ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে দরকার সুপরিকল্পনা

আমার বড় ভাই মীর আবুল হোসেনকে ছোটবেলা থেকে দেখেছি দিনলিপি লিখতে বিরামহীনভাবে সেই ১৯৫৯ সাল থেকে। বাসায় বাজার নেই, নানা অভাব, তাই বলে দিনলিপি লেখার সময়ের অভাব ছিল না। ১৯৬৩-৬৪ সালের দিকে তিনি একবার কলেরায় আক্রান্ত হলেন। এমন দুরারোগ্য ব্যাধিতে পড়েও ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে মনে করিয়ে দিলেন রোগমুক্ত হওয়ার পর যাতে দিনলিপির জন্য নিজের দেহসংক্রান্ত, পারিবারিক, সামাজিক, আঞ্চলিক, দেশি ও বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের অভাব না ঘটে। ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্যুর কিছুদিন আগে পর্যন্ত তিনি এই দিনলিপি লিখে গেছেন। তাঁর দিনলিপি আমাদের সমাজ ও দেশের দৈনন্দিন জীবনের একটি নির্মোহ চালচিত্র ধরে রেখেছে।

এতে রয়েছে দেশ ও বিদেশের প্রায় ষাট বছরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। রয়েছে মানিকগঞ্জ, ঢাকাসহ তাঁর কর্মস্থল এলাকার যাতায়াত ভাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম, বই-খাতা-কলম-পেনসিলের দাম, স্কুলে ভর্তির ফি ইত্যাদি। এমনকি প্রাক-মোবাইল যুগে প্রতি টেলিফোন কলে তিনি কতটা সময় ব্যয় করেছেন, তার খতিয়ানও রয়েছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও জাতীয় তথ্যাদি থাকা সত্ত্বেও যেহেতু দিনলিপিটি ব্যক্তিগত, তা থেকে তথ্য ব্যবহারের সুযোগ হয়নি। তবে সৌভাগ্যবশত সেই দিনলিপির জিম্মাদার এখন আমি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বগুড়া এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য জীবন বাজি রেখে তিনি দিনলিপির বস্তা নিয়ে পালিয়েছিলেন। সেই সময় কিছু মূল্যবান কপি দুর্ভাগ্যজনকভাবে হাতছাড়া হয়েছে। তাঁর দিনলিপি স্বীয় কর্মস্থল শ্রম পরিদপ্তরে বিশ্বাসযোগ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত ছিল। তাঁর সব সহপাঠী শুধু নন, তাঁদের পরিবার-পরিজন সম্পর্কেও ‘সতীর্থ পরিচিতি’ নামক দিনলিপির সংযোজন হিসেবে একটি খণ্ড তৈরি করেছিলেন। আমাদের নিকট-দূর আত্মীয়-অনাত্মীয়ের জন্ম, মৃত্যু, বিবাহবার্ষিকীর সব খবর আবার আলাদা করে, যত্ন করে আরেক খণ্ডে রেখেছেন। জীবনের সব আয় ও ব্যয় কড়ায়-গন্ডায় লিখে রাখতেন।

যাহোক, তাঁর পাশে থেকে আমার বেড়ে ওঠার সুযোগ হয়েছে। তাই আমিও দিনলিপি লিখেছি, কিন্তু ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারিনি। এর জন্য যে অঙ্গীকার দরকার, তার অভাব ছিল। তবে বাজার খরচ মোটামুটি লিখেছি। তাই দেশে আসার পর ১৯৮৭ সাল থেকে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কিছু তথ্য আমার কাছে রয়েছে। সে সম্পর্কে ভবিষ্যতে লেখার ইচ্ছা রইল যে একজন চাকরিজীবীর জন্য দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তাঁর আর্থিক জীবনে কতটা প্রভাব ফেলে। যেমন ১৯৮৭ সালে গরুর মাংসের দাম ছিল ৪০ টাকা কেজি, এখন তা ৪৮০ থেকে ৫০০ টাকা। বৃদ্ধি ১২-১৩ গুণ। ফার্মের মুরগি ছিল ২০ টাকা কেজি, এখন তা ১৬০ টাকা, অর্থাৎ ৮ গুণ বেশি। 
অতিসম্প্রতি সদাশয় সরকারের ঔদার্যে চাকরিজীবীদের বেতনের যে আশাতীত উল্লম্ফন হয়েছে (চাকরিহীন, যাঁরা ব্যবসায়ী নন, তাঁদের খবর কে রাখে?), সেই সুবাদে তাঁরা হয়তো আগের মতো চলছেন। তবে সমাজ ভোগোন্মত্ত হওয়ায় আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেড়েছে, ফলে আমরা তুষ্ট হচ্ছি না।

প্রতিটি বিদেশভ্রমণেই আমাদের এই ভোগী চরিত্রটি আমার কাছে আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ভারতে ট্রেনে তিন স্তরে শোয়ার ব্যবস্থা, আমাদের দুই স্তরে। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দেশ রাশিয়ায় হোটেলের এক কক্ষে আটটি খাট দেখেছি, আমাদের কয়টি? যুক্তরাষ্ট্রে স্কুল ডিস্ট্রিক্ট বলে গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণা আছে। যে বাসা যে স্কুল ডিস্ট্রিক্টে, সে বাসার ছেলেমেয়েদের সেখানকার স্কুলে পড়তে হবে। তাই বাড়িঘরের দাম, ভাড়া-সবই স্কুল ডিস্ট্রিক্টের ওপর নির্ভর করে। যে দেশে ঘরে ঘরে গাড়ি, রাস্তাঘাট দুনিয়ার সেরা, সেখানে যেকোনো জায়গায় থেকে যেকোনো স্কুলে পড়ানো যাবে না। আমাদের দেশের মতো নয় যে টঙ্গী থেকে ভিকারুননিসা কিংবা নটর ডেমে সন্তানকে ভর্তি করা যায়। যানজটে শহরবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত হলেও কোনো অসুবিধা নেই। নিজের গণতান্ত্রিক অধিকারের অনুশীলন তো করতে হবে!

মার্কিন মুলুকে যত জায়গায় ভ্রমণ করেছি, সব জায়গায় আবাসন কার্যক্রম সুপরিকল্পিত। একই ক্যাম্পাসে বাড়িগুলোর মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই, যা আমাদের দেশে দেখা যায়। আমাদের ভূমি ব্যবহারে দেশবান্ধব পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নানাভাবে মাত্রাতিরিক্ত বড় বাড়ি তৈরিকে নিরুৎসাহিত করতে হবে, বহুতল ভবন নির্মাণকে উৎসাহিত করতে হবে। এখনো আমরা মধ্যম নয়, নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। আমাদের অর্থনৈতিক আচরণ অবশ্যই আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হবে।

২০১৫ সালে আমাদের ক্রয়ক্ষমতার (পিপিপি) সূচক ছিল ৩ হাজার ৮০০ ডলার, আর যুক্তরাষ্ট্রে তা ছিল ৫৮ হাজার ডলার, অর্থাৎ ১৫-১৬ গুণ বেশি। অথচ দুই দেশের দ্রব্যমূল্য প্রায় সমান। সুতরাং আমাদের মধ্যে ভোগের মনোবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করা উচিত। সব আমদানি করা দ্রব্যের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা উচিত। ২০১৪ সালের হিসাবে ভারতের পিপিপি ৫ হাজার ৬০০ ডলার, পাকিস্তানের ৫ হাজার আর বাংলাদেশের ৩ হাজার ৩৪০। ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পিপিপি ছিল ২৪ হাজার। ২৫ বছরে আড়াই গুণ বেড়েছে, আমাদের বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ, যা আমাদের জন্য ইতিবাচক। এবার আমেরিকায় এসে জানতে পারলাম, চীন ও ভারত থেকে আসা অনেক ছাত্রই দেশে ফিরে যাচ্ছেন। এই তথ্য ভারত ও চীনের অগ্রগতির সূচক। আশা করি অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ছাত্রদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটনা ঘটবে।

প্রায়ই আমরা দেশে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের দাবি করে থাকি। এ বিষয়ে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডির একটি বাণী বহুলভাবে উদ্ধৃত, ‘তোমার দেশ তোমাকে কী দিতে পারে, এ কথাটি জিজ্ঞাসা না করে বরং জিজ্ঞাসা করো, তুমি দেশকে কী দিতে পারবে।’ ভারত বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের অধিক আয় করছে, আর আমরা যে কত করছি, তা বলা মুশকিল। ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম, ২০১৫-১৬ সালে আমরা ১৫০ মিলিয়ন আয়ের কথা দম্ভের সঙ্গে জানিয়েছি, ২০১৭ সালে সেই সংখ্যা বলা হচ্ছে ৮০০ মিলিয়ন। কোথাও বলা হয়েছে ২০০৫-০৬ সালে ২৫ মিলিয়ন। নানা সময়ে প্রকাশিত রিপোর্টগুলো যে তথ্যনির্ভর নয়, তা অতি সহজেই বোঝা যায়।

তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায়ের মাপকাঠিতে ভারতীয় সিংহের তুলনায় আমরা বিড়াল নই, রীতিমতো ইঁদুর। যদিও আমাদের ছাত্ররা প্রোগ্রামিংয়ে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব বারবার প্রমাণ করেছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি খাতে ভারতের তুলনায় আমরা এগিয়ে আছি। আমাদের এই খাতে গত ৩০ বছরের নেতৃত্বকে কীভাবে মূল্যায়ন করা যায়, তা চিন্তার বিষয়। আমাদের বিগত কর্মসূচিসমূহের নির্মোহ, নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়ন করে অগ্রসর হওয়া উচিত।

নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্য কিংবা উচ্চ আয়ের দেশে রূপান্তরের চাবিকাঠি হলো শিক্ষা, যাকে গুরুত্বহীন রেখে উন্নয়ন আশা করা যায় না। যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণের পেছনে ব্যয় করার আগে যাচাই করা উচিত, এত দিনের বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত সফলতা এনে দিয়েছে কি না। আমাদের তরুণেরা যথেষ্ট উদ্যমী। তাদের ব্যবহার করে কীভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তর ঘটানো যায়, তার সুন্দর পরিকল্পনা করতে হবে।

মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।