শুধু বিএনপিই কি সংকটে?

নির্বাচনের বছরে দুর্নীতির মামলায় রাজনৈতিক মঞ্চের অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের শীর্ষ নেত্রীর কারাদণ্ড দেশের রাজনীতিতে যে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে, সে বিষয়ে বিশ্লেষকেরা মোটামুটি একমত। ক্ষমতাসীন জোটের প্রধান দল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অবশ্য বলেছেন, খালেদা জিয়ার সাজার কারণে জাতীয় রাজনীতিতে কোনো সংকট হয়নি; বরং বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংকট ঘনীভূত হলো। ক্ষমতাসীন দলের সব স্তরের নেতা-কর্মীদের নিত্যদিনের বক্তৃতার বিরাট অংশজুড়ে যখন থাকে শুধু বিএনপির সমালোচনা, সেখানে বিএনপির সংকট কীভাবে জাতীয় রাজনীতির সংকট নয়, সেই ব্যাখ্যা অবশ্য তিনি দেননি।

তবে সম্ভাব্য ব্যাখ্যা অনেকগুলোই হতে পারে। প্রথমত, দুর্নীতি, নাশকতা ও হত্যা মামলার চাপে নাজেহাল বিএনপির সামনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। ২০১৪ সালের বিনা ভোটের নির্বাচনে অংশ না নেওয়াকে তারা ভুল হিসেবে মেনে নিয়েছে, এমন ধারণা এ ক্ষেত্রে প্রবল। তা ছাড়া, পরপর দুবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে দলটি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন এবং দলীয় প্রতীক ধানের শীষও হারাতে পারে (স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণের কারণে সম্ভবত সেই ঝুঁকি কেটে গেছে)। তবে এটি সত্য যে দলটিকে যত চাপের মধ্যে রাখা যাবে, ততই তাদের নির্বাচনী কাজে মনোযোগ নষ্ট হবে। ফলে ভোটের প্রতিযোগিতায় তারা পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হবে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের মামলায় খালেদা জিয়ার আপিল নির্ভর করছে রায়ের সার্টিফায়েড কপি পাওয়ার ওপর। আপিল করলে কত দিনে তাঁর জামিন মিলবে, জামিন মিললেও নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন কি না-এই সবকিছুই প্রশ্নসাপেক্ষ। তাঁর দ্বিতীয় দুর্নীতির মামলা, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের শুনানিও শেষের দিকে এবং মাস দুয়েকের মধ্যেই সেটির রায় আসতে পারে। দ্বিতীয় আরেকটি দণ্ড হলে তখনো একই প্রক্রিয়ায় জামিন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্ন আসবে। অন্য মামলাগুলো বাদ দিলেও চার থেকে ছয় মাস নির্বাচনী প্রচারে এগিয়ে থাকবে আওয়ামী লীগ। সুতরাং সংকট তো অবশ্যই বিএনপির!

দ্বিতীয়ত, এমনটিও হতে পারে যে আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী দলগুলো মোটামুটিভাবে তাদের লক্ষ্য ঠিক করে ফেলেছে যে তারা ভবিষ্যতেও দশম সংসদের মতোই একটি সংসদ চায়, যেখানে কোনো বিরোধী দল থাকবে না। আইনমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন কেউ নির্বাচনে না এলেও আইন অনুযায়ী নির্বাচন হবে, সরকারের কিছু করার নেই। নিজেদের লোকেরাই, অর্থাৎ মন্ত্রিসভায় অংশ নেবেন এমন দল থেকেই কাউকে বিরোধীদলীয় নেতার আসন অলংকৃত করতে দেওয়া হবে। আর যদি কেউ বিরোধী দলের আসনে বসতে আগ্রহী না হয়, তাতেও অসুবিধা নেই। কার্যকর বিরোধী দলবিহীন পার্লামেন্টের অভিজ্ঞতা তো একেবারে নতুন নয়। তা ছাড়া, নজির আছে কম্বোডিয়ায়, যাদের সঙ্গে আবার সম্প্রতি আমাদের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে!

