বিশ্ববাজারে তেলের দাম নিয়ে উদ্বেগ

গত ৩১ জানুয়ারির প্রথম আলোর খবর বলছে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ডিসেম্বর থেকে লোকসান দেওয়া শুরু করেছে এবং ইতিমধ্যে ২৫০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। এই সরকারি প্রতিষ্ঠান ২০১৪-১৫,২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ সালে যথাক্রমে ৪ হাজার ২০৮ কোটি, ৭ হাজার ৭৫৩ এবং ৪ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। বিপিসির মুনাফা হয়েছে উল্লিখিত সময়ে বিশ্ববাজারে কম দামে জ্বালানি তেল কিনে এনে দেশের বাজারে বেশি দমে বিক্রির সুবাদে। কয়েক বছর বিশ্ববাজারে তেলের দাম কম ছিল, কিন্তু ডিসেম্বর থেকে তা ঊর্ধ্বমুখী। পরিবর্তনশীল বাজারমূল্যে বিশ্ববাজার থেকে কিনে সরকার-নির্ধারিত মূল্যে স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেল বিক্রি করে বিপিসি আবার লোকসানে!

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছিলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম অচিরেই বাড়তে পারে। তেলের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে। আমদানি তেল ও তরল গ্যাস (এলএনজি) দিয়ে সিংহভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পক্ষে সরব নীতিনির্ধারকেরা বিকল্প প্রাথমিক জ্বালানির উৎস উন্নয়নে সামান্যই মনোযোগী। ফলে বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে কেবল বিপিসি লোকসানের মুখে পড়েনি; বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং তার অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোও বাড়তি লোকসানের ঝুঁকির মুখে রয়েছে।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম নিবিড়ভাবে আন্তসম্পর্কিত। তেলের দামের ওঠানামা অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। বরং দীর্ঘ সময় ধরে জ্বালানি তেলের ক্রমাগত মূল্যহ্রাস অনেকের মধ্যে ভ্রান্ত আশাবাদ তৈরি করেছিল যে তেলের দাম শিগগির বাড়বে না। বরং মূল্য সংশোধন হলেও তা ব্যারেলপ্রতি ৪০-৫০ মার্কিন ডলারের মধ্যেই ওঠানামা করবে। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর পেট্রোলিয়াম উৎপাদক দেশগুলোর জোট ‘ওপেক’ তেলের উৎপাদন সীমিত রাখার সিদ্ধান্ত জানানোর পর থেকেই জ্বালানি তেলের মূল্য ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে তেলের দাম কমতে শুরু করেছিল। ২০১৬ সালের মধ্য জানুয়ারিতে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেল প্রায় ২৮ মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়। এমন অবিশ্বাস্য দরপতন পূর্ববর্তী ১২ বছরেও ঘটেনি। সে সময় বিশ্ববাজারে তেলের সরবরাহ চাহিদাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব, যুক্তরাষ্ট্রে বিকল্প উৎস শেল থেকে তেল উৎপাদনে প্রাচুর্য, বড় তেল উৎপাদক ইরানের বিশ্ববাজারে প্রবেশ ইত্যাদি অনুঘটক সক্রিয় হয়ে উঠেছিল।

বিশ্লেষকদের অনেকেই বলতে শুরু করেছিলেন, তেলের বাজার নিকট ভবিষ্যতে খুব দ্রুত বাড়বে না। ওপেক ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে তেল উৎপাদন দিনে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন ব্যারেল হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তা কার্যকর করে। ওপেকের বাইরের তেল উৎপাদক দেশগুলোর সঙ্গেও ওপেক দ্রুত উৎপাদন কমানোর সমঝোতা করে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ওপেক গোষ্ঠীর নেতা সৌদি বাদশাহ সালমান সদলবলে ওপেকবহির্ভূত সবচেয়ে বড় তেল উৎপাদক রাশিয়ায় সরকারি সফরে (অক্টোবর ২০১৭) হাজির হন এবং ওপেক ও ওপেকের বাইরের তেল উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশগুলো নজিরবিহীন সমঝোতার মাধ্যমে তেলের উৎপাদন সীমিত করার চুক্তিকে দৃঢ় ভিত্তি দেয়।

বিশ্লেষকদের অনেকের বিশ্বাস, তেল উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশগুলোরও চেষ্টা রয়েছে তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ৪০-৫০ মার্কিন ডলারে সীমিত রাখা। তেলের বাজারমূল্য ৪০-৫০ মার্কিন ডলারের মধ্যে সীমিত থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের ‘শেল’ থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদন বা কানাডার ‘টার স্যান্ড’ থেকে তেল উৎপাদন অলাভজনক হয়ে পড়ে। একইভাবে, তেলের বাজারমূল্য বেশি বেড়ে গেলে বিকল্প প্রযুক্তি দ্রুত বাজারে আসতে পথ পায়। বিশেষত ইউরোপ ও চীনে বৈদ্যুতিক মোটরগাড়ি যেভাবে বাজার দখল করছে এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভর্তুকি সুবিধা পাচ্ছে, তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর তাতে শঙ্কা বাড়ছে। তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর ভেতরে যাঁরা ভাবতেন, জাতীয় সম্পদ মাটির নিচে রেখে দিলে ভবিষ্যতে তা কাজে লাগবে, তাঁরা এখন ক্রমেই চাপে পড়ছেন।

অনেকে মনে করেন, আপাতত তেলের বাজারমূল্য আছে, সুতরাং মাটির নিচে তেল ফেলে না রেখে তাকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে কাজে লাগানো হোক। মাটির নিচে রাখলে সেই সম্পদ গুরুত্বহীন হওয়ার হুমকিতে পড়তে পারে। এই মতের অনুসারীরা আরও মনে করেন যে তেল বিক্রির নগদ অর্থ রাষ্ট্রের হাতে থাকলে তা দিয়ে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, মানবসম্পদ উন্নয়ন করা সম্ভব। উপযুক্ত অবকাঠামো ও মানবসম্পদ পরবর্তী সময়ে দেশের জন্য বহু গুণ সম্পদ সৃষ্টি করতে পারবে। সম্প্রতি মার্কিন অর্থনীতির মন্দা কাটিয়ে ওঠার খবর আসছে, চীনের বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধিসহ বিশ্বব্যাপী ভোগ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের চাহিদা বাড়ছে। অপর দিকে, তেলের সরবরাহ দৃশ্যমানভাবে বাড়ছে না, বরং অন্যতম তেল রপ্তানিকারক ভেনেজুয়েলার তেল উৎপাদন কমেছে। অন্তত ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী থাকবে বলেই গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুমান। ফলে তেলের চাহিদা বাড়বে।

যে কারণেই হোক, বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের প্রতি ব্যারেলের মূল্য ৭০ মার্কিন ডলার ছুঁয়েছে। ২০১৮ সালজুড়ে কিছু ওঠানামা হলেও দাম ব্যারেলপ্রতি ৬০-৭০ মার্কিন ডলারের মধ্যেই থাকবে বলে বিনিয়োগ ব্যাংক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাক্কলন করছে।

বাংলাদেশ এ বছরের এপ্রিলে ৫০ কোটি ঘনফুটের সমান তরল গ্যাস (এলএনজি) এবং ডিসেম্বর নাগাদ আরও ৫০ কোটি ঘনফুট সমপরিমাণ তরল গ্যাস আমদানি করবে। প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ২০১৭ সালে বিপিসি প্রায় ৫৯ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করেছে, যার মধ্যে প্রায় ৪০ লাখ টন ডিজেল ও ৯ লাখ টন ফার্নেস অয়েল। প্রাথমিক জ্বালানির সরবরাহ উৎস বহুমুখী করার বিভিন্ন উদ্যোগের ঘোষণা এখনো ফলদায়ক হয়নি। দেশের প্রধান প্রাথমিক বাণিজ্যিক জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাসের নিশ্চিত মজুত দ্রুত কমছে, কিন্তু প্রত্যাশিত গতিতে অনুসন্ধানের কাজ এগোয়নি। জ্বালানি গ্যাস ও তেলের আমদানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে জ্বালানি ও বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে পণ্য ও সেবার মূল্য। দেশে মানুষের আয় বৃদ্ধি হলেও সিংহভাগ মানুষের আয় ও ভোগবৈষম্যও দ্রুত বাড়ছে। জ্বালানির দাম বাড়লে তাই মানুষের মধ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কা বাড়ে।

ড. মুশফিকুর রহমান খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক