'থাকতে পারবে, ভোট দিতে পারবে না'

আসামে কংগ্রেসকে হটিয়ে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে প্রথম থেকেই উগ্র অসমিয়া জাতিসত্তাকে বাড়তি ইন্ধন জুগিয়ে এসেছে বিজেপি। এমনকি ক্ষমতায় আসার পর সেই ইন্ধন আরও বেড়েছে। আর এর জন্য মূল্য দিতে হচ্ছে ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের। কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অসমিয়ারাই। তারাও আজ নিজভূমে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। একক আধিপত্যের অন্ধ চাহিদা আর সংকীর্ণ সামাজিক অবস্থানই এই পরিণতির কারণ। আর এর সঙ্গে রাজনীতির পাটিগণিত যুক্ত হওয়ায় পরিণতি হয়ে উঠেছে আরও ভয়াবহ। জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ (এনআরসি) বিতর্ক তারই মাথার চাঁইটুকু মাত্র। সমস্যার গভীরতা অতলে। 

আসামে আলী (মুসলিম), কুলি (চা-শ্রমিক) ও বাঙালিদের (হিন্দু বাংলাভাষী) বেশির ভাগের মনেই কংগ্রেসের প্রতি আস্থা বহুদিনের। অসমিয়াদের বন্দুকের নল যত হিংস্র হয়েছে, ততই বেড়েছে কংগ্রেসকে আগলে ধরে বেঁচে থাকার প্রবণতা। কিন্তু কংগ্রেসও নিজেদের ভোটব্যাংক ধরে রেখে অসমিয়া জাত্যভিমানকে কাজে লাগাতে ভুল করেনি। কংগ্রেস আমলেই মাতৃভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে বরাক উপত্যকার শিলচরে ১৯৬১ সালে ১১ জন বাঙালি শহীদ হন। পরে অবশ্য নিজেদের ভুল শুধরে নিতে দেরি করেনি শতাব্দীপ্রাচীন দলটি।
আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় লাখ লাখ বাঙালি পুরুষানুক্রমে বসবাস করছে। বরাক উপত্যকায় তো বাঙালিরাই শুধু বসবাস করে। কিছু মণিপুরি আছে বটে, অসমিয়া নেই। দেশভাগের আগে বরাকের কিছু অংশ ছিল বরং সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে। ফলে এখানে অসমিয়াদের হটিয়ে বাঙালিদের অনুপ্রবেশের প্রশ্নই ওঠে না। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়ও ব্রিটিশ আমল থেকেই বাঙালিদের বসবাস। ফসল ফলাতে কিংবা বাবুগিরির সুবিধার্থেই দেশভাগের আগেই তাদের নিয়ে আসা হয়।
ভারত ভাগের পর থেকেই আসামে শুরু হয় বাঙালিবিদ্বেষ। বাঙালিরাই নাকি অসমিয়াদের ভিটেমাটি দখল করে নিচ্ছে! একদিকে শুরু হয় স্বাধীন আসামের দাবিতে উলফার সশস্ত্র সংগ্রাম। অন্যদিকে, নিখিল আসাম ছাত্র সংস্থার (আসু) নামে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে বাঙালিরা। রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী তথা আসাম গণপরিষদ নেতা প্রফুল্ল কুমার মহন্ত ছিলেন সেই আন্দোলনের নেতা। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালও একসময় আসুর ব্যানারে ‘বাঙাল খেদা’ আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বিধ্বংসী ছাত্র আন্দোলন আর উলফার সশস্ত্র সংগ্রামে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীও বাধ্য হন আসাম সমস্যার সমাধানে বাড়তি উদ্যোগ নিতে। তাঁরই উদ্যোগে ১৯৮৫ সালের ১৫ আগস্ট আসাম চুক্তি সম্পাদিত হয়। আন্দোলনরত ছাত্রদের হয়ে প্রফুল্ল ও তাঁর সঙ্গীরা চুক্তিতে সই করেন ভারত সরকারের সঙ্গে। সেই আসাম চুক্তিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর যাঁরাই আসামে এসেছেন, তাঁদের রাজ্য থেকে বের করে দেওয়া হবে। বাকিদের দেওয়া হবে নাগরিকত্ব।
এই চুক্তির পর সাময়িক শান্তি ফেরে। ভারতের কনিষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রফুল্ল কুমার মহন্ত অগপ মন্ত্রিসভা গঠন করেন। গঠিত হয় বিদেশি শনাক্তকরণের ট্রাইব্যুনাল এবং সেখানে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিয়েই থাকতে হয় আসামে। নতুবা ঠাঁই হয় ডিটেনশন ক্যাম্পে। ভোটার তালিকায় সন্দেহ হলেই নামের পাশে যোগ হয় ‘ডি’ বা ডাউটফুল। তবু এত বড় ধরনের গোলমাল তখন হয়নি। অগপের পাঁচ বছর শাসনের পর ক্ষমতায় ফেরে কংগ্রেস। ফের তাদের হারিয়ে দ্বিতীয়বার শাসনভার ফিরে পায় অগপ। কিন্তু ২০০১ থেকে টানা ১৫ বছর আসামের শাসনক্ষমতা ভোগ করে কংগ্রেস। অগপ ভেঙে চুরমার হয়। উত্থান ঘটতে থাকে বিজেপির।
২০১৬ সালে সর্বানন্দ সোনোয়ালকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে অগপকে জোটে নিয়ে আসাম দখল করে বিজেপি। ভোটের আগে থেকেই কথিত বাংলাদেশি হিন্দুদের প্রতি নরম ভাব দেখালেও মুসলিমদের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাতে শুরু করে বিজেপি। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে’ ৭১-এর বদলে ১৯৫১-কে ভিত্তি বছর ধরারও হুমকি দেয়। ফল হয় এতে। বিজেপি মুসলিমদেরও প্রচুর ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসে। মুসলিমরা অনেকেই মনে করেছিলেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে বোধ হয় বিদেশি ইস্যু চাপা পড়ে যাবে। কিন্তু সেটা হয়নি।
আসামের তখতে বসেই বিজেপি হিন্দুত্বের তাস খেলার পাশাপাশি মুসলিমদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করে। প্রথমে নিজেদের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ রেখেই সবার জন্য কিছু নতুন নিয়ম চালু করে। নিয়ম আপাতদৃষ্টিতে সবার জন্য হলেও বাস্তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হতে থাকে মুসলিমদেরই। যেমন বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ঠিক করল দুটির বেশি বাচ্চা হলে স্থানীয় স্বশাসিত পর্ষদের ভোটে দাঁড়ানো যাবে না। অর্থাৎ পঞ্চায়েত বা পুরসভার ভোটে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে অধিক সন্তানের মা-বাবারা ব্রাত্য। দেখা গেছে গ্রামাঞ্চলে গরিব মুসলমানদের ঘরেই দুইয়ের বেশি বাচ্চা রয়েছে। ভোটে দাঁড়ানোর পাশাপাশি চাকরি, প্রমোশন, শিক্ষা-সবকিছুতেই মুসলিমদের ব্রাত্য করা শুরু করে আসাম সরকার। জানা গেছে, পাসপোর্টের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনে বাড়তি সময় নেওয়া হচ্ছে মুসলিমদের ক্ষেত্রে।
শুধু বাঙালিদের বললে ভুল হবে, আসামের আদিবাসীদের একটি বড় অংশ বোড়ো সম্প্রদায়ের। রয়েছে ডিমাসা, নাগা, মণিপুরিসহ বিভিন্ন জনজাতির মানুষ। তারাও এখন আর অসমিয়া সমাজকে নিজেদের বন্ধু বলে মনে করে না। ফলে হিন্দু অসমিয়ারা নিজেরাই নিজেদের আরও বেশি করে একঘরে করে ফেলেছে। নিজেদের রাজ্যেই তারা এখন সংখ্যালঘু। বোড়োরা চাইছে আলাদা রাজ্য। একই দাবিতে নাগারাও রাজ্য ভেঙে যোগ দিতে চায় নাগাল্যান্ডে। ফলে বহু দিক থেকেই অসমিয়াদের ওপর চাপ বাড়তে থাকে।
এসবের মধ্যেই এনআরসির তালিকা প্রকাশ রাজ্যের ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। এনআরসির সূত্রপাত ১৯৫১ সালে। বিদেশি ইস্যুতে বহু আন্দোলন হলেও সাচ্চা নাগরিক বাছাইয়ের কাজ কেউই করেনি। ২০০৫ সালে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ আসাম সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে সব দলকে নিয়ে উদ্যোগী হন। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের পৌরোহিত্যে তখনই ঠিক হয় এনআরসির। এরপর পাইলট প্রজেক্ট তৈরি হয় ২০১০ সালে। কংগ্রেস এখনো দাবি করছে তারা সৎ উদ্দেশ্যে এই এনআরসি উপহার দেয় রাজ্যবাসীকে। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ এই নিবন্ধকারকে বলেন, ‘এনআরসি গঠনের কৃতিত্ব আমার সরকারের। আমরাই চেয়েছি দোষারোপ বন্ধ করে নাগরিকদের রক্ষাকবচ দিতে। এমনকি আমার আমলে ২০১৫ সালে কংগ্রেস সরকারই শুরু করে নাগরিক বাছাইয়ের কাজ। কিন্তু বর্তমান সরকার অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে এনআরসিকে। রাজ্যে একজনও বিদেশি নেই। থাকলে তো ধরা পড়ত বিজেপি সরকারের হাতে।’
সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে চলছে এনআরসির প্রক্রিয়া। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশেই ৩১ ডিসেম্বর তালিকা প্রকাশিত হয়। এ প্রসঙ্গে কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা তরুণ গগৈ বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন ঠিক আছে। কিন্তু কাজটা তো করছে রাজ্য সরকার। তারাই বাদ দিচ্ছে সংখ্যালঘুদের নাম। বলুন তো, যাঁদের ভোটে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন, তাঁদের নাগরিকত্বই যদি ভুয়া বা সন্দেহজনক হয়, তবে তো মন্ত্রিসভাকেই বাতিল করতে হয়।’
একই বক্তব্য কংগ্রেস সাংসদ সুস্মিতা দেবের। সর্বভারতীয় মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী সুস্মিতা বলেন, ‘বাঙালি-অধ্যুষিত এলাকায় নাগরিকত্বের হার সবচেয়ে কম। অসমিয়া এলাকায় সবচেয়ে বেশি। এটাই তো বুঝিয়ে দেয় এনআরসি নিয়ে বাঙালিবিদ্বেষ রাজনীতি করছে বিজেপি।’ ২ সাংসদ, ৬ বিধায়ক ছাড়াও বহু বিধায়কের নাম নেই প্রথম তালিকায়। নাম নেই সাবেক মন্ত্রীদেরও। কিন্তু প্রতিবাদ হচ্ছে না এখনো। কারণ সবাই তাকিয়ে আছেন দ্বিতীয় তালিকার দিকে। নাম বাদ যাওয়ার ভয়ে সংখ্যালঘুরা আতঙ্কিত। তবে চাপা ক্ষোভ কিন্তু রয়েছে।
এনআরসির রাজ্য সমন্বয়ক প্রতীক হাজেলার নাম নেই তালিকায়। নাম রয়েছে পলাতক উলফার জঙ্গিনেতা পরেশ বড়ুয়ার। এ নিয়ে মুখ খোলায় মুঠোফোনে হুমকি হজম করতে হয়েছে কংগ্রেস বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থকে। দ্বিতীয় তালিকাও প্রস্তুত। শিগগিরই তা প্রকাশিত হবে। অবশ্য এর আগে তিনি সর্বোচ্চ আদালতে হলফনামা দিয়েও কথা রাখেননি। ১৫ নভেম্বর প্রতীকের হলফনামা বলেছিল, ২ কোটি লোকের তথ্য যাচাই শেষ। ১৫ জানুয়ারি অবধি সময় পেলে আরও ৩৮ লাখ আবেদন তিনি যাচাই করতে পারবেন। কিন্তু ৭৫ হাজারের কর্মী বাহিনী নিয়ে দেড় মাস পরে তিনি যে তালিকা প্রকাশ করেছেন, মোট আবেদন করেছিলেন ৩ কোটি ৩৯ লাখ আসামবাসী। পেলেন মাত্র ১ কোটি ৯০ লাখ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল বলছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায়ও বিরূপ মন্তব্য করলে শাস্তি অনিবার্য।
বোঝাই যাচ্ছে, ভিনরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী (পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) এনআরসি নিয়ে মুখ খোলায় তাঁর নামে মামলা রুজু হয়েছে। আসল উদ্দেশ্য খোদ মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দই জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আশ্রয় দেব। দেব অন্ন-বস্ত্রও। কিন্তু এনআরসিতে নাম না থাকলে কেড়ে নেব মৌলিক অধিকার। ভোট দিতে পারবেন না তাঁরা।’
তরুণ চক্রবর্তী: প্রথম আলোর ত্রিপুরা প্রতিনিধি।