ট্রাম্পের নতুন প্রতিরক্ষা কৌশল

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম মাটিস শুক্রবার যে প্রতিরক্ষা কৌশল ঘোষণা করেছেন, যাকে সহজ ভাষায় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রতিরক্ষানীতি বলেই বিবেচনা করা হয়, দেড় দশকের বেশি সময় ধরে যে নীতি ও কৌশল অনুসৃত হয়েছে, তা থেকে একেবারেই ভিন্ন। জর্জ ডব্লিউ বুশ (২০০১-২০০৯) এবং বারাক ওবামা (২০০৯-২০১৭) প্রেসিডেন্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন এবং যেসব চ্যালেঞ্জ প্রধান বলে বিবেচনা করেছিলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন প্রতিরক্ষানীতি তা থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে এল।

এটা যদিও মোটেই বিস্ময়কর নয় যে ট্রাম্পের নীতি রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বুশ বা ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট ওবামা থেকে ভিন্ন হবে। কেননা ট্রাম্পের অধিকাংশ অভ্যন্তরীণ এবং পররাষ্ট্রনীতি, যেগুলো তিনি বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন বা যেগুলো তিনি প্রস্তাব করেছেন, আগের চেয়ে ভিন্ন; সেগুলো প্রচলিতভাবে কোনো দলেরই দীর্ঘদিনের আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় এবং প্রধানত খামখেয়ালিপূর্ণ বা হঠকারী ধরনের। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রতিরক্ষানীতির যে কাঠামো ঘোষণা করেছিলেন, নতুন প্রতিরক্ষানীতি তারই বিস্তারিত ভাষ্য। প্রতিরক্ষানীতির দুটি ভাষ্য তৈরি করা হয়-এর একটি হচ্ছে সারাংশ, যা সাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয়, অন্যটি সংগত কারণেই গোপনীয় বলে বিবেচিত হয়। শুক্রবার মাটিস ১১ পৃষ্ঠার সারাংশটি প্রকাশ করেছেন। আমরা তা থেকেই মোটাদাগে প্রতিরক্ষানীতির মূল দিকগুলো বুঝতে পারছি।

প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা দরকার যে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকাঠামোর কারণে অভ্যন্তরীণ নীতি ও পদক্ষেপের ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা অনেকাংশেই সীমিত; কিন্তু পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষানীতি ও পদক্ষেপের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী। এসব ক্ষেত্রে তাঁর দিকনির্দেশনা অনেক বেশি কার্যকর। ফলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী যখন কোনো নীতি বা কৌশল ঘোষণা করেন তা আসলে প্রেসিডেন্টের কাঙ্ক্ষিত নীতি এবং তা বাস্তবায়নের সম্ভাবনাই বেশি। ফলে আমরা ধরে নিতে পারি যে প্রশাসন, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, এখন থেকে নতুন নীতির আলোকেই পরিচালিত হবে।

নতুন প্রতিরক্ষানীতির সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য ও সুস্পষ্ট পরিবর্তিত দিক হচ্ছে এই ঘোষণা যে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদকে এখন তার প্রধান চ্যালেঞ্জ মনে করে না। বিপরীতক্রমে দুই পরাশক্তিধর চীন ও রাশিয়াকেই প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে এই ইঙ্গিত দেয় যে এক দশকের বেশি সময় ধরে চীন ও রাশিয়ার প্রভাববলয় বিস্তার লাভ করেছে এবং দুই দেশই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে খর্ব করার চেষ্টা করে আসছে। রাশিয়া কার্যত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্যই হুমকি হয়ে উঠেছে। কিন্তু এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং শক্তি প্রদর্শনের নীতি সঠিক বলে মনে করার কারণ নেই। এ ঘোষণা এই ইঙ্গিতই দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র কার্যত স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের কৌশলেই প্রত্যাবর্তন করল। ১৯৯০ সালের পর গোটা পৃথিবীতে যে নতুন ক্ষমতাবিন্যাস ঘটেছিল, তার আলোকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষানীতিতে যতটা না পরিবর্তন ঘটেছিল, তার চেয়ে বেশি পরিবর্তন ঘটে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পরে প্রেসিডেন্ট বুশের আমলে। বারাক ওবামা সেই নীতিতে সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন এবং অংশত পরিবর্তন ঘটালেও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদকেই প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

কিন্তু বুশ প্রশাসনের থেকে ওবামা প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গিগত একটা বড় পার্থক্য ছিল। বুশ প্রশাসন ১১ সেপ্টেম্বরের পর তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র নামে প্রধানত শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদকে মোকাবিলা করতে সচেষ্ট হয়েছিল। সেই নীতির আলোকেই আফগানিস্তান ও ইরাকে প্রত্যক্ষ সামরিক অভিযান চালানো হয়। ইরাকের ক্ষেত্রে বুশ প্রশাসনের ‘প্রমাণ’ ও ‘যুক্তি’ কোনোটাই যে সত্যি ছিল না তা আমরা অবগত; শক্তি প্রয়োগের এই কৌশলের পরিণতি যে ভয়াবহ হয়েছে তা-ও আমাদের অজানা নয়। বিপরীতক্রমে ওবামা প্রশাসন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো মোকাবিলায় শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি সহিংস উগ্রবাদের কারণ এবং প্রতিকারের বিষয়ে মনোনিবেশের উদ্যোগ নিয়েছিল। সেই পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল ২০১০ সালেই, তবে তার একটা বড় প্রকাশ ঘটে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম বা উগ্র সহিংসবাদবিষয়ক শীর্ষ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে।

এই কৌশলের একটি প্রধান দিক ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ‘সফট পাওয়ার’ বা কূটনৈতিক ক্ষমতা বা প্রভাব ব্যবহার করা, উগ্র সহিংসবাদকে ধর্মীয় পরিচয়ে চিহ্নিত না করা, সহিংসতা মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলো, বিশেষ করে নাগরিকদের যুক্ত করা এবং উগ্র সহিংসবাদ বিস্তারের কারণ ও পরিবেশের দিকে মনোযোগ দেওয়া। এসব ক্ষেত্রে সর্বত্র সাফল্য এসেছে এমন নয়, তবে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার নামে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি এবং গোয়েন্দা তৎপরতা যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি তার বিকল্প হিসেবে প্রত্যক্ষ সামরিক উপস্থিতি এবং শক্তি প্রয়োগের পথও মোটেই ইতিবাচক বলে বিবেচিত হতে পারে না।

এই প্রতিরক্ষানীতি মূলনীতির অর্থে এবং ভঙ্গির দিক থেকে স্নায়ুযুদ্ধের আমলে ফিরে গেলেও স্নায়ুযুদ্ধের সময়, বিশেষত শেষ দিকে, যুক্তরাষ্ট্র তার কূটনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাবের ওপরে গুরুত্ব আরোপ করেছিল। নতুন নীতির পাশাপাশি ট্রাম্প প্রশাসনের অন্যান্য পদক্ষেপে সেই দিকটির অভাবই সুস্পষ্ট। যেমন ঘোষিত নীতির কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গিতে (স্ট্র্যাটেজিক অ্যাপ্রোচ) দীর্ঘ মেয়াদের প্রতিযোগিতার জন্য জাতীয় শক্তির বিভিন্ন দিককে একত্র করার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে আছে কূটনীতির কথা, কিন্তু গত এক বছরে পররাষ্ট্র দপ্তরের বাজেট কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এতে করে কূটনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা দেশটিকে বন্ধুহীন করেছে; অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার সিদ্ধান্ত কূটনীতির বিষয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয় না। লক্ষণীয় যে ২০০৮ সালের পরে এই প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষানীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় অনুপস্থিত থাকল।

এই প্রতিরক্ষানীতিতে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের সঙ্গে জোটবদ্ধতা বাড়ানোর এবং নতুন বন্ধু তৈরি করার কথা বলেছে। কিন্তু ন্যাটো প্রসঙ্গে এও বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র চায় যে তার ইউরোপীয় মিত্ররা প্রতিরক্ষা খাতে তাদের ব্যয় বাড়াক। অবস্থাদৃষ্টে এমন মনে হচ্ছে যেন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর ভবিষ্যতের ব্যাপারে সদস্যদেশগুলোর প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধিকে সহযোগিতার একটি শর্তেই পরিণত করছে। এ প্রসঙ্গে আমাদের অবশ্যই স্মরণ করতে হবে যে ট্রাম্পের এই নতুন প্রতিরক্ষানীতির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং সে জন্য তিনি বাজেটে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। সে জন্য কংগ্রেসের ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে। বলা হয়েছে যে গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে তার প্রভাব হারিয়ে ফেলেছে। কেননা তার সামরিক শক্তি কমেছে এবং চীন ও রাশিয়া তার সুযোগ নিয়েছে।

এই নীতির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক-অর্থনীতি স্পষ্ট, এতে করে সামরিক শিল্প খাত বা মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লাভবান হবে। ইতিমধ্যেই করব্যবস্থার সংস্কারের ফলে এই খাতের সঙ্গে যুক্ত করপোরেশনগুলো লাভবান হয়েছে। ট্রাম্প এবং তাঁর নীতিনির্ধারক সহযোগীরা সম্ভবত এই আশা করছেন যে প্রতিরক্ষা খাতে আরও ব্যয়ের ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে, যা ট্রাম্পের ক্রমহ্রাসমান জনপ্রিয়তার ধারাকে বদলে দিতে পারবে। কিন্তু আমার আশঙ্কা, প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি কেবল ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, এর প্রভাব এশিয়ায় এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায়ও সম্প্রসারিত হবে।

দক্ষিণ এশিয়ায় এই নীতির সম্ভাব্য প্রভাবের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এই নীতির প্রকাশিত ভাষ্যেই রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ জোট এবং ‘পার্টনারশিপ’কে সম্প্রসারিত করবে। এটি হচ্ছে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চার দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত। দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত। একে কূটনৈতিক ভাষায় ‘কোয়াড’ বা ‘চতুর্ভুজ’ বলে বর্ণনা করা হয়। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে মৈত্রী ও সহযোগিতা বাড়িয়েছেন এবং এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় ভারতকে একটি বড় শক্তি বলেই বিবেচনা করছেন। গত আগস্ট মাসে আফগানিস্তান বিষয়ে ট্রাম্প যে নীতি ঘোষণা করেছিলেন, সেখানে ভারতের আরও সক্রিয় ভূমিকার কথা বলা হয়েছে।

গত বছর নভেম্বর মাসে ম্যানিলায় আসিয়ানের বৈঠকের পাশাপাশি এই চতুর্ভুজের উপসচিব পর্যায়ে একটি বৈঠক হয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের দৃশ্যমান অবনতি এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে প্রতিরক্ষানীতি যে ধরনের সহযোগিতার কথা বলছে, তাতে দক্ষিণ এশিয়ায় অস্ত্র প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে বলেই মনে করা স্বাভাবিক। প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে অভ্যন্তরীণভাবে সংশ্লিষ্ট দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক কল্যাণ খাতে বরাদ্দ হ্রাস। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় তা আরও দুভাবে প্রভাব ফেলবে। প্রথমত, এতে করে আঞ্চলিক নিরাপত্তায় অস্থিরতা দেখা দেবে; দ্বিতীয়ত, ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপরে আরও বেশি প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাবে। সেই চেষ্টা এসব দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপরে প্রভাব ফেলবে বলেই ধারণা করা যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন প্রতিরক্ষানীতি আগামীকালই সবকিছু বদলে দেবে তা নয়, তবে এই দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশল যে অনেক ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করবে, তা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।