প্রধান বিচারপতিদের নিয়ে বিতর্ক কেন

ভারতের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র
ভারতের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র

এই উপমহাদেশের দেশগুলোতে প্রধান বিচারপতিদের নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে নানা বিতর্ক হয়েছে। কখনো তাঁরা রাষ্ট্রের শাসকদের বিরাগভাজন হয়ে, কখনো শাসকদের বিরুদ্ধে শক্তভাবে আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে আলোচনায় এসেছেন। কখনো তাঁরা শক্তিধর শাসককে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করতে পেরেছেন, কখনো নিজেরাই পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে ভারতে সাম্প্রতিক বিতর্কটি অবশ্য একেবারে অন্য ধরনের। এ বিতর্কটি অতি গুরুত্বপূর্ণও। কারণ, এতে প্রধান বিচারপতির ক্ষমতা প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সুপ্রিম কোর্টেরই সিনিয়র চারজন বিচারক। তাঁদের অভিযোগের মোদ্দা কথা হচ্ছে, ভারতের বিজেপি সরকারের জন্য সংবেদনশীল মামলাগুলো উচ্চ আদালতের কোন বিচারক বিচার করবেন, তা এককভাবে নির্ধারণ করছেন প্রধান বিচারপতি এবং তিনি তা করছেন সরকারের অনুকূলে।

ভারতের গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে শক্ত বলে ধারণা করা হয়। সেখানে এমন একটি অভিযোগ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর অবস্থা আরও কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তার ইঙ্গিতবাহী। প্রধান বিচারপতির ক্ষমতা প্রয়োগে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার প্রয়োজনীয়তাকেও এটি নতুন করে তুলেছে।

২.
প্রধান বিচারপতির ক্ষমতা প্রয়োগে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার প্রশ্ন আসে কেন? আসে, কারণ, তিনিও রক্ত-মাংসের একজন মানুষ। কয়েক যুগ আগে এটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে সতর্ক করেছিলেন ভারতের সংবিধানের প্রধান রূপকার ভিমরাও রামজি আম্বেদকার নিজেই।

আম্বেদকার ছিলেন এক দরিদ্র ও দলিত পরিবারের ১৪ তম সন্তান। সেখান থেকে উঠে এসে তিনি ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন, স্বাধীন ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রী হয়েছেন। কয়েক যুগ আগে প্রয়াত হলেও অসামান্য প্রজ্ঞার অধিকারী এই মানুষটির বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ও মতামত আজও ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে এবং বিভিন্ন ফোরামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

১৯৪৯ সালে কনস্টিটিউশন অ্যাসেম্বলি বিতর্কে আম্বেদকারের একটি পর্যবেক্ষণ এখন আলোচিত হচ্ছে ভারতের বর্তমান প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগটির পরিপ্রেক্ষিতে। আম্বেদকার সেখানে কী বলেছিলেন, তা আলোচনার আগে বিতর্কের বিষয়টি নিয়ে একটু আলোকপাত প্রয়োজন। বিতর্কটি ছিল সদ্য স্বাধীন ভারতের প্রধান আদালতে বিচারপতি নিয়োগের পদ্ধতি নিয়ে। প্রাণবন্ত এই আলোচনায় বিচারপতি নিয়োগের জন্য তিনটি পদ্ধতি সুপারিশ করা হয়। এর একটি ছিল প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ (কনসালটেশন) করে অন্য বিচারপতি নিয়োগ। রাষ্ট্রপতি তথা শাসন বিভাগের ক্ষমতায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আম্বেদকার এটি সমর্থন করেন। কিন্তু কনসালটেশন বলতে কনকারেন্স বা ঐকমত্য বোঝায় কি না, এ নিয়ে তিনি দ্বিমত পোষণ করেন।

আম্বেদকারের মতে, প্রধান বিচারপতির সম্মতি ছাড়া রাষ্ট্রপতি বিচারপতি নিয়োগ করতে পারবেন না, কনসালটেশন বলতে এটি বোঝানো ঠিক হবে না। কারণ, প্রধান বিচারপতিও ভুল করতে পারেন, ‘সাধারণ মানুষের মতো তাঁর নিজেরও ব্যক্তিগত আবেগ ও পক্ষপাতিত্ব থাকতে পারে’।

