ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

পাস করেছিল।

ওই আইনের ৫৭ ধারাসহ কয়েকটি ধারা যে কালাকানুন ছিল, তার সত্যতা বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক স্বীকার করেছেন। কিন্তু এটাই অপ্রিয় বাস্তবতা যে, ইতিমধ্যে প্রায় এক যুগ সময় কেটে গেছে এবং এই সময়ে বহু সংবাদকর্মী ও নাগরিক নানাভাবে ওই বিতর্কিত বিধিগুলোর কারণে খেসারত দিয়েছেন। এবং এটাই স্বাভাবিক যে, এ ধরনের বহু হয়রানির ঘটনা লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে গেছে। সেই ৫৭ ধারা বাতিল হয়েছে। কিন্তু নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, বিশেষ করে এর ৩২ ধারার ক্ষেত্রেও একই বিপদের আশঙ্কা করা হচ্ছে। নতুন আইনের সম্ভাব্য অপব্যবহারের বিষয়টি সরকারকে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।

 বিএনপি ২০০৬ সালে যখন ওই আইন পাস করেছিল, তখনো সাধারণ মানুষের জীবনে ইন্টারনেটের অভিঘাত ও ব্যবহার এতটা ব্যাপক ছিল না। সামনের দিনগুলোতে নিশ্চিতভাবেই ইন্টারনেট মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হবে। বিশ্বব্যাপী একান্ত গোপনীয়তার সংজ্ঞাও আজ ব্যাপকভাবে বদলে গেছে। রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের যে সামাজিক চুক্তি, তার ওপরও ডিজিটাল প্রযুক্তি বিরাট প্রভাব বয়ে এনেছে। সুতরাং প্রস্তাবিত ডিজিটাল আইনের যত বেশি অপব্যবহারের সুযোগ থাকবে, তত বেশি সাধারণ মানুষের জীবন ও অধিকারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সুতরাং আইনমন্ত্রী যেভাবে বিষয়টিকে কেবল গণমাধ্যমের উদ্বেগের বিষয় হিসেবে দেখছেন, তা যথাযথ নয়। সাংবাদিকদের পাশাপাশি নাগরিকের বাক্‌স্বাধীনতা, বিশেষ করে সুশাসন ও আমলাতন্ত্রের জবাবদিহির প্রশ্নটিও এর সঙ্গে বেশি জড়িত।

আমরা আশা করব, সম্পাদক পরিষদ তাদের বিবৃতিতে যেভাবে বিষয়টি নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার ওপর জোর দিয়েছে,
তাকে সরকার গুরুত্বের সঙ্গে নেবে। মিট দ্য প্রেসে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের আলোকে আমরা বলতে চাই যে, গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, তা আইনে পরিষ্কার রাখতে হবে। কোনো অপব্যবহার ঘটলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে সাংবাদিকের পাশে দাঁড়ানোর যে আশ্বাস দিয়েছেন, তাতে তাঁর যে সদিচ্ছা ফুটে উঠেছে, তাকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু আইনের ত্রুটি বা অপব্যবহারের সুযোগ রেখে দেওয়া হলে তার অপব্যবহার এতটা বেড়ে যেতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।

আইনমন্ত্রী যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, সাংবাদিকেরা জনস্বার্থে খবর লেখার জন্য গোপন তথ্য সংগ্রহ করবেন, তাঁরা বিদেশে পাচার করবেন না—এতে আমরা ধরে নিতে পারি যে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত করতে সরকার চায় না। কিন্তু এটা শুধু মুখে বললে হবে না। আমরা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, সাংবাদিকতার পরিচয়ে তথ্য সংগ্রহ করে তা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহারের কোনো উদ্বেগজনক প্রবণতা দেখা যায়নি। সুতরাং আকস্মিকভাবে গুপ্তচরবৃত্তি নিয়ে সরকারের এতটা উদ্বেগের কোনো সংগত ভিত্তি আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। ‘যিনি আপনাদের তথ্য দেবেন, তিনি ৩২ ধারার আওতায় পড়বেন না। কিন্তু গোপনীয়তা বজায় রাখতে ব্যর্থ কর্মকর্তা অভিযুক্ত হবেন’—আইনমন্ত্রীর এই মন্তব্য নির্মোহভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে। কারণ, প্রস্তাবিত আইন বলছে, নতুন আইন অতীতের অন্যান্য আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে। তার অর্থ দাঁড়াবে, ২০০৯ সালে তথ্য অধিকার আইন, যা এই সরকারের একটি মাইলফলক পদক্ষেপ, সেখানে যে অধিকার দেওয়া হয়েছে, তা ক্ষুণ্ন হবে।

 ভীতিকর একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা কোনো সরকারের জন্যই রক্ষাকবচ নয় বরং উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে। আমরা আশা করব, সরকার সেটা বিবেচনায় নিতে সক্ষম হবে।