জোর করে জেলে রাখলে জনগণ জবাব দেবে

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
খালেদা জিয়ার জেল, দলে নেতৃত্বের সংকট, নির্বাচনে অংশগ্রহণসহ নানা বিষয়ে প্রথম আলোর মুখোমুখি হয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর: দেখুন, বিএনপির জন্য এই অবস্থাটা নতুন নয়। জিয়াউর রহমান শাহাদতবরণের পর এর চেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছিল দল। তখন বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন একজন গৃহিণী। তাঁর নেতৃত্বেই কিন্তু ১৯৯১ ও ২০০১ সালে বিএনপি বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসে। এখনো সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ভোট পাবে জাতীয়তাবাদী শক্তি।

প্রথম আলো: কিন্তু তখনকার পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি তো এক নয়। তখন জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর মানুষের সহানুভূতি ছিল। এখন উনি জেলে, তারেক রহমান আইনের দৃষ্টিতে পলাতক এবং লন্ডনে। আরাফাত রহমান বেঁচে নেই।

মির্জা ফখরুল: আপনি জিয়া পরিবারকে আলাদাভাবে দেখছেন কেন? বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাজনীতিই হচ্ছে জিয়া পরিবারের রাজনীতি। জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী দর্শন এ দেশে তুমুল জনপ্রিয়, এ জন্যই তা টিকে আছে এবং টিকে থাকবে। সরকার বা অন্য কেউ যদি ধরে নেয়, জিয়া পরিবারের কেউ না থাকলে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি থাকবে না, তাহলে আমি বলব, তাঁরা বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন।

প্রথম আলো: বলা হচ্ছে, খালেদা জিয়ার কারাবাস দীর্ঘ হবে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় হলো, জিয়া চ্যারিটেবল মামলার রায় সামনে। এ ছাড়া ৩৫টি মামলা আছে তাঁর বিরুদ্ধে। তাই শিগগিরই তিনি ছাড়া পাচ্ছেন না। তিনি মুক্তি না পেলে শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচন করবে তো?

মির্জা ফখরুল: এ দেশে খালেদা জিয়ার জন্য আলাদা আইন হতে পারে না। এ ধরনের মামলায় জেলে রাখার সুযোগ নেই। আমরা ওনার জামিনের চেষ্টা করব, খুব শিগগির উনি জামিন পাবেনও। তারপরও ওনাকে জোর করে আটকে রাখার চেষ্টা করলে জনগণ তার জবাব দেবে। আর ওনাকে ছাড়া বিএনপি নির্বাচন করবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে।

প্রথম আলো: খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর বড় কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। যে আশঙ্কা বা আতঙ্ক ছিল, তা কেটে গেছে। এটা কি সাংগঠনিক দুর্বলতা, না কৌশল বা সিদ্ধান্ত?

মির্জা ফখরুল: গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে সব তথ্য প্রকাশ করতে পারে না। তারপরও যতটুকু প্রকাশ পেয়েছে, তাতে কিন্তু দেখা যায়, বৈরী পরিবেশের মধ্যেও হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছে। আমাদের নেতা-কর্মীদের তো এত দিন রাস্তায় নামতে দেওয়া হয়নি। রায় ঘোষণার আগে-পরে যেভাবে ঢাকা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে, যেভাবে রাস্তাঘাট র‍্যাব, পুলিশ, বিজিবি দিয়ে অবরুদ্ধ করা হয়, তার মধ্যেও অহিংস প্রতিক্রিয়া ছিল বিস্ময়কর। সরকার তো পরিকল্পনা করেছিল, কাউকেই মাঠে নামতে দেবে না। এ জন্য যুদ্ধাবস্থা ঘোষণা করেছিল।

প্রথম আলো: রায়ের আগে পুলিশের ওপর হামলা এবং রায়ের পর লন্ডন দূতাবাসে বিএনপির কর্মীদের হামলা কীভাবে দেখেন?

মির্জা ফখরুল: দেখুন, ঢাকায় পুলিশের ওপর হামলা বিএনপির কেউ করেনি। বিএনপিতে সরকারের অনুপ্রবেশকারীরা এটা করতে পারে। এখনকার এই পরিস্থিতিতে অনেকেই নানা রকম অ্যাজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে। আর লন্ডনে হামলার বিষয়টি আমার জানা নেই। নানা ব্যস্ততায় আমি খোঁজ নিতে পারিনি।

প্রথম আলো: আদালতে দণ্ডিত তারেক রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার যৌক্তিকতা কতটুকু?

মির্জা ফখরুল: রাজনৈতিক নেতাদের দণ্ড দেওয়া, জেলে পাঠানো—এ দেশে নতুন কিছু নয়। এ দেশের প্রায় সব বড় নেতাকে দুর্নীতি বা অন্য মামলায় জেল খাটতে হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের বিচারের মাপকাঠিও একটু ভিন্ন হয়। আর তারেক সাহেবকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়েছে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী।

প্রথম আলো: কিন্তু ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় তারেক রহমানের সম্পৃক্ততা বেরিয়ে এসেছে। অন্যগুলো রাজনৈতিক বললেও এটাকে কী বলবেন?

মির্জা ফখরুল: সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনভাবে তারেক রহমানকে জড়ানো হয়েছে। এই মামলায় তিনজন তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়েছে। সর্বশেষ একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই মামলায় মুফতি হান্নানকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছে। তারপরও আমাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী, হান্নান কিন্তু বলেননি তারেক রহমানের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে।

প্রথম আলো: বিএনপি এর আগে এত বড় নেতৃত্বের সংকটে পড়েনি। এবার উদ্ধার পাবে কীভাবে?

মির্জা ফখরুল: বিএনপির নেতৃত্ব নিঃশেষ করতে সরকার সব রকম চেষ্টা করছে। কিন্তু ব্যক্তি বা পরিবার না থাকলেও এই জাতীয়তাবাদী শক্তি কিন্তু থাকবে। এদের নির্মূল করতে পারবে না কেউই। এই শক্তির মধ্যেই নেতৃত্ব লুকিয়ে আছে।

প্রথম আলো: বিএনপিতে ভাঙনের সুর শোনা যাচ্ছে। বিএনপি কি ভেঙে যাবে? বারবার ক্ষমা করা হবে না—বিএনপির চেয়ারপারসনের এই বক্তব্য কি সেই ইঙ্গিত দেয়? দলের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে নিয়ে অবিশ্বাস আছে।

মির্জা ফখরুল: অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় দল এখন সুসংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত এত ঐক্য কখনোই ছিল না। সবাই বিভেদ ভুলে গেছে। আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি, বিএনপি ভাঙবে না, ঐক্য জোরদার হবে।

প্রথম আলো: আপনারা বলছেন, সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে আপনারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। সরকার বলেই দিয়েছে, সহায়ক সরকারের দাবি মানবে না। তাহলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত তো?

মির্জা ফখরুল: নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনেক সময় আছে। সরকার নির্বাচনী প্রচার শুরু করে আমাদের জেল, হামলা-মামলা দিয়ে ব্যস্ত রাখছে। লাখ লাখ নেতা-কর্মী এখন ঘরছাড়া। এই পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন চলবে।

প্রথম আলো: খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে ২০-দলীয় জোটে কে নেতৃত্ব দেবেন?

মির্জা ফখরুল: খুব শিগগির ২০-দলীয় জোটের বৈঠক ডাকা হবে। সাধারণত বড় দলের প্রধানই জোটের নেতৃত্ব দেন। ওই বৈঠকে আলাপ-আলোচনা করে জোটের নেতা ঠিক করা হবে।

প্রথম আলো: জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক কোন পর্যায়ে? জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় অনেকেই বিএনপির সঙ্গে আসতে চায় না।

মির্জা ফখরুল: আমরা তো গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছি। বিএনপির সঙ্গে না এলেও যার যার জায়গা থেকে বা যুগপৎভাবে অন্যরা এই আন্দোলন করতে পারে। জামায়াত, হেফাজত, খেলাফত—এদের সঙ্গে বিভিন্ন দলের বিভিন্ন সময় সুসম্পর্ক ছিল বা আছে। ৯ বছরের স্বৈরশাসকের সঙ্গে বর্তমান সরকারের বিস্ময়কর সম্পর্ক রয়েছে।

প্রথম আলো: খালেদা জিয়ার জেল হওয়ায় এইচ এম এরশাদ এবং তাঁর দলের কোনো কোনো নেতা বেজায় খুশি হয়েছেন।

মির্জা ফখরুল: এরশাদ সাহেব যে স্তরের রাজনীতিবিদ, তাতে এটাই স্বাভাবিক। আজও উনি আওয়ামী লীগের উচ্ছিষ্ট ভোগ করছেন। ওনার তো আত্মসম্মানবোধ নেই। এ দেশের মানুষ তাঁর কথা ও কাজ বিশ্বাস করে না।