আম্বেদকার তাই প্রধান বিচারপতির অসীম ক্ষমতার বিরুদ্ধে বলেছেন। পুরো বিতর্কে বহুবার প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এবং অন্যদের অসীম ক্ষমতার বিপদের কথাও বলেছেন। যতই গণতান্ত্রিকভাবে কেউ নির্বাচিত হোন, যতই প্রাজ্ঞ বা অভিজ্ঞ একজন মানুষ হোন কিংবা যতই থাকুক তাঁর শপথ, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদের ব্যক্তিরাও রক্ত-মাংসের মানুষ। একচ্ছত্র ক্ষমতা তাঁরা কেউ পেলে রাষ্ট্র বা গণমানুষের জন্য তা খারাপ হয়ে উঠতে পারে মাঝেমধ্যে।

কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেম্বলিতে আম্বেদকারের বিভিন্ন সাবধানবাণীর দুটো দিক ছিল। এক. সরকারের তিনটি অঙ্গের কোনোটিরই একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকা উচিত নয়। দুই. এই তিনটি বিভাগের, এমনকি সর্বোচ্চ ব্যক্তিরাও মানবীয় দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে নন বলে তাঁদেরও ব্যক্তিগত ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা থাকা উচিত।

সরকারের তিনটি অঙ্গের ক্ষমতা প্রয়োগে ভারসাম্য না থাকলে কী পরিণতি হতে পারে, তা ভারতে প্রকটভাবে ফুটে ওঠে ১৯৭৬ সালে এডিএম জাবালপুর মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে। এই মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট জরুরি অবস্থা চলাকালে ডিটেনশনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ নেই বলে রায় দেন। পাঁচজনের বেঞ্চ এ মামলাটি নিষ্পত্তি করেন, রায়ের বিরুদ্ধে একমাত্র মতটি ছিল বিচারপতি রাজ খান্নার। এর জন্য চরম মূল্য দিতে হয় তাঁকে। ১৯৭৭ সালে তাঁকে টপকে জুনিয়র একজনকে প্রধান বিচারপতি করা হয়, তিনি প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত এর আগে থেকেই মানবাধিকার প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে দ্বিমত করে বহু ব্যাখ্যা দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু সিনিয়র বিচারপতিদের নিয়ে কলেজিয়াম প্রতিষ্ঠা করে এবং জুডিশিয়াল রিভিউ ক্ষমতার অবাধ প্রয়োগ করে, বিচারপতি নিয়োগসহ বহু বিষয়ে রাষ্ট্রের নির্বাহী ও আইন বিভাগের ক্ষমতার রাশ টেনে ধরার সূচনা হয় এরপর থেকেই।

আম্বেদকারের দ্বিতীয় সতর্কতাটি ছিল রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের মানবীয় দোষ-ত্রুটি নিয়ে। ভারতের প্রধান বিচারপতির কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনায় এ বিষয়টিই এখন উঠে এসেছে; বিশেষ করে বেঞ্চ গঠন, সাংবিধানিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগ কীভাবে আইনের শাসনকে বিপর্যস্ত করতে পারে, এটি এখন নতুন করে আলোচিত হচ্ছে ভারতে।

৩.
ভারতের সংবিধান প্রধান বিচারপতিকে বহু ক্ষমতা প্রদান করেছে। সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করতে হয় রাষ্ট্রপতিকে। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টে অ্যাডহক বিচারক নিয়োগ, অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের কোনো মামলার বিচারকার্যে রাখা, কোর্টের অফিসার ও কর্মচারীদের নিয়োগ, বিচারকদের এক হাইকোর্ট থেকে অন্য হাইকোর্টে বদলি করতে তিনি ভূমিকা রাখেন। তিনি আর্থিক বিষয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলোর মধ্যে বিরোধ হলে তার নিষ্পত্তির জন্য আরবিট্রেটর নিয়োগ করেন।

এ ছাড়া বিভিন্ন আইন, রায় ও প্রথার মাধ্যমে তিনি আরও বহু ক্ষমতার অধিকারী। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিচারকদের নিয়ে বেঞ্চ গঠন। কোন বেঞ্চ কী মামলা শুনবেন, কোন বেঞ্চে কোন বিচারপতিরা বসবেন, বেঞ্চে কতজন বিচারক থাকবেন, তা তিনি নির্ধারণ করেন। ভারতে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অসন্তোষ এই ক্ষমতার প্রয়োগ নিয়েই। তিনি বিজেপি সরকারের জন্য সংবেদনশীল বিভিন্ন মামলা বিজেপির জন্য অনুকূল হতে পারে-এমন বিচারকদের নিয়ে বেঞ্চ গঠন করিয়ে নিষ্পত্তি করেন-ঘুরেফিরে অভিযোগ আসলে এটিই।

