আমি আশাবাদী - কথাটি বলতে পারছি না

বাঙালির জাতীয় চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হোক কিংবা দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে থাকার কারণেই হোক, সামান্য ত্রুটি দেখলে ক্ষোভে ফেটে পড়া এবং অল্প পাওয়ার আনন্দে নেচে ওঠা এ দেশের মানুষের একটি সহজাত প্রবণতা। জীবনটা সব সময় সরলরেখায় চলে না। এখানে আছে অনেক খানাখন্দ, চড়াই-উতরাই; তাই না-পাওয়ার বেদনা কিংবা অর্জনের আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বোধ করি সে জন্যই আমাদের শব্দভান্ডারে প্রতিবাদ-আন্দোলন-লড়াই-ষড়যন্ত্র-উৎখাত-এসব চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়েছে। এসব ছাড়া জীবন যেন অচল।

একসময় ‘কমিউনিজম’ শব্দটি আমাদের অনেককে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল। কার্ল মার্ক্সের বই পড়ে আমরা ভাবতে শুরু করলাম, কমিউনিজমে পৌঁছাতে পারলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। উৎপাদনের পরিমাণ এত বেড়ে যাবে এবং বণ্টনব্যবস্থা এমন হবে যে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ ও দুঃখ-বেদনা থাকবে না। একসময় রাষ্ট্রের প্রয়োজনই ফুরিয়ে যাবে। এ রকম একটা অবস্থানে যাওয়ার জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এত শক্তিশালী এবং কর্তৃত্ববাদী করা হলো যে সমাজে ত্রাহি ত্রাহিভাব এসে গেল। কমিউনিজমের সমালোচকেরা বলতে শুরু করলেন, ম্যান ডাজ নট লিভ অন ব্রেড অ্যালোন। শুধু ভাত খেয়ে জীবন চলে না। বাঁচার মতো বাঁচতে হলে চাই আরও অনেক কিছু-চাই শিক্ষা, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু।

একাত্তর সালে আমরা যখন নতুন একটা দেশ পেলাম, তখনো আমাদের সামনে স্পষ্ট কোনো রূপকল্প ছিল না। আমরা কী চাই না, তা জানতাম। আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে থাকতে চাইনি। তো সেটা ভেঙে বেরিয়ে এলাম। তারপর কী? ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডন থেকে ঢাকায় ফেরার পথে নয়াদিল্লিতে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতির সময় এক আবেগঘন ভাষায় নতুন রাষ্ট্রের কান্ডারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা।’ বাহাত্তরের ৬ ফেব্রুয়ারি এক সরকারি সফরে বঙ্গবন্ধু কলকাতায় যান। সেখানে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এক বিশাল জনসমাবেশে তিনি আরও একটি লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করলেন-জাতীয়তাবাদ। এই চারটি শব্দ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে আমাদের সংবিধানে লেখা হলো। ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা এই চার নীতিকে ‘মুজিববাদ’ বলে প্রচার করতে থাকলেন। এরপর অনেকগুলো দশক পেরিয়ে গেছে। ‘মুজিববাদের’ কথা এখন আর কেউ বলেন না। কিন্তু ‘গণতন্ত্র’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ দুটোই সংবিধানে বহাল আছে এবং আমরা দুটোই চাই। আমাদের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের একাডেমিক সদস্যরা সমাজতন্ত্রকে ধ্যান-জ্ঞান করে প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা তৈরি করলেন। ভূমিকায় তাঁরা লিখলেন, এর বাস্তবায়ন নির্ভর করবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ইচ্ছাশক্তির ওপর। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর তাঁরা আস্থা রাখতে পারেননি। পরিকল্পনার মেয়াদকাল অর্ধেক পুরো হওয়ার আগেই তাঁরা এক এক করে সরে গেলেন।

বাহাত্তর সালে ব্যক্তিগত বিনিয়োগের সিলিং ছিল ১৫ লাখ টাকা। পরে বঙ্গবন্ধুর সরকার এটা বাড়িয়ে করল ৩ কোটি। ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের পর খন্দকার মোশতাকের সরকার ব্যক্তিগত বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা বাড়িয়ে ১০ কোটি করল। পরে জিয়াউর রহমানের সরকার এসে এটা আরও বাড়াল। অর্থাৎ ধাপে ধাপে আমরা ব্যক্তিপুঁজির বিকাশের ধারায় হাঁটতে থাকলাম। একসময় আমরা পুরোপুরি পশ্চিমা ধাঁচের ধনবাদী ধারায় সমর্পিত হলাম। কিন্তু সংবিধানে ও স্লোগানে ‘সমাজতন্ত্র’ বহাল থাকল। অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় খাত থাকল। তবে এর অধীনে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান ছিল পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত সম্পত্তি। খাতটি বজায় থাকল মূলত অবাধ লুটপাটের জন্য। এখানে সমাজতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও ছিল না।

পঁচাত্তরে আমরা উর্দি শাসনের খপ্পরে পড়লাম। কোন পথে যাব, কোনটা নেব, কোনটা ফেলে দেব-এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমরা অনেকটা সময় পার করে দিলাম। তারপর রাজনীতিবিদেরা একসঙ্গে বসে ঠিক করলেন, আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রের মহাসড়কে চলব। ১৯৯১ সাল থেকে আমরা ওই রকম একটা সড়কে আছি। মাঝে ২০০৭-০৮, এই দুই বছরে এ দেশের রাজনীতি বড় একটা ধাক্কা খেলেও ২০০৯ থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রের লাইনচ্যুত গাড়িটা আবার মহাসড়কে গড়গড়িয়ে চলছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সবাই এটা মেনে নিয়েছেন।

সংসদীয় গণতন্ত্র কিংবা যেকোনো ধরনের প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার গঠিত হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। আমজনতা ব্যালট পেপারে কোনো একটা মার্কায় সিল দিয়ে তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।

আমাদের দেশে সরকার পরিচালনা করে রাজনৈতিক দল। কখনো এককভাবে, কখনোবা কয়েকটি দল মিলে যৌথভাবে। একবার নির্বাচিত হলে দলগুলো আজীবন ক্ষমতায় থেকে যেতে চায়। সে জন্য নির্বাচন নিয়ে নানা রকমের কারসাজি করে। যাঁরা বিরোধী দলে থাকেন, তাঁদেরও একমাত্র লক্ষ্য নির্বাচনে জেতা। সে জন্য তাঁরাও নানান কৌশল খাটান। এসব কৌশলের মারপ্যাঁচে নির্বাচন অনেক সময় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। জনমতের সত্যিকার প্রতিফলন নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় না। এ যেন মাত্রাতিরিক্ত ‘ফাউল’ করে ফুটবল ম্যাচ জেতা। ম্যাচে রেফারি অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকেন। অনেক সময় খেলোয়াড়দের হাতে তাঁকে উত্তম-মধ্যম খেতে হয়। এ দেশে নির্বাচনকালীন রেফারি হলো নির্বাচন কমিশন। অতীতে তারা নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। সঠিক ভূমিকাটি পালন করতে পারেনি। তাই নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থার ঘাটতি দেখা যায়।

সবকিছু ঠিকঠাকমতো চললে আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি শুরু হবে তিন মাস আগে থেকে। বলা চলে, নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হয়ে যাবে এ বছরের সেপ্টেম্বরে। সুতরাং হাতে সময় বেশি নেই। আগামী আট মাসের মধ্যে নির্বাচন কমিশন একটা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে পারবে কি না, তা-ই এখন দেখার বিষয়। ইতিমধ্যে বেশ কিছু শব্দ মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে, যেমন সব পক্ষের জন্য সমান মাঠ, নির্বাচনকালীন সরকার, সংলাপ, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন ইত্যাদি। জনমনে কিন্তু আশঙ্কা বাড়ছে দিন দিন-আসলেই আমরা একটা ভালো নির্বাচন পাব কি না। এখনো ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভূত আমাদের স্মৃতিকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।

জনমনে যে প্রশ্নগুলো আছে, মোটাদাগে সেগুলোকে এভাবে ভাগ করা যায়। ১. যথাসময়ে একটি ভালো নির্বাচন হবে। মূলধারার সব রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশ নেবে এবং নির্বাচন কমিশন তার কাজের জন্য ফুল মার্কস পাবে। ২. যে কারণে বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়নি, ঠিক একই কারণে তারা এবারও নির্বাচনে অংশ নিতে চাইবে না। মুখরক্ষার জন্য হলেও তারা কিছুটা দাবি আদায় করে একটা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নির্বাচনে যাবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে তাদের দর-কষাকষির প্রক্রিয়াটি হবে অতি দীর্ঘ ও জটিল। এ জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। ৩. বিএনপি নির্বাচনে আসবে না। সে ক্ষেত্রে নিয়ম রক্ষার জন্য হলেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করার মতো পরিস্থিতি না-ও থাকতে পারে। তারপরও যদি বিএনপি নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখতে না পারে, আওয়ামী লীগ সরকার একটা নির্বাচন করিয়ে তার ক্ষমতা আরও দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে। নির্বাচন কমিশন বলতে পারবে, আমাদের তো করার কিছু নেই। কেউ নির্বাচনে না এলে আমরা তো জোর খাটাতে পারি না। ৪. রাজনীতির দুই পরাশক্তি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যদি তাদের মধ্যকার মনস্তাত্ত্বিক পেশিশক্তির লড়াই এবং অন্যান্য কৌশলের মাধ্যমে এমন একটা যুযুধান অবস্থায় পৌঁছায় যে নির্বাচন কোনোভাবেই অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয় এবং কোনো পক্ষ কোনো ধরনের ছাড় দিতে রাজি নয়, তাহলে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে, তার পরিণতি কারও জন্যই মঙ্গলকর হবে না।

ওপরে যে চারটি দৃশ্যপটের উল্লেখ করলাম, তার যেকোনো একটি ঘটার সম্ভাবনা আছে। তারপরও কথা থাকে, আমজনতার ভূমিকা কী হবে। এ দেশে নাগরিক সংগঠনগুলো বেশির ভাগই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক। জনগণের মধ্যে তাদের ব্যাপক ভিত্তি বা গ্রহণযোগ্যতা নেই। থাকার কথাও নয়। তবে এটা ঠিক যে সময় ও সুযোগমতো তারাও দুই রাজনৈতিক পরাশক্তির পক্ষপুটে চলে যেতে পারে।

ইদানীং রাজনীতিবিদেরা তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যে ধরনের শব্দবাণ ব্যবহার করছেন, তার অনেকটাই ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। রাজনীতি থেকে সুবচন ক্রমেই নির্বাসনে যাচ্ছে। কলতলার ঝগড়া এখন সংবাদ সম্মেলনে কিংবা মঞ্চের বক্তৃতায় চলে এসেছে। আমরা এ ধরনের সংকটে এর আগেও অনেকবার পড়েছি। কিন্তু এবার মনে হয় দ্বন্দ্ব-সমন্বয়ের সব পথ একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। টেলিভিশনের টক শোতে আমরা প্রতিনিয়ত দুই দলের প্রতিনিধিদের ঝগড়া দেখছি ও শুনছি। কে ৩০ বছর আগে মুখ ভেংচে কী বলেছিল, কে ২৫ বছর আগে কাকে কী ভাষায় গালি দিয়েছিল-এসব নিয়ে তর্ক করতে করতেই আমরা বিজ্ঞাপন বিরতিতে ঢুকি এবং বিরক্ত হয়ে এক চ্যানেল বদলে অন্য চ্যানেলে চলে যাই। টক শোতে বক্তাদের চেহারা দেখলেই আমরা বুঝে ফেলি তিনি আজ কী অমিয় বাণী শোনাবেন।

একটা কথা বেশ জনপ্রিয় হয়েছে, ‘আমি আশাবাদী মানুষ।’ আমি কিন্তু দিন দিন হতাশাবাদী হয়ে পড়ছি। ভালো কিছু দেখছি না, শুনছি না। ঈশ্বর, আমাদের রক্ষা করুন।

পাদটীকা: শুক্রবার, ১৯ জানুয়ারি প্রথম আলোর শিল্পসাহিত্য পাতায় মাহবুব তালুকদারের একটা গল্প পড়লাম। গল্পের নাম, ‘তিনি মারা যেতে চেয়েছিলেন’। তিনি সুলেখক। পড়ে ভালো লেগেছে। গল্পের নায়ক আত্মহত্যা করতে চান, উপায় বের করতে পারছেন না। আমার মনে হলো, এটা একটা প্রতীকী গল্প। লেখক একজন নির্বাচন কমিশনার। তাঁর মনের কথা আমরা বুঝব কীভাবে?

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi [email protected]