'শনিবার রাতের কুরুক্ষেত্রের' অপেক্ষায়

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

প্রথমেই একবার ইতিহাসের পাতায় চোখ বোলানো যাক। শনিবার, ২০ অক্টোবর ১৯৭৩ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সন তাঁর অ্যাটর্নি জেনারেল এলিয়ট রিচার্ডসনকে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্তরত বিশেষ কৌঁসুলি আর্চিবাল্ড কক্সকে পদচ্যুত করার নির্দেশ দিলেন। তাঁর ভয় ছিল, কক্স এই কেলেঙ্কারির পেছনে তাঁর ভূমিকার প্রমাণ পেয়ে গেছেন। রিচার্ডসন সে নির্দেশ পালনের বদলে পদত্যাগ করলেন। নিক্সন তড়িঘড়ি করে কক্সের সহকারী উইলিয়াম রাকেলহাউসকে সে পদে নিয়োগ দিয়ে একই নির্দেশ দিলেন। রাকেলহাউসও সে কাজে অসম্মত হয়ে পদত্যাগ করলেন। তখন নিক্সন হাত বাড়ালেন বিশ্বস্ত সলিসিটর জেনারেল রবার্ট বর্কের দিকে। নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ পাওয়ামাত্রই বর্ক কক্সকে পদচ্যুত করার নির্দেশ নির্দ্বিধায় পালন করলেন। ইতিহাসে সেই শনিবারটি ‘স্যাটারডে নাইট ম্যাসাকার’ নামে পরিচিত। সেই কুরুক্ষেত্রের ফল নিক্সনের জন্য খুব লাভজনক হয়নি। বছর না ঘুরতেই অভিশংসনের হুমকি মাথায় নিয়ে তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। 

৪৫ বছর পর সেই রকম একটি ‘শনিবার রাতের কুরুক্ষেত্রের’ অপেক্ষায় রয়েছে আমেরিকা। যেকোনো সময় সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। অধিকাংশ নিরপেক্ষ বিশ্লেষকের ধারণা, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশেষ কৌঁসুলি রবার্ট ম্যুলারকে যেকোনো মূল্যে পদচ্যুত করতে চান। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার সঙ্গে তাঁর প্রচারাভিযান দল আঁতাতে লিপ্ত ছিল, ম্যুলার এই অভিযোগ তদন্ত করে দেখছেন। ট্রাম্পের আপত্তি সত্ত্বেও সাবেক এফবিআই-প্রধান ম্যুলারকে এই কাজের জন্য মনোনীত করেন তাঁরই মন্ত্রিসভার সদস্য অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশন্স। এরই মধ্যে নিজের কাজ অনেকটা গুছিয়ে এনেছেন ম্যুলার। ট্রাম্পের ক্যাম্পেইন সহকর্মী হিসেবে পরিচিত একাধিক ব্যক্তি আইনভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন, দুজন তাঁদের অপরাধ স্বীকার করে তদন্তে সহযোগিতায় সম্মতও হয়েছেন। এই আঁতাতে ট্রাম্পের নিজের কী ভূমিকা ছিল, সে প্রশ্নে ম্যুলার শিগগিরই খোদ প্রেসিডেন্টকেই জিজ্ঞাসাবাদ করবেন, এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। কিন্তু তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই ট্রাম্প তা শেষ করতে চান, আর সে জন্যই তাঁর প্রয়োজন ম্যুলারের মস্তক।
সম্ভব হলে ট্রাম্প আজ বলে বসতেন, ‘ইউ আর ফায়ারড’, যেমন তিনি নিজের রিয়েলিটি টিভি শো ‘অ্যাপ্রেন্টিস’-এ করে অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু কাজটা তত সহজ নয়, ম্যুলারকে পদচ্যুত করার আইনগত অধিকার দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের। রাশিয়া তদন্তে তাঁর ভূমিকা আছে, এই অভিযোগ ওঠায় ট্রাম্পের অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশন্স এই তদন্ত থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ম্যুলারের কাজে তদারকির ভার পড়েছে তাঁর (অর্থাৎ সেশন্সের) সহকারী রড রোজেনস্টাইনের ওপর। ট্রাম্প চাইলে রোজেনস্টাইনকে ম্যুলারের চাকরি খাওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন, কিন্তু তিনি সে নির্দেশ পালনে সম্মত হবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। সে কারণে ট্রাম্প রোজেনস্টাইনকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় এমন কাউকে চান যে রবার্ট বর্কের মতো বিনা আপত্তিতে তাঁর নির্দেশ মেনে চলবে।
‘নুনেস মেমো’ নামের বিতর্কিত একটি নথি তাঁকে এই কাজে সাহায্য করবে, এই বিশ্বাস থেকে ট্রাম্প ডেমোক্র্যাটদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও তা প্রকাশে সম্মতি দিয়েছেন। এই নথি অনুসারে, সরকারের বিচার বিভাগ, বিশেষ করে এফবিআই, দুর্নীতিগ্রস্ত ও রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট। ট্রাম্পের কথায়, এফবিআইয়ের অধিকাংশ সাধারণ কর্মচারী সৎ, কিন্তু বিচার বিভাগের শীর্ষ নেতৃত্ব জঘন্য, তাঁদের লজ্জিত হওয়া উচিত। এত দিন পর্যন্ত রিপাবলিকান দল নিজেকে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রবল সমর্থক হিসেবে দাবি করে এসেছে। কিন্তু রাশিয়া তদন্ত প্রশ্নে এই দল-এই দলের শীর্ষ নেতারা-সেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর কথায়, এমন ঘটনা আমেরিকার ইতিহাসে আগে ঘটেনি।
ট্রাম্প দাবি করেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে কোনো আঁতাতে তিনি বা তাঁর ক্যাম্পেইন জড়িত নয়। সে কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে এই তদন্ত নিয়ে তাঁর এত ভয় কেন? অধিকাংশ আইন বিশেষজ্ঞের ধারণা, আঁতাত হোক বা না হোক, এই বিচারপ্রক্রিয়ায় তিনি বাধা সৃষ্টি করেছেন, ম্যুলার এই অভিযোগ অনায়াসে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম। তাঁর হাতে ইতিমধ্যে এই ব্যাপারে পর্যাপ্ত রসদ রয়েছে। আর সেই ভয় থেকেই এই তদন্ত চূড়ান্ত হওয়ার আগেই ট্রাম্প তার বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে আমেরিকানদের মনে, বিশেষ করে তাঁর সমর্থকদের মনে, সন্দেহের বিষ ঢুকিয়ে দিতে চান। কাজটিতে তিনি আংশিক সফলও হয়েছেন। একটি নতুন জনমত জরিপ অনুসারে, রিপাবলিকান সমর্থকদের মধ্যে মাত্র ৪৮ শতাংশ এফবিআইয়ের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। এমনকি ডেমোক্র্যাটদের মধ্যেও ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে এমন লোকের সংখ্যা ৬৪ শতাংশ।
এফবিআইয়ের বিরুদ্ধে সমালোচনাযুদ্ধে নেমে ট্রাম্প ঠিক এই ফলাফলই আশা করেছিলেন। এফবিআই তথা বিচার বিভাগের ব্যাপারে যদি দেশের মানুষের মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে রোজেনস্টাইন বা ম্যুলারকে পদচ্যুত করলে তেমন কোনো প্রতিবাদ হবে না, ঠিক যেমন হয়েছিল নিক্সনের বেলায়। হয়তো একদম অমূলক নয় সেই ধারণা। নিক্সনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল মার্কিন কংগ্রেস। সে সময় প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট, কংগ্রেসের উভয় কক্ষই ছিল ডেমোক্র্যাটদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে অভিশংসনের প্রস্তাব গ্রহণে তাঁদের সমস্যা হয়নি। কিন্তু এখন অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
জন ম্যাককেইনের মতো দু-একজন ভিন্নমতাবলম্বী সিনেটর বাদ দিলে রিপাবলিকানদের মধ্যে খুব কম রাজনীতিকই এই মুহূর্তে ট্রাম্পের বিপক্ষে যেতে প্রস্তুত। বরং উল্টো, সম্পূর্ণ নীতিবহির্ভূত জেনেও তাঁরা নির্দ্বিধায় ট্রাম্পের প্রতিটি কাজের পাশে অবস্থান নিয়েছেন। নুনেস মেমো সে কথার বড় প্রমাণ। এফবিআইয়ের প্রধান ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করেছেন এই বিতর্কিত মেমো যেন প্রকাশিত না হয়। অন্ততপক্ষে একজন এফবিআই এজেন্ট বিচার বিভাগের কাজে এই হস্তক্ষেপে বিরক্ত হয়ে চাকরি ত্যাগের কথা ঘোষণা করেছেন। নির্ধারিত সময়ের আগেই অবসর গ্রহণের কথা ঘোষণা করেছেন এই সংস্থার উপপরিচালক এন্ড্রু ম্যাকাব। এসব প্রতিবাদ উপেক্ষা করেই মেমোটি প্রকাশিত হয়েছে। এসব দেখেশুনে খানিকটা হতাশ হয়েই ওয়াশিংটন পোস্ট মন্তব্য করেছে, রিপাবলিকান পার্টি এখন সত্যি সত্যি পুরোপুরি ট্রাম্পের দলে পরিণত হয়েছে।
অতএব, আগামী যেকোনো সময় যদি ‘শনিবার রাতের কুরুক্ষেত্রের’ পুনরাবৃত্তি ঘটে, তাহলে বিস্ময়ের কিছুই থাকবে না।
হাসান ফেরদৌস যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি