নিন্দিত হবেন, না সহানুভূতি পাবেন?

গুলশানের বাসভবন থেকে আদালতের পথে খালেদা জিয়া।  ছবি: সংগৃহীত
গুলশানের বাসভবন থেকে আদালতের পথে খালেদা জিয়া। ছবি: সংগৃহীত

সপ্তাহজুড়েই জনমনে ছিল টানটান উত্তেজনা। সবাই তাকিয়ে ছিলেন কী হবে ৮ ফেব্রুয়ারি। এ ধরনের হাই প্রোফাইল মামলা এক-এগারো-পরবর্তী সময়ে এই প্রথম, আর ‘গণতান্ত্রিক’ যুগে দ্বিতীয়। এর আগে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নিয়ে উত্তাপ ছড়িয়েছিল। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বাংলাদেশের তৃতীয় সরকারপ্রধান, যাঁকে আদালতে দণ্ডিত হয়ে কারাগারে যেতে হলো।
প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৭৬ সালে। ২৮ নভেম্বর উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বঙ্গভবনে যান। তাঁর সঙ্গী হলেন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সিজিএস আবুল মনজুর, নবম পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক মীর শওকত আলী, নৌবাহিনীর প্রধান এম এইচ খান এবং বিমানবাহিনীর প্রধান এ জি মাহমুদ। মধ্যরাতে বঙ্গভবনে সংঘটিত হলো একটি ক্যু। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের ডানা ছেঁটে দিয়ে জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের রাজদণ্ডটি নিজের হাতে নিয়ে নেন। ২৯ নভেম্বর সন্ধ্যা সাতটায় ঢাকা থেকে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একটি দল পাঠিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদকে তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসা হলো। তার ঠাঁই হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। দুর্নীতির এক মামলায় তাঁর পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। পরে উচ্চ আদালতে আপিল করে তিনি খালাস পেয়েছিলেন। অনেকের মতে, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণেই জিয়া মোশতাককে জেলে ঢুকিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৯১ সালে। পতিত রাষ্ট্রপতি এরশাদ ১২ জানুয়ারি অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগে গ্রেপ্তার হলেন। নিম্ন আদালতে তাঁর সাজাও হলো। এরপর আরও অনেক দুর্নীতির মামলা হলো তাঁর বিরুদ্ধে। দণ্ডিত হওয়ার কারণে ২০০১ সালের নির্বাচনে তাঁকে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। পাঁচ বছরের বেশি সময় তিনি নাজিরাবাজারের ওই জেলখানায় দিন কাটিয়েছেন। অবশ্য সারা জীবনই কারাবাস করার আশঙ্কা ছিল তাঁর। কিন্তু ‘মঞ্জুর হত্যা’ মামলাটি ঝুলিয়ে রেখে পরবর্তী সরকারগুলো তাঁকে দিয়ে বাঁদরনাচ নাচাচ্ছে। এখানে মামলার মেরিটের চেয়ে রাজনীতির মতলবই কাজ করেছে বেশি।
৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট-সংক্রান্ত মামলায় খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হলো। তাঁর কয়েকজন সহযোগীও সাজা পেয়েছেন, প্রত্যেকেই ১০ বছর করে।
রাজনীতির মঞ্চে নাটক দেখছি আমরা প্রতিনিয়ত। তবে ৮ ফেব্রুয়ারি যা হলো, তা এক অঙ্কের নাটক বা একাঙ্কিকা নয়। প্রথম অঙ্কটি মঞ্চস্থ হলো মাত্র। মামলাটি চলবে আরও অনেক দিন। আপিল হবে, উচ্চ আদালতে যাবে মামলাটি। শেষ কথাটি বলার সময় এখনো আসেনি।
গত কয়েক দিনে পত্রিকার পাতা আর টেলিভিশনের টক শো গরম করে রেখেছিল খালেদা জিয়ার এই মামলার সম্ভাব্য রায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়মিত ফাঁস হলেও এই মামলার রায় আগেভাগে ফাঁস হয়নি। কী রায় হবে, তা নিয়ে সন্দেহের দোলাচলে ছিলেন সবাই। বিএনপির নেতাদের মনে আশা যেমন ছিল, তেমনি আশঙ্কাও ছিল। বেগম জিয়া বলেছিলেন, ন্যায়বিচার হলে তিনি বেকসুর খালাস পাবেন। সরকারি দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরেই বলা হচ্ছিল, ‘খালেদা জিয়া এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন।’ বোঝা যায়, তাঁরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন।
এটা একটা ফৌজদারি মামলা হলেও এর রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক। আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা এখন জোর গলায় বিএনপিকে ‘চোরের দল’ বলতে পারবে। তাদের সুরে এরশাদ সাহেবও সুর মেলাবেন, সন্দেহ নেই।
বিএনপির নেতারা বরাবরই বলে আসছেন, এটা রাজনৈতিক মামলা। রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করা এবং নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্যই সরকার এই কৌশলটি নিয়েছে। বিএনপি আপাতত ব্যাকফুটে আছে।
নিম্ন আদালতের অনেক রায় উচ্চ আদালতে গিয়ে টেকে না। এ ধরনের উদাহরণ আছে অগুনতি। বিএনপির কেউ কেউ এমনও বলেছেন, পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে পরে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর অনেক আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের ওই সময়ের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ৯টি মামলা দায়ের করেছিল আইয়ুব খানের সামরিক সরকার। ৮টি মামলা খারিজ হয়ে যায়।
একটি মামলায় ঢাকার জেলা ও সেশন জজ আবদুল মওদুদ ১৯৬০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দেওয়া রায়ে দুর্নীতির দায়ে শেখ মুজিবকে দুই বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা হয়। তাঁর মামলা লড়েছিলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও শেখ মুজিবের রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৬১ সালের ২১ জুন শেখ মুজিব হাইকোর্টের রায়ে ওই মামলা থেকে মুক্ত হন (সূত্র: মহিউদ্দিন আহমদ, আওয়ামী লীগ: উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০, প্রথমা প্রকাশন)।
খালেদা জিয়ার মামলা প্রসঙ্গে শেষ কথাটি বলার সময় এখনো আসেনি। তবে এ দেশের রাজনীতিবিদদের বড় একটা অংশ যে দুর্নীতিতে ডুবে আছে, তা অস্বীকার করার জো নেই। খালেদা জিয়া যে তার ব্যতিক্রম এমন কথা জোর গলায় বলা যাবে কি? ট্রাস্টের টাকা নিজে আত্মসাৎ যদি নাও করে থাকেন, ক্ষমতার অপব্যবহার কি করেননি?
নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, এই মামলা নানাভাবে ঘটনাপ্রবাহ প্রভাবিত করবে। খালেদা জিয়া অপরাধী হিসেবে নিন্দিত হতে পারেন, অথবা রাজনীতির ভিকটিম হিসেবে সহানুভূতি পেতে পারেন। এটা নির্ভর করবে বিএনপি দল হিসেবে কীভাবে আচরণ করবে আগামী দিনগুলোতে, তার ওপর।
আমাদের স্মরণ থাকা দরকার, এক-এগারোর সরকার শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া—দুজনের বিরুদ্ধেই অনেক দুর্নীতির মামলা দায়ের করেছিল। তখনো বলতে শোনা গেছে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। এক-এগারো-পরবর্তী সময়ে দুজনই প্রবল প্রতাপে রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন, আগের চেয়ে আরও বেশি ক্ষমতা নিয়ে। আর কে না জানেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
[email protected]