নাগরিক আন্দোলন ও আসমা জাহাঙ্গীর

আসমা জাহাঙ্গীর
আসমা জাহাঙ্গীর

১৯৬২ সালের ১ মার্চ সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নতুন একটি সংবিধান জারি করেন। সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তানে চালু হলো রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা। ইউনিয়ন কাউন্সিলের (এখন নাম ইউনিয়ন পরিষদ) ৮০ হাজার সদস্যের ভোটে ২৮ এপ্রিল জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। তখনো সামরিক আইন জারি থাকায় নির্বাচন হয়েছিল নির্দলীয় ভিত্তিতে। জাতীয় পরিষদে আসনসংখ্যা ছিল ১৫০। এ ছাড়া অতিরিক্ত ৬টি আসন ছিল নারীদের জন্য সংরক্ষিত। জাতীয় পরিষদে আইয়ুব খানের অনুগত ব্যক্তিরাই বেশি সংখ্যায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে ৮ জুন। ওই দিন সামরিক আইন তুলে নেওয়া হয়। প্রথম অধিবেশনে ফরিদপুরের মৌলভি তমিজুদ্দিন খান স্পিকার নির্বাচিত হন। বিধি মোতাবেক ১৯৫৮ সালের অক্টোবর থেকে জারি হওয়া সামরিক আইনের অধ্যাদেশগুলো জাতীয় পরিষদে পাস করিয়ে নিতে হবে। একপর্যায়ে আলোচ্যসূচিতে এল ১৯৬১ সালের ‘মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ’।

জাতীয় পরিষদে ‘নির্দলীয়’ হিসেবে নির্বাচিত ব্যক্তিরা বেশির ভাগই ছিলেন কোনো না কোনো দলের সদস্য বা সমর্থক। জামায়াতে ইসলামীরও সদস্য ছিলেন কয়েকজন। তাঁদের একজন হলেন বগুড়ার আব্বাস আলী খান।

নারী অধিকার তথা মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন ছিল একটি প্রগতিশীল আইন। অতীতের গণতান্ত্রিক সরকারগুলো এ ধরনের একটি প্রথাবিরোধী আইন পাস করার সাহস দেখাতে পারেনি। সাহসটি দেখালেন সামরিক একনায়ক আইয়ুব খান। জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) কয়েকজন সদস্য ছিলেন। তাঁরা প্রগতিশীল এই আইনের পক্ষে ছিলেন। আইয়ুবের সমর্থক মুসলিম লীগের সদস্যরা তো এই আইন পাসের জন্য ছিলেন একপায়ে খাড়া। কিন্তু বাদ সাধল জামায়াতে ইসলামী। তারা এই আইনকে ইসলামি শরিয়াহবিরোধী বলে প্রচার করল। জাতীয় পরিষদে এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়। এই বিতর্কে আব্বাস আলী খান প্রস্তাবিত আইনটির বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন।

পশ্চিম পাকিস্তানে রাওয়ালপিন্ডির ‘আইয়ুব হলে’ যখন পরিষদের বিতর্ক চলছিল, তার বাইরে পাঞ্জাবের নাগরিক সমাজের নারী প্রতিনিধিরা জড়ো হয়ে আইনটির পক্ষে স্লোগান দিচ্ছিলেন। পরিষদ ভবনের সামনে পুলিশের পাহারা ছিল। সমবেত নারী প্রতিনিধিরা ছিলেন বেশ মারমুখী। কিন্তু পুলিশ তাঁদের ওপর চড়াও হয়নি। তা ছাড়া তাঁরা তো আইয়ুব খানের জারি করা আইনের পক্ষেই আওয়াজ তুলেছিলেন। এ সময় একজন নারীনেত্রী পুলিশের প্রায় গায়ের ওপরে পড়ে আহ্বান জানালেন, ‘আব্বাস আলীকো হামারা পাস ছোড় দো’, অর্থাৎ আব্বাস আলীকে আমাদের কাছে তুলে দাও।

সমাবেশটি ছিল বেশ জঙ্গি। পুলিশ এই আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দিলে আব্বাস আলী খানের কী দশা হতো, তা সহজেই অনুমান করা যায়। ওই সময় ওখানে পেশাগত কাজে গিয়েছিলেন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তানের তরুণ রিপোর্টার আমানউল্লাহ। ঘটনাটি তাঁর কাছ থেকেই শোনা।

পাকিস্তানে মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিশেষ করে নারীর অবস্থা ক্রমাগত শোচনীয় হয়েছে এবং অবস্থান ঠেকেছে তলানিতে। কিন্তু এটা এক দিনে হয়নি। ১৯৬৪ সালে যখন আইয়ুববিরোধী কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি (কপ) তৈরি হয়, তার কর্মসূচির অন্যতম ছিল ১৯৬১ সালের এই আইনের সংশোধনের অঙ্গীকার। কপের নয় দফা দাবির আট নম্বর দফায় ছিল ‘কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশ অনুযায়ী সত্যিকার ইসলামি সমাজব্যবস্থা ও শরিয়তের সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে পারিবারিক আইন সংশোধন’। অপেক্ষাকৃত উদারপন্থী ও প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ জামায়াতের ওই দাবিকে মেনে নিয়েছিল শুধু ভোটের রাজনীতির জন্য। এ দেশের নারীরা বেঁচে গেছেন। কারণ, কপের প্রার্থী মিস ফাতেমা জিন্নাহ ভোটে আইয়ুব খানের কাছে হেরে গিয়েছিলেন।

ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে তুষ্ট করতে ১৯৭৫ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সরকার আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করেছিল। ১৯৭৭ সালে ভুট্টোর সরকারের পতন এবং জেনারেল জিয়াউল হকের সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের নারীসমাজের উল্টোযাত্রা শুরু হলো অন্ধকারের পথে। কিন্তু পাকিস্তানের নাগরিক সমাজ কখনোই এই অবস্থা মেনে নেয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠী বরাবরই পাকিস্তানে সামরিক শাসন, একনায়কতন্ত্র এবং মানবাধিকার হরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। ১৯৮০-র দশকে এসে আমরা দেখি ‘পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশন’ নামের একটি নাগরিক সংগঠন সামনের কাতারে থেকে নাগরিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এর সঙ্গে যে কয়েকজনের নাম জড়িয়ে আছে, তার একজন হলেন আইনজীবী আসমা জাহাঙ্গীর। অতিসম্প্রতি তিনি প্রয়াত হয়েছেন।

আসমা আমার কাছাকাছি বয়সের। তাঁর সঙ্গে প্রথম মানবাধিকার-সংক্রান্ত এক সম্মেলনে দেখা ১৯৮৯ সালের মে মাসে। বাংলাদেশে তখন মানবাধিকার সংগঠন বলতে ছিল মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা। ১৯৮০-র দশকের শুরুতে ঢাকার গণ-উন্নয়ন গ্রন্থাগারে আমরা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি চ্যাপ্টার প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। ব্যক্তিগত কোন্দলের কারণে এটি বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। ব্যাংকভিত্তিক একটি আঞ্চলিক সংগঠন ‘অ্যাকফোড’ আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিল মানবাধিকারবিষয়ক একটি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল তৈরি করার। আমি তার একটা খসড়া নিয়ে ব্যাংককে যাই। আমার সহযাত্রী ছিলেন ব্যারিস্টার রাবেয়া ভূঁইয়া।

পাঁচ দিনের ওই সম্মেলনে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলে ছিলেন আসমা জাহাঙ্গীর ও মুনীর মালিক। মুনীর মালিক পরে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি হিসেবে প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের সরকারের বিরুদ্ধে এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পক্ষে জোর লড়াই চালিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

ওই সম্মেলনে আমরা আলোচনা করে ঠিক করলাম, দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রায় একই রকম। সুতরাং আমাদের মধ্যে যোগাযোগ ও সংহতি থাকা দরকার, দরকার যূথবদ্ধ আন্দোলনের। আমরা যে কয়টা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তার মধ্যে ছিল একটি ‘এশিয়ান কোড অব কনডাক্ট অন মাল্টিন্যাশনালস ফর এশিয়ান গভর্নমেন্টস’ তৈরি এবং একটি ‘এশিয়ান হিউম্যান রাইটস এনজিও কমিশন অন্য দ্য ট্রাফিকিং অব উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন’ আহ্বান করা। ওই সময় আসমার সঙ্গে মানবাধিকার বিষয়ে মতবিনিময়ের সুযোগ হয়েছিল। এই ধারা অব্যাহত ছিল পরবর্তী বছরগুলোতেও।

১৯৯৮ সালে করাচিতে পাকিস্তান পিস কোয়ালিশন গঠনের পেছনে তিনি অনেক শ্রম দিয়েছেন। করাচির মেট্রোপল হোটেলের ওই সম্মেলনে আমিও উপস্থিত ছিলাম একমাত্র বাংলাদেশি প্রতিনিধি হিসেবে। আসমাকে দেখেছি ‘পাক-ইন্ডিয়া ফোরাম অন পিস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’, ‘পিপলস সার্ক’ এবং ‘ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরাম’-এর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।

পাকিস্তানের সামরিক ও আধা সামরিক সরকারগুলোর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মানবাধিকারের আলোর শিখাটি তিনি বয়ে বেড়িয়েছেন গত চার দশকের বেশি সময়। ওই মাপের প্রতিবাদী মানুষ এই অঞ্চলে আরেকজন খুঁজে পাওয়া কঠিন।

আসমা কখনোই নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেলেননি। ক্ষমতাসীন সব দলই তাঁকে অপছন্দ করেছে বা তাঁকে নিয়ে বিব্রত হয়েছে, কিন্তু নাগরিকদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ন্যায্যতা ও প্রতিবাদের প্রতীক। এই অঞ্চলে আমরা তাঁর অভাব অনুভব করব। তাঁর আত্মার শান্তি হোক।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]