পেশাজীবীদের আন্দোলনের বছর!

শিক্ষক ও শ্রমিক আন্দোলনে মুখর নতুন বছরের রাজপথ (ফাইল ছবি: প্রথম আলো)
শিক্ষক ও শ্রমিক আন্দোলনে মুখর নতুন বছরের রাজপথ (ফাইল ছবি: প্রথম আলো)

সরকারের আশ্বাসে শেষ পর্যন্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা তাঁদের ‘আমরণ অনশন’ কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এর ফলে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে যে অনিশ্চয়তা ছিল সেটি কেটে গেছে। অবশ্য এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের একাংশ আগে থেকেই এসএসসি পরীক্ষার্থীদের অসুবিধার কথা ভেবে আন্দোলন থেকে পরীক্ষার সময়টি বাদ রেখেছিল। তাঁরা ২৩ থেকে ২৭ জানুয়ারি পাঁচ দিন পূর্ণদিবস ক্লাস বর্জন কর্মসূচি শেষে ১৪ মার্চ ঢাকায় মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। তৃতীয় ধাপে জাতীয়করণ থেকে বাদ পড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা লাগাতর আন্দোলনে আছেন। তাঁদের আন্দোলন অবশ্য এসএসসি পরীক্ষায় কোনো প্রভাব ফেলবে না।

এদিকে চাকরি জাতীয় করণের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন কয়েক হাজার কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) । বর্তমানে ১৩ হাজার ৪৪২টি ক্লিনিক চালু আছে। প্রতিটি ক্লিনিকে দৈনিক ৩৫ থেকে ৪০ জন মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নেয়। সেই হিসাবে দৈনিক পাঁচ লাখের বেশি গ্রামীণ মানুষ এসব ক্লিনিকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এর আগে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকেরা তিন ধাপে আন্দোলন করেছিলেন। ডিসেম্বরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকেরা আমরা অনশন শুরু করলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে। প্রথমে সরকার প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবিদাওয়ার বিষয়টি আমলে নেয়নি। পরে যখন শিক্ষকেরা আমরণ অনশনের ঘোষণা দিলেন তখন সরকারের টনক নড়ল। দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের ইতি ঘটে। এরপর নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনশন শুরু করেন। তাঁদের দাবি, ২০১০ সালের পর যখন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত না করায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারী বেতন-ভাতা ছাড়াই শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে আসছেন। প্রথমে শিক্ষামন্ত্রী পর্যায়ক্রমে দাবি পূরণের আশ্বাস দিলেও শিক্ষকেরা আশ্বস্ত হননি। পরে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দাবি পূরণের কথা বলা হলে শিক্ষকেরা অনশন প্রত্যাহার করে বাড়ি বলে যান। নন-এমপিওভুক্ত মাদ্রাসার শিক্ষক ও কর্মচারীরা একই দাবিতে আন্দোলনে নামেন। কয়েক দিনের অনশনের মুখে সরকার তাঁদের দাবিও মেনে নেয়।

সরকারি প্রাথমিক কিংবা নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আন্দোলন থেকে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের আন্দোলনের ধরন অভিন্ন হলেও চরিত্রগত পার্থক্য আছে। সারা দেশে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। এ অবস্থায় সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি কতটা বাস্তবসম্মত, সেই প্রশ্ন উঠবেই। বর্তমান বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মূল বেতনের পুরোটা সরকারি কোষাগার থেকে দেওয়া হলেও তাঁদের বাড়িভাড়া ও চিকিৎসাভাতা হিসেবে যা দেওয়া হয়, তা খুবই সামান্য। সে ক্ষেত্রে বাড়িভাড়া ও চিকিৎসাভাতা বাড়ানোর দাবি যৌক্তিক। কিন্তু স্বল্প সময়ে সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা অসম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। শিক্ষকদের এই আন্দোলনের পেছনে সরকারের ভুল সিদ্ধান্তও অনেকাংশে দায়ী। সরকার প্রতিটি উপজেলায় একটি মাধ্যমিক ও একটি কলেজ সরকারি করার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু অনেক উপজেলায় রাজনৈতিক প্রভাবে ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে যেনতেন প্রকারে চালু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সরকারি করা হয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা সমান বেতন-ভাতার দাবি না করে কেন সরকারীকরণের দাবি করছেন, সেই প্রশ্নও করেছেন কেউ কেউ।

দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি করে শিক্ষার সর্বনাশ করা হয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। শিক্ষকেরা ন্যায্য বেতন-ভাতা পাবেন, তাঁদের চাকরির নিরাপত্তা থাকবে। কিন্তু সরকারি করণের নামে শিক্ষার কর্তৃত্ব সরকার কিংবা ক্ষমতাসীনদের হাতে ছেড়ে দেওয়া কাজের কথা নয়। বরং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের সম্পৃক্ত করতে পারলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা লাভবান হবে।

তবে যেই প্রশ্নটি সামনে এসেছে পেশাজীবীদের দাবি দাওয়া আদায়ের জন্য কেন আন্দোলন করতে হবে? কেন ঘরবাড়ি ছেড়ে শীতের রাতে তাঁদের ঢাকার ফুটপাতে অবস্থান নিতে হবে। নন এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা আন্দোলনকালে একটি প্লাকার্ডে লিখেছিলেন, ‘হয় দাবি মেনে নাও না হয় গুলি কর।’

আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি যে শিক্ষক বা অন্য পেশাজীবীরা যখন দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন-ধর্মঘট শুরু করেন, তখন সরকার বিষয়টি আমলেই নিতে চায় না। আন্দোলনের পেছনে নীতিনির্ধারকেরা সরকারবিরোধী তৎপরতার গন্ধ খোঁজেন। কিন্তু পেশাজীবীদের আন্দোলন চরম পর্যায়ে পৌঁছালে সরকার আলোচনার তোড়জোড় শুরু করে এবং একপর্যায়ে দাবিও মেনে নেয়। কিন্তু এরই মধ্যে যে ক্ষতি হয়ে গেছে সেটি পূরণের কোনো উপায় থাকে না। এই যে শিক্ষকদের লাগাতার কর্মসূচির কারণে শিক্ষা বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের ক্লাস বন্ধ থাকল তার দায় কে নেবে? শিক্ষকেরা জাতির বিবেক। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নির্মাতা। তাঁদের প্রতি একটি দায়িত্বশীল সরকার এতটা উদাসীন থাকে কীভাবে?

২০১৮ সালের শুরুর আলামত দেখে মনে হচ্ছে, নির্বাচনের বছরে পেশাজীবীদের আন্দোলন শুধু শিক্ষকদের মধ্যে সীমিত নেই। অন্যান্য পেশার মানুষও রাস্তায় নেমে আসছেন। তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের দাবির মুখে সরকার নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করেছে। শ্রমিক সংগঠনের নেতারা ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকার কম হলে চলবে না।

কয়েক দিন আগে খুলনার আটটি সরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকেরা আন্দোলন করেছিলেন বকেয়া বেতন-ভাতা আদায়ের দাবিতে। এটি খুলনার সুপরিচিত দৃশ্য। সরকারি পাট ও সুতাকলগুলো খোলা ও বন্ধ রাখার মহড়া চলে আসছে বহু বছর ধরে। সরকার মূলত লোকসানের দোহাই দিয়ে কারখানাগুলো বন্ধ রাখে। বিএনপি সরকার একই কারণ দেখিয়ে দেশের বৃহত্তম আদমজী পাটকলও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বেসরকারি পাটকলগুলো যদি লাভ করতে পারে, শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়মিত শোধ করতে পারে, সরকারি কারখানাগুলো কেন পারবে না? শিল্পকারখানা রাষ্ট্রের হাতে নেওয়ার উদ্দেশ্যই ছিল এর সুফল শ্রমিক-কর্মচারীসহ সবাই পাবেন। কিন্তু শুরু থেকে এসব কারখানা কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনলেও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নির্বাচনের বছরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো চাপ দিয়ে সরকারের কাছ থেকে কোনো দাবি দাওয়া আদায় করতে না পারলেও পেশাজীবীরা যে সুযোগটি পুরোপুরি নিতে চাইবে তার লক্ষণগুলো স্পষ্ট।

সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।