি সংস্থা, সেটির হিসাব আরও ভয়াবহ: এই এক বছরে শারীরিকভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছেন (যার মধ্যে ধর্ষণের মতো অপরাধও আছে), এমন নারীর সংখ্যা দুই হাজারেরও অধিক। নারী নির্যাতনের ধরন যে বীভৎসতার পরিচয় দিচ্ছে, তা নিয়ে বিস্তারিত বিবরণে নাই-বা গেলাম। একই সঙ্গে আমরা খবর পাচ্ছি নারী নির্যাতনের অপরাধে শাস্তির আওতায় এসেছে হাজারে দুজনেরও কম ব্যক্তি।
এখানেই মানবাধিকারের প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। একটি সমাজে নানা ধরনের অপরাধ ঘটতেই পারে। কিন্তু সেই অপরাধের প্রতিকার দেওয়াতে, অপরাধ থেকে নাগরিকদের সুরক্ষা প্রদানে এবং অপরাধীকে জবাবদিহির সামনে দাঁড় করানোতে রাষ্ট্র কী ভূমিকা রাখছে, সেটাই এখানে বিবেচ্য। নারী নির্যাতনের এক বছরের পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়, রাষ্ট্রের ব্যর্থতা এখানে কত প্রকট!
আর ধর্ম, বর্ণ, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হিসেবে যাদের পরিচয় ভিন্ন, এ ধরনের ঘটনা যখন তাদের ওপর ঘটে, তারা যে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশাটুকুও করে না, সে কথা বারবার করে উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু ফল লাভ যে হয়নি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সরকারের চার বছরের সালতামামির সময় রিশা, তনু, রূপা—এদের সঙ্গে আরও অসংখ্য মুখ ভেসে ওঠে। সেই মুখগুলোকে কি তাড়িয়ে দিতে পারি আমরা? রাজন, রাকিব, সাগর—আমাদের চোখের সামনে এদের প্রকাশ্য দিবালোকে দুর্বৃত্তরা নির্মমভাবে দীর্ঘ সময় ধরে অত্যাচার করে মেরে ফেলল, তার বিচারের শেষ এখনো দেখা হলো না আমাদের। শিশু নির্যাতন, হত্যা আর সহিংসতা মিলে দেড় হাজারেরও বেশিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র এক বছরে।
যে মানুষগুলো হারিয়ে গেলেন বা যাচ্ছেন, তাঁদের অধিকাংশেরই কোনো হদিস করতে পারছি না আমরা। কেন তাঁরা হারিয়ে যাচ্ছেন (বা অনেকের মত অনুযায়ী, ‘আত্মগোপন’ করছেন), বা যাঁরা ফিরে আসছেন, তাঁরা কেন কোনো কথা বলছেন না—এ বিষয়গুলো মানুষকে গভীর শঙ্কার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যাঁরা ফিরে এলেন, তাঁরা কি তাঁদের ওপর যাঁরা এই অমানবিক ঘটনা ঘটাল, তাদের শাস্তি চান না? না চাওয়ার পেছনের কারণটা কী? আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভীতি? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কেন তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না তথ্য উদ্ধারের? নাকি এর অন্যতম কারণ এই যে, অভিযোগের আঙুলটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের দিকেই তোলা? এ রহস্য রয়েই গেল।
বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়েছে বলে রাষ্ট্র দাবি করলেও প্রতিদিনই ‘বন্দুকযুদ্ধে’র নামে মানুষ নিহত হচ্ছে এক-দুজন করে। এ বছরই এই ঘটনা ঘটেছে কম করে হলেও ১৫১টি। মানবাধিকারের দৃষ্টিতে এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
‘আদিবাসী’ সম্প্রদায় (বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী—যা-ই বলি না কেন) এখনো তাদের পরিচয়ের স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষমাণ। সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক একটি ভূমি কমিশনের দাবিটিও এখনো পর্যন্ত উপেক্ষিতই থেকে গেল। গোবিন্দগঞ্জের মানুষগুলো রাত কাটাচ্ছে মাঠের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর পূর্তি হলো, চুক্তির বাস্তবায়ন থেমে থাকল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ধারাগুলোকে পাশ কাটিয়ে।
মাত্র এক বছরে হাজারের ওপর হিন্দু দেশ ছেড়ে চলে গেছে। একটি হিসাবে ২৩৫টি মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে। নাসিরনগর, গঙ্গাচড়া, তারও আগে দিনাজপুর, হোমনা, কুমিল্লা—কোনো ঘটনার বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি। অথচ রামুর উত্তম বড়ুয়ার মতো অন্যান্য ঘটনা যাঁদের ওপর মিথ্যা দোষারোপ করে ঘটানো হয়েছিল, তাঁরা হয় কারাগারে, নয়তো মামলা মাথায় করে জামিনে কোনো রকমে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁদের লাখ লাখ একর জমি দখল হয়ে যাচ্ছে, প্রত্যর্পণের আইনকে অকার্যকর করার সকল কৌশল কাজে লাগিয়ে তা দখলকারীদের ভোগেই রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হচ্ছে। হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভাষায়: ‘পূজামণ্ডপ বাড়ছে, কিন্তু পূজারি কমছে।’ এ কথা যেন কেউ অনুধাবন করছেন না।
এখন তো আমরা আর ঔপনিবেশিক শক্তির অধীন নই। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া গর্বিত এক জাতি। আজ যারা এ দেশে মানুষের অধিকার হরণ করছে, তারা তো এ দেশেরই সন্তান, আজ ‘আপন সন্তানই করিছে অপমান’। আমরা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যেভাবে দুহাত বাড়িয়ে টেনে নিয়েছি, বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছি মানবতাবোধের পরিচয় রাখার জন্য, সেই দেশ থেকে এ দেশেরই মানুষ প্রতিনিয়ত চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন নিরাপত্তার অভাবে। এই অসংগতি দূর করতে না পারলে মানবতার প্রশংসা টিকাতে পারব কি?
এ প্রসঙ্গগুলো অনেক বেশি করে আলোচনায় আসে, কারণ আজ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে শুধু নয়, বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। গণতন্ত্র, প্রগতিশীলতার সঙ্গে মানবাধিকারের, সুশাসনের সম্পর্ক যেমন অবিচ্ছেদ্য, সেটা তেমনি সত্য উন্নয়নের প্রশ্নেও। মানবাধিকারের বোধবর্জিত উন্নয়ন কখনো গণতন্ত্রকে অর্থবহ করে তুলতে পারে না। উন্নয়ন তো মানুষের জন্যই। মানুষ যেখানে আতঙ্কিত, অনিরাপদ, অরক্ষিত বোধ করে, সেখানে উন্নয়নও তো নিষ্ফল হয়ে যায়। সে উন্নয়ন হয়তো গুটিকয় ব্যক্তিকে সুফল এনে দিতে পারে, সবাইকে স্বস্তি দিতে পারে না।
একটা ছোট কথা বলে শেষ করি। যত জরুরি কাজই থাকুক না কেন পথে বের হলে দীর্ঘ সময় যানজটে অপেক্ষা করতে হয়। ক্লান্ত, বিরক্ত হতে হতে কখনো কখনো দেখি, দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে বিশেষ কারও পথ পরিষ্কার রাখতে। চালকের ভাষায় ‘কেউ’ যাবে বোধ হয়। আর আমরা যারা ‘কেউ না’, তারা দাঁড়িয়ে থাকবে।
এই ‘কেউ’ আর ‘কেউ না’তে বিভক্ত সমাজ তো আমরা চাইনি। মুক্তিযুদ্ধের মূল কথাই ছিল দেশটা হবে সবার—প্রকৃত অর্থে সবার সমান অধিকার, মর্যাদা আর সম্মানের দেশ। নতুন বছরে সেই প্রত্যাশা আর প্রত্যয়েই সামনে তাকিয়ে থাকি।
সুলতানা কামাল: আইনজীবী, মানবাধিকার-কর্মী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা