'চলো পাল্টাই', না 'চলো পালাই'

ত্রিপুরা নির্বাচনে বিজেপির সরব উপস্থিতি
ত্রিপুরা নির্বাচনে বিজেপির সরব উপস্থিতি

ত্রিপুরাকে ভারত যতটা চেনে, হয়তো তার চেয়ে বেশি চেনে বাংলাদেশ। একটু ঝুঁকি নিয়েই বাক্যটা লিখলাম। কারণ, এত দিন পর্যন্ত ভারতের কাছে যে যে কারণে ত্রিপুরা ‘খবর’ হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে থাকত উপজাতিদের সঙ্গে বাঙালিদের সংঘর্ষ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও অপকর্ম কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয় অথবা দুর্ঘটনা। এসবের বাইরে দৈনন্দিন ভারতীয় প্রচারমাধ্যমে ত্রিপুরা ‘খবর’ হতো ভোটের সময়। ছোট্ট করে। কারণ, ত্রিপুরার ভোট সেই ১৯৭৮ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত নিতান্তই একপেশে। নিস্তরঙ্গ দিঘির মতো। ১৯৮৮ সালে সেই দিঘিতে ঢেউ তুলে ক্ষমতায় এসেছিল কংগ্রেস। কিন্তু তারপর থেকে ফের যে কে সেই।

সেই তুলনায় বাংলাদেশের কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম বা ঢাকা ঢের বেশি চেনে ত্রিপুরাকে। ত্রিপুরা তাদের অনেকের কাছে নিকটপ্রতিবেশী। সুখ-দুঃখের নিত্যসঙ্গী। প্রান্তিক সেই ত্রিপুরা, অবশিষ্ট ভারতের কাছে যা কিনা ঝাঁকের কইয়ের মতো নর্থ ইস্টের অঙ্গ, এই প্রথমবারের জন্য গোটা দেশের নজর কেড়েছে। যে রাজ্যটার বিধানসভার কেন্দ্র মাত্র ষাটটি, যে রাজ্য থেকে লোকসভায় যান মাত্র দুজন, যেখানে কে ক্ষমতায় এল বা না এল, তা নিয়ে জাতীয় স্তরে কোনো হেলদোল দেখা দেয়নি, সেই রাজ্যটার বিধানসভা নির্বাচনে গোটা দেশ তো বটেই, বিদেশি সাংবাদিকেরাও এবার ভিড় জমিয়েছেন! আজ রোববার ত্রিপুরায় নির্বাচন। ত্রিপুরার দিকে এভাবে দেশের দৃষ্টি ফেরাতে বাধ্য করেছে ভারতের শাসক দল বিজেপি। বছরের পর বছর পলাশের মতো লাল হয়ে থাকা ত্রিপুরায় গৈরিক পতাকা পতপত করে ওড়ানোর চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিজেপি হুংকার দিয়েছে, কংগ্রেসমুক্ত ভারতের মতো ত্রিপুরাকেও তারা এবার ‘বাম অপশাসনমুক্ত’ করে ছাড়বে। এই হুংকারে টগবগ করে ফুটছে ত্রিপুরা।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই উচ্চাশা (তাঁর কাছে ত্রিপুরাকে বামমুক্ত করার প্রতীকী ব্যঞ্জনার ব্যাপ্তি বিশাল) রাজ্যের বামবিরোধী শক্তিদের কাছে অনুঘটকের কাজ করেছে। ঐতিহাসিকভাবে এই রাজ্যের রাজনৈতিক শক্তি বলতে প্রধানত বাম ও কংগ্রেস। এই দুইয়ের বাইরে রয়েছে উপজাতিদের বিভিন্ন দল, যাদের অন্যতম ইন্ডিজেনাস পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা (আইপিএফটি)। এরা স্বাধীন ‘তুইপ্রাল্যান্ড’-এর স্বপ্নে বিভোর। বাম ও কংগ্রেস কেউই ওই দাবিকে কখনো আমল দেয়নি। কিন্তু উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত মোট ২০টি কেন্দ্রে (এগুলো বামপন্থীদের দুর্ভেদ্য দুর্গ) থাবা বসাতে বিজেপি এবার জোট বেঁধেছে আইপিএফটির সঙ্গে। এই সিদ্ধান্ত হিতকর হবে, নাকি হিতে বিপরীত, সেই বিতর্ক তীব্র। কারণ, সমতলের বাঙালিকে এই জোটের মধ্যে জুজু দেখাতে বামপন্থীদের চেষ্টায় ত্রুটি নেই। ফলে পাহাড় ও সমতল—দুই ক্ষেত্রে বিজেপিকে দেখাতে হচ্ছে এক চূড়ান্ত ভারসাম্যের খেলা।

এই রাজ্যটি দখল করতে বিজেপি এতটাই মরিয়া যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুই দফায় মোট চারটি জনসভা করলেন। সভাপতি অমিত শাহ বারবার ঘুরেফিরে এসেছেন। অরুণ জেটলি, রাজনাথ সিং, স্মৃতি ইরানি, নিতিন গড়কড়ি, বাবুল সুপ্রিয়, জয়প্রকাশ নাড্ডাদের মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা প্রচারে এসেছেন। সর্বানন্দ সোনোয়াল, যোগী আদিত্যনাথ, বীরেন সিং, পেমা খান্ডুর মতো মুখ্যমন্ত্রীদের বিজেপি হাজির করেছে। হেমা মালিনী, রূপা গাঙ্গুলি, লকেট চ্যাটার্জিদের গ্ল্যামার জোছনার মতো ছড়িয়ে দিয়েছে। নির্বাচনে টাকার বন্যা কী বস্তু, ত্রিপুরার আবালবৃদ্ধ জনতা এই প্রথমবারের মতো তা প্রত্যক্ষ করল। এত পতাকা, এত হোর্ডিং, এত গাড়ি, এত বিজ্ঞাপন, এত প্রচারক, এত বহিরাগত মানুষের জমায়েত, জনসভায় হিন্দি ভাষণের এত আধিক্য, এত রকমের গান, এমন রঙিন রোড শো, অসংখ্য বাইক আরোহীর এমন বর্ণাঢ্য মিছিল, সব মিলিয়ে এমন ঝলমলে ভোট, যেখানে খরচের কোনো মা-বাপ নেই, ত্রিপুরাবাসী আগে দেখেনি!

অথচ এই বিজেপি, মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারকে উৎখাত করার প্রতিজ্ঞা যাদের, গত ভোটে তারা পেয়েছিল মাত্র দেড় শতাংশ ভোট! বামদের একমাত্র প্রবল প্রতিপক্ষ কংগ্রেসকে (৪৭ শতাংশ ভোট) প্রায় পুরোপুরি ভাঙিয়ে তারা এখন স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসছে। দিল্লির সবকিছুই যেমন ধার করা, লোকবল সারা ভারত থেকে নেওয়া, আবহাওয়া পাহাড় ও মরুভূমির, ত্রিপুরায় বিজেপিও ঠিক তেমন। প্রার্থী ও সংগঠন প্রধানত কংগ্রেসের কাছ থেকে ধার করা। নেতৃত্ব সর্বভারতীয় বিজেপির। ত্রিপুরার নিজস্বতা বলতে উপজাতি সংগঠন। এই নিয়ে প্রধানত সিপিএমকে চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রয়োজন সাহস ও বিশ্বাস। বিজেপিকে সেই সাহস ও বিশ্বাসে ভর জুগিয়েছেন যিনি, সেই নরেন্দ্র মোদিই তাদের তুরুপের তাস। লড়াইটা তাই বাম বনাম বিজেপি নয়। আর সব জায়গার মতো এখানেও লড়াই মোদি ও মানিকে!

টান টান এই লড়াইয়ে কংগ্রেসের ভূমিকা ক্ষীণ। কিন্তু তাদের দিকেই তীর্থের কাকের মতো চেয়ে আছে সিপিএম ও বিজেপি। ’৭৮ সালে সবচেয়ে খারাপ সময়েও কংগ্রেস ১৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এমনিতে তাদের ভোট ৩৬ থেকে ৪৬ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। এবার একটি কেন্দ্রে না জিতলেও কংগ্রেস যদি প্রতি কেন্দ্রে এক-দেড় হাজার ভোট টানে, যদি ৬-৭ শতাংশও ভোট পায়, মানিক সরকারের হাসি তাহলে কান ছোঁবে। কংগ্রেস ভেঙে যার জন্ম, সেই তৃণমূল কংগ্রেসও শেষ বেলায় চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না। জাতীয় স্তরে মোদির বিরুদ্ধে সর্বগ্রাহ্য বিরোধী মুখ হয়ে ওঠার প্রবল তাগিদে মমতা ব্যানার্জি তাঁর সেরা যোদ্ধাদের শেষবেলায় রাজ্যে পাঠিয়েছেন। লক্ষ্য বামবিরোধী ভোট কাটা।

রাজ্যে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট মহারাজা প্রদ্যুৎ দেব বর্মন তাই নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, ‘রাজ্যে সিপিএমই আমাদের প্রতিপক্ষ। সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি। বিজেপিকে এবার রুখে দিতে পারলে আগামী দিনে কংগ্রেসই রাজ্যের ভবিষ্যৎ।’ পাহাড়ে বিজয় রাংখালের আইএনপিটির সঙ্গে কংগ্রেস তাই বোঝাপড়া করেছে। এই দলটা ত্রিপুরা ভাগের কথা বলে না। কংগ্রেসের লক্ষ্য পাহাড়ে বাম প্রাধান্য
জিইয়ে রেখে বিজেপিকে রোখা। বিজেপির কাছে কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসের পরিচয় তাই ‘কাটাও পার্টি’। বিজেপির বলিরেখা গভীর হওয়ার কারণও এই দুই দল।

সিপিএমকে হারাতে গেলে প্রবল হাওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজন শক্তিশালী সংগঠন। তিন বছর ধরে বিজেপি সেই কাজটাই করছে। দায়িত্ব যাঁকে দিয়েছে, সেই সুনীল দেওধর গত লোকসভা ভোটে বারানসিতে নরেন্দ্র মোদির নির্বাচন পরিচালনা করেছিলেন। সিপিএমের ধাঁচে সংঘের এই নেতা ব্লক স্তর থেকে গড়ে তুলেছেন সংগঠন। ব্লক, জেলা ও রাজ্যস্তরে যুব ও মহিলা মোর্চা গড়েছেন তফসিলি জাতি, উপজাতি, সংখ্যালঘু, অনগ্রসর ও কৃষকদের মধ্যে। ৬০ বিধানসভা কেন্দ্রের প্রতিটিতে বুথ পর্যায়ের ক্যাডার গড়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বুথে বুথে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে যাঁরা জনসম্পর্ক করবেন সেই ‘বিস্তারকেরা’, আর আছেন তাঁরা, যাঁদের কাজ দলীয় বিবাদ মেটানো। সুনীলের কল্যাণে বিজেপির ক্যাডারসংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের বেশি। ত্রিপুরার রাস্তাঘাটে নজরে পড়ে মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, গুজরাট, বিহার, ঝাড়খন্ডের মানুষজন, যাঁদের উত্তরীয়, টুপি, টি-শার্ট ও বাহনে বিজেপির পদ্ম জ্বলজ্বল করছে।

মানিক সরকারের কাছে অবশ্যই এটা মরণ-বাঁচনের লড়াই। এত কঠিন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা আগে তিনি করেননি। বিজেপির কাছেও এই ভোট গুরুত্বপূর্ণ। গুজরাট ও রাজস্থানে সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের পর ত্রিপুরা জিতলে অন্য বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু হেরে গেলে মোদি-ম্যাজিকের মায়াজাল যে মোহাবিষ্ট করতে ব্যর্থ, ছড়িয়ে যাবে সেই বার্তা। কর্ণাটক, মেঘালয়, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের জন্য তা মারাত্মক তো বটেই, ২০১৯-এর জন্যও তা হবে বিপজ্জনক।

মোদির স্লোগান ‘চলো পাল্টাই’। মানিকের কটাক্ষ, ‘ফল বেরোলে ওরা বলবে, চলো পালাই।’ ত্রিপুরাবাসী প্রবল দোটানায়। চেনা সিপিএম, না অচেনা বিজেপি, কাকে কোল পেতে দেবেন তাঁরা? প্রান্তিক ত্রিপুরা এই প্রথম নজর কেড়েছে গোটা দেশের।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি