মৃত শিক্ষক আর এস্কেলেটরের গণশিক্ষা

অনশনরত মাদ্রাসা শিক্ষক। ফাইল ছবি
অনশনরত মাদ্রাসা শিক্ষক। ফাইল ছবি

আব্দুল মান্নান নামের মাদ্রাসার একজন শিক্ষক মারা গিয়েছেন। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি অনশন করছিলেন তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির দাবি নিয়ে। আরও শত শত শিক্ষক আমরণ অনশন করছেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন যে তাঁদের দাবি পূরণ হবে। সেটা শুনে আব্দুল মান্নান বাদে বাকি সবাই বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। এর আগেও বহুবার এমন করে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন তাঁরা; বহুবার তাঁদের আশ্বাস দিয়েছিলেন মন্ত্রীরা। ২০০৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২৬ বার কর্মসূচি দিয়েছেন নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা। সেই আগের ২৬ বারের মতন এবারও আশ্বাস পাওয়া গেছে। তবে এবারও এমপিও পাওয়া যাবে কি না, তা আমরা এখনো জানি না।

সরকার এই শিক্ষকদের ঝুলিয়েই রেখেছে গত এক যুগ ধরে, হয়তো আরও কিছুদিন ঝুলিয়ে রাখবে। অথচ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকারি তহবিল থেকে মান্থলি পে অর্ডারের (এমপিও) অধীনে বেতন দেওয়ার কৌশলটি কিন্তু গণশিক্ষার জন্য খুব চমৎকার একটি কৌশল হতে পারত। সরকারি ফান্ড-আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনা, এমন হিসাবে আমেরিকাতেও চার্টার স্কুল চলছে। সেখানে বর্তমানে ছয় হাজারেরও বেশি স্কুল বিনা খরচে দুই মিলিয়নের চেয়েও বেশি ছাত্রছাত্রী পড়াচ্ছে এবং সেই ছাত্রছাত্রীরা অনেক ক্ষেত্রেই সনাতনী ধারার সরকারি স্কুলগুলোর ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে ভালো ফল করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই উদাহরণ আমরাও অনুসরণ করতে পারতাম। এই দেশে গণশিক্ষার যতখানি দায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়ে বসেছে, তাতে সেটাই হতে পারত আমাদের কাছে সর্বজনের শিক্ষা নিশ্চিত করার একটি সুচারু কৌশল। মোট প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪৫ শতাংশ বেসরকারি স্কুলগুলোর মাঝে ২১ শতাংশকে আংশিকভাবে অর্থায়ন করে সরকার (সিআইএস, ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স)। মাধ্যমিক পর্যায়ের চিত্র আরও ভয়াবহ। মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৯৮ শতাংশই বেসরকারি আর নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী ফাউন্ডেশনের সভাপতির দাবি অনুযায়ী যার এক-চতুর্থাংশই সরকারি অর্থায়নের বাইরে। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ২০ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থীকে পাঠদানে নিয়োজিত থাকা ৮০ হাজারেরও বেশি শিক্ষক-কর্মচারী বেতন পান তাঁদের বেসরকারি মালিকদের কাছে থেকে। (সমকাল, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭) এই মালিকেরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন নিয়ে সেই বেতনের একটি ভগ্নাংশ তুলে দেন শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছে।

এই বেতনের ভারটি যদি সরকার নেয়, তাহলে শুধু শিক্ষক-কর্মচারীরাই নিশ্চয়তায় চাকরি করতে পারেন না, সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ জনতাও গণশিক্ষার সুযোগ পেতে পারে আরও সুলভ মূল্যে। এই নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমন সব নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে শিক্ষাসেবা পৌঁছে দেয়, যেখানে সম্পূর্ণভাবে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার স্কুলগুলো পৌঁছাতে পারেনি। এই স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় শিক্ষকদের বেতনের দায়ভারটি যদি সরকার নেয়, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলোর মাসিক বেতন কমে চলে আসতে পারে সেই নিম্ন আয়ের লোকজনের নাগালের আরও কাছাকাছি আর নতুন স্কুল না গড়েও শিক্ষার আলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিতে পারে সরকার।

তবে সরকার সেটি করেনি, সরকার সেটি করছে না। অর্থাৎ আমাদের সরকার যে সর্বজনের জন্য শিক্ষার সুযোগ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে, শুধু তা-ই নয়, বরং যাঁরা বেসরকারি উদ্যোগে সর্বজনের কাছে শিক্ষার আলো নিয়ে গেছেন, তাঁদের ওপরও ভার লাঘব করতে আর প্রান্তিক জনপদের ওপর শিক্ষার খরচের ভার লাঘব করতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছে। অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমাদের সরকার দারুণ অর্থকষ্টের মাঝে রয়েছে। নিশ্চয়ই এই নন-এমপিওভুক্ত স্কুলগুলোকে সাহায্য করার মতো তহবিল তাদের কাছে নেই। কিন্তু সেই বিশ্বাসও আর ধরে রাখতে পারি না যখন শুনি এই সরকারের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর ১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬৩টি স্কুলে চলন্ত সিঁড়ি স্থাপনের তুঘলকি প্রকল্প হাতে নেয়। শুধু এই প্রকল্পের টাকা যদি চলন্ত সিঁড়ির পেছনে ব্যয় না করে জীবন্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের পেছনে ব্যয় করা হতো, তাহলে গাণিতিক হিসাবে যে এক যুগ ধরে এই ৮০ হাজার মানুষকে সরকার ঝুলিয়ে রেখেছে, তাদের সবার মাসিক বেতনের অর্থসংস্থান হয়ে যেত। নন-এমপিও শিক্ষকদের তখন পড়ানো বন্ধ রেখে রাজপথে অনশন করতে হতো না। আব্দুল মান্নান স্যারেরও আজকে অনশনে মরতে হতো না।

কিন্তু কারা এই ১৬৩ স্কুলের ছাত্রছাত্রী, যাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে এত কষ্ট হয়ে যাচ্ছে? আমি হলফ করে বলে দিতে পারি যে তারা মানিকগঞ্জের দপ্তরি দিয়ে ক্লাস পড়ানো স্কুলের অথবা সিরাজগঞ্জের চরে দুই ঘণ্টা ধরে হেঁটে এসে ক্লাস করতে বসা ছাত্রছাত্রীরা নয় (দিলশানা পারুল, প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২০, ২০১৭)। আর তাদের সঙ্গেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমিত আসনের জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ করতে হয় নন-এমপিও স্কুলে পড়া নন-এলিট উদোম কিশোরদের। কারণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পেলে হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ারই সুযোগ পাবে না তারা। দশটি ভর্তি কোচিং করা চলন্ত সিঁড়িতে চড়া মহানগরীর তাগড়াদের সঙ্গে ওপরে ওঠার প্রতিযোগিতা করতে হবে নন-এমপিও স্কুল অথবা মাদ্রাসার রুক্ষ দড়ি বেয়ে। তাদের ওপর বিনিয়োগ করার মতো পয়সা আমাদের সরকার খুঁজে পায় না। তবে শিক্ষা বাণিজ্য ঘিরে দেশের যাবতীয় মুনাফাকেন্দ্রিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করে (প্রাইভেট ব্যাচ, কোচিং, টিউটর ইত্যাদি) তাদের ওপরে আরও বেশি করে বিনিয়োগ করার মতো পয়সা আমাদের সরকারের কাছে সব সময়েই থাকে।

বারবার আমরা শুনতে পাই যে আমাদের দেশে শিক্ষার পেছনে নাকি জিডিপির যথেষ্ট পরিমাণ বরাদ্দ করা হয় না। আরও বেশি নাকি পয়সা প্রয়োজন গণশিক্ষার প্রসারের জন্য। হয়তো সেটি ঠিক, হয়তো আরও পয়সা পেলে ভালো হতো। তবে যতটুকু আছে, তাকে যেমন করে উল্টো হিসেবে বণ্টন করা হচ্ছে, তাতে হাজার নতুন তহবিল এলেও প্রান্তিক ছাত্রের কাছে সেই তহবিলের সুফল পৌঁছাবে, এমন আশা আমরা করতে পারি না। মার্টিন লুথার কিংয়ের ষাটের দশকের আমেরিকার মতো আমাদের একুশ শতকের বাংলাদেশেও আজ সমাজতন্ত্র কেবল ধনীদের জন্যই। তাদের ভাগ্যেই সরকারি চলন্ত সিঁড়ি, কিন্তু দরিদ্রের ওপরে ওঠনোর উপায় কেবলই ব্যক্তিবাদের রুক্ষ দড়ি।

অতঃপর যদি আমরা বলি যে গণশিক্ষা তার লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে, তাহলে কি আমাদেরও ষড়যন্ত্রী বলা হবে?

অনুপম দেবাশীষ রায়: গবেষণা সহযোগী, কেটো ইনস্টিটিউট, যুক্তরাষ্ট্র।