এই অভিযোগ সত্যি হতে পারে। বেঞ্চ গঠন করার একক ক্ষমতা প্রধান বিচারপতির হাতে থাকলে আসলেই ন্যায়বিচারকে প্রভাবিত করা সম্ভব। সংবেদনশীলতার বিচারে হাইকোর্টে যেসব মামলা, আপিল বা আবেদন আসে, তা মোটামুটিভাবে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগে রয়েছে মূলত মানবাধিকার ও অন্যান্য বিষয়ে রিট পিটিশন এবং রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা। এসব মামলায় সরকারকে মানবাধিকার হরণকারী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখতে, দেশে ভিন্নমতকে রক্ষা করতে এবং সর্বোপরি সরকারকে আইন মেনে চলতে বাধ্য করতে রায় দেওয়া যায়। আবার তা না করে সরকারের এ ধরনের কর্মকাণ্ড চোখ বুজে মেনে নেওয়াও যায়। অন্যদিকে দেওয়ানি, কোম্পানি, অ্যাডমিরালটি ধরনের অনেক মামলা রয়েছে, যা সরকারের জন্য তেমন বিব্রতকর কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা কম।

যেকোনো দেশের উচ্চ আদালতে বিভিন্ন আমলে নিয়োগ পাওয়া বহুসংখ্যক বিচারক থাকেন। একজন প্রধান বিচারপতির সুযোগ থাকে সরকারের জন্য সংবেদনশীল মামলাগুলোয় সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল বা সরকারপন্থী হিসেবে পরিচিত বিচারকদের রাখার। উপমহাদেশের দেশগুলোয় প্রধানত আইনজীবীদের মধ্য থেকে বিচারক নিয়োগ করা হয় বলে এবং আইনজীবীদের অনেকে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগী পেশাজীবী সংগঠনে জড়িত থাকেন বলে প্রধান বিচারপতি চাইলে এমন বিচারক বেছে নিতে অসুবিধা হয় না।

এসব দেশে কোন বেঞ্চে কতজন বিচারক থাকবেন, তা-ও এককভাবে নির্ধারণ করতে পারেন প্রধান বিচারপতি। কোনো সরকারের জন্য বিব্রতকর মামলায় প্রাজ্ঞ কোনো সিনিয়র বিচারপতির সঙ্গে নতুন সরকারের আমলে সদ্য নিয়োগ পাওয়া কোনো বিচারপতিকে তিনি নিয়োগ দিতে পারেন। সরকারের অনুকূলে রায় না দিলে জুনিয়র বিচারপতির চাকরি স্থায়ী নিয়োগ না হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সে ক্ষেত্রে তিনি সিনিয়র বিচারপতিদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে রায় দিলে মামলাটি অমীমাংসিত অবস্থায় আবার প্রধান বিচারপতির হাতে চলে যায়, তিনি তখন পছন্দসই কোনো তৃতীয় বিচারপতিকে নিয়োগ দিতে পারেন।

এসব দেশে আপিল আদালতে চেম্বার জজ মনোনয়নেও প্রধান বিচারপতির একক ক্ষমতা রয়েছে। চেম্বার বিচারপতি তাৎক্ষণিকভাবে হাইকোর্টের রায় বা সিদ্ধান্ত অন্তত কিছু সময়ের জন্য স্থগিত রাখার ক্ষমতা রাখেন। তিনি তা করলে কখনো কখনো তা সরকারের রোষানলে থাকা ব্যক্তিদের জন্য মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।

৪.
ইচ্ছেমতো বেঞ্চ গঠন করে একজন প্রধান বিচারপতি এভাবে সরকারের অন্য দুই অঙ্গের কর্মকাণ্ডের ভূমিকা পালন করতে পারেন। অনুন্নত গণতান্ত্রিক দেশে শাসন বিভাগের তাই চেষ্টা থাকে পছন্দসই বিচারককে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের। প্রথা ভেঙে তুলনামূলকভাবে জুনিয়র কোনো বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের প্রবণতা তাই এসব রাষ্ট্রে কখনো কখনো দেখা যায়।

ভারতে প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে বিতর্কের মধ্য দিয়ে এ বিষয়গুলোই উঠে এসেছে। আইনের শাসন ও মানবাধিকার আরও জোরদার করার জন্য এসব বিষয়ে আন্তরিক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে প্রধান বিচারপতির ক্ষমতার প্রয়োগ-পদ্ধতি গণতন্ত্রায়ণের, এ নিয়ে অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টির। এমনকি প্রধান বিচারপতি নিয়োগের পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা আনার।

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।