আসমা জাহাঙ্গীরের বিদায়ে কমে গেলাম আমরা

আসমা জাহাঙ্গীর বেঁচে ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর হয়ে
আসমা জাহাঙ্গীর বেঁচে ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর হয়ে

উপমহাদেশের অগ্রণী মানবাধিকার নেত্রী আসমা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে পাকিস্তানের লাহোরেই বোধ হয় প্রথম দেখা। পাঞ্জাবের বিরল আর ধ্বংসাত্মক বন্যা নিয়ে কাজ করতে যাওয়ার আগে একবার করাচি যাওয়া হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। কুমিল্লা উন্নয়ন মডেলের পথিকৃৎ আখতার হামিদ খান তখন করাচির বস্তিতে বস্তিতে (অরঙ্গি) কাজ করছেন আর বাংলাদেশকে পলে পলে উপলব্ধি করছেন। কাজের পরিবেশ আর মানসিকতার তফাত নিয়ে কাতর হচ্ছেন। আলাপের একপর্যায়ে উপদেশ দিলেন, মালিক গোলাম জিলানির সঙ্গে, বিশেষ করে তাঁর বড় মেয়ে আসমা জিলানির (জাহাঙ্গীর) সঙ্গে কথা বলতে যোগাযোগ করতে। সে যাত্রায় সেটা হয়নি। টেলিফোন নম্বরটা খান সাহেব যত্ন করে লিখে দিয়েছিলেন।

পরে সেই ফোন খান সাহেবকেই করতে হয়েছিল আইনি সহযোগিতা জন্য। ১৯৯২ সালে অশীতিপর আখতার হামিদ খানকে যখন গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান সরকার। অপরাধ, তিনি শিশুদের জন্য বই লিখে মানুষকে উসকানি দিচ্ছেন। বলা বাহুল্য, শিশুদের জন্য তাঁর ‘শের আওর আহাম্মক’ গল্পে ধর্মকে বা ধর্মের অভিভাবকদের নিয়ে কোনো ব্যঙ্গ ছিল না। যাহোক কারাগার আর দণ্ডের খড়্‌গ এড়াতে তাঁকেও আইনি লড়াই লড়তে হয়েছে। সে লড়াইয়ে আসমা জাহাঙ্গীরকে তিনি পাশে পেয়েছিলেন।

আসমার প্রিয় চরিত্র ছিল মাওলানা ভাসানী। আমার মনে হয়, যখনই তাঁর কোনো বাঙালির সঙ্গে দেখা হয়েছে, তখনই কোনো না কোনোভাবে ভাসানী প্রসঙ্গ এসেছেই। কাগমারী সম্মেলন সম্পর্কে তাঁর বর্ণনা-বিশ্লেষণ আমাকে চমৎকৃত করেছে, মনে হয়েছে, তিনি যেন নিজেই উপস্থিত ছিলেন সেখানে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে প্রখ্যাত লেখক-শিক্ষাবিদ প্রশান্ত ত্রিপুরা একই অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, ‘ফেসবুকে একাধিক বন্ধুর পোস্ট থেকে আসমা জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর খবর জানলাম। তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। পাকিস্তানের এই প্রখ্যাত মানবাধিকারকর্মী ও একাত্তরে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে উজ্জ্বল ভূমিকা নেওয়া তাঁর বাবার কথা বাংলাদেশের অনেকেই জানেন, যেসব বিষয়ে নতুন করে বলার তেমন কিছু নেই আমার দিক থেকে। আমি শুধু ছোট একটি তথ্য যোগ করব ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে। দুই দশক আগে আসমা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচয় হয়েছিল আমার জার্মানিতে, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার মানবাধিকারকর্মীদের জন্য আয়োজিত একটা সফর চলছিল, যাতে কীভাবে যেন আমিও অংশ নিয়েছিলাম। তখন একদিন আড্ডার ফাঁকে আসমা জাহাঙ্গীর বলছিলেন মাওলানা ভাসানীর কথা, যাঁর সঙ্গে তাঁদের পরিবারের খুব সুসম্পর্ক ছিল। কোনো সন্দেহ নেই, এসব সম্পর্ক একটা ভিত্তি ছিল তাঁদের পরিবারের বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে দাঁড়ানোর। আমি জানি না, আসমা জাহাঙ্গীর কোথাও আড্ডায় দেওয়া তথ্য লিখিতভাবে প্রকাশ করেছেন কি না। করে থাকলে তা মাওলানা ভাসানীর মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে একটু ভিন্ন আলোয় জানতে সহায়ক হবে...।’

মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আসমা জাহাঙ্গীরের সাহসী উচ্চারণ, অবস্থান, সামরিক শাসনবিরোধী তাঁর পরিষ্কার বক্তব্য আমাদের সবার জানা। একসময় মনে হয়, সব সময় তিনি একাই লড়েছেন, শক্তভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে লড়েছেন। তবে দেশ বা পায়ের নিচের মাটি কোনোটাই ছাড়েননি; বাংলাদেশের ন্যায্য সংগ্রামে এমনকি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বাবার সঙ্গে আমরা তাঁকেও পেয়েছি পাশে। লাহোরের শাহি মসজিদের সামনে প্রতিদিনের বৈকালিক কবিতা পাঠের আসরে আসা এক অচেনা কবির বাইসাইকেলের পেছনে চড়ে কেবল বাঙালি পরিচয়ে তাঁর বাড়ির সামনে গিয়ে ফিরতে হয় না—সে এক বিরল অভিজ্ঞতা; তাঁর আপ্যায়ন, সময় দিয়ে কথা শোনা; ভোলা যায় না। কথায় কথায় চলে আসে উনসত্তরের কথা, শহীদ আসাদ, প্রফেসর জোহা—সবই তাঁর জানা। আসমা উনসত্তরেও পথে ছিলেন, পাঞ্জাবের গভর্নরের প্রাসাদ ঘেরাও করতে যাওয়া নারীদের মিছিলে কলেজছাত্রী আসমা ছিলেন সবার সামনে। সে মিছিলে গুলি চালিয়েছিল আইয়ুব শাহির পুলিশ, প্যারা মিলিটারি। আসমা বেঁচে যান অল্পের জন্য। আসমা বেঁচে ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর হয়ে, প্রসারিত হৃদয়ের মানুষ হয়ে। আমরা যদি সংকুচিত না হই, তাহলে আসমা জাহাঙ্গীর বেঁচে থাকবেন সবার মধ্যে—নইলে না।

তাঁর মৃত্যুতে উপমহাদেশ আরেকটু দুর্বল হলো, আমরা হলাম আরও বিচ্ছিন্ন!

গওহর নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণকর্মী এবং শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।