বিএনপির চেয়ারপারসনের বয়স এখন সত্তরের কোঠায়। ডজন তিনেক মামলা মোকাবিলা এবং একাধিক মামলায় সম্ভাব্য কারাবাসের ধাক্কা সামলে রাজনীতিতে তাঁর পুনরুত্থান সহজ নয়। আবার তাঁর একমাত্র জীবিত উত্তরাধিকারী তারেক রহমান ইতিমধ্যে একাধিক মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় তাঁর পক্ষে স্বাভাবিকভাবে দেশে ফিরে দলের হাল ধরা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং পরিবারতন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির ধারায় বিএনপির আয়ু আর বেশি দিনের নয়-এমন ধারণাও আওয়ামী লীগের অনেকের মধ্যে রয়েছে।

তৃতীয়ত, ক্ষমতার বাইরে ১২ বছর এবং নানা ধরনের মামলা-হামলায় জীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়া কিছু নেতা-কর্মীকে বিএনপি ভেঙে নতুন দল গঠনে উৎসাহিত করে বিকল্প গড়ে তোলা সম্ভব হলে খালেদা জিয়া নির্বাচনে না এলেও ক্ষতি নেই। বিএনপির খণ্ডিত অংশ নির্বাচনে এলেই সেই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক হিসেবে দেশে-বিদেশে সবার কাছে তুলে ধরা যাবে।

আরও একটি সম্ভাবনার কথা বলা যায়। তবে সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে ওপরের তিনটি সম্ভাব্য পরিস্থিতির বিপরীত চিত্রটি দেখে নেওয়া দরকার। প্রথমত, বিএনপির ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা ভুল ছিল-এমন ধারণা যথার্থ কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার। বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়া গত চার বছরে একবারের জন্যও এমন কথা বলেননি। আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গীরা ছাড়া অন্য কোনো দলই ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি এবং তা ছাড়া, শুধু বিএনপি কেন, সিপিবি, বিকল্পধারা, গণফোরাম, কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগ, বাসদসহ সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর কোনটি ওই নির্বাচন বয়কটকে ভুল বলে স্বীকার করেছে? বরং সরকার নিজেই বলেছে যে তারা ২০১৪ সালের পুনরাবৃত্তি চায় না।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদল, জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্রও যে সব দলের অংশগ্রহণের নির্বাচন চায়, বিএনপি বাদ পড়লে তা নিশ্চয়ই পূরণ হয় না? ভারত ২০১৪ সালের নির্বাচনকে এককভাবে বৈধতা দিলেও এবারে তারাও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছে। আরেকটি একতরফা নির্বাচন বাংলাদেশকে দো-আঁশলা গণতন্ত্র থেকে একটি গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্রের পর্যায়ে নামিয়ে নিতে পারে। সরকারের এই নাজুক অবস্থাকে কাজে লাগাতে বিএনপি কেন উৎসাহিত হবে না? নির্বাচনে তাদের লাভের চেয়ে যদি বিষয়টি শুধু সরকারকেই বৈধতা দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা হয়, তাহলে বিএনপি কেন সে পথে হাঁটবে? সুতরাং নিজেদের দাবিগুলোতে সন্তোষজনক ছাড় না পেলে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করাকেই তারা মন্দের ভালো ভাবতে পারে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ আওয়ামী লীগে অস্থিরতা তৈরির কৌশলও হতে পারে এবং সেই অস্থিরতাই বিএনপিকে নির্বাচন থেকে সরে যেতে গ্রহণযোগ্য কারণ জোগাতে পারে। যার আলামত হচ্ছে এতিমখানার মামলার অগ্রাধিকার এবং খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপির নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা।

বিএনপির নেতাদের কথায় আভাস মেলে যে তাঁরা অনেকেই বিশ্বাস ফিরে পেতে শুরু করেছেন যে খালেদা জিয়ার কারাবাসে মানুষের সহানুভূতির পাল্লা তাঁদের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। আন্দোলনে হিংসাত্মক পথ পরিহার সেই সহানুভূতিকে সংহত করারই কৌশল। এতে দলীয় নেতা-কর্মীরাও নতুন করে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন এবং সম্ভবত সে কারণেই সরকারের দমননীতির মধ্যেও অনেককেই আবার সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে। বিএনপির ক্ষেত্রে আরেকটি বিস্ময় হচ্ছে, গত এক যুগে দল ভাঙার কোনো চেষ্টাই কাজে আসেনি।

গত চার বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় বিএনপিকে দাঁড়াতে না দেওয়ার ফল হয়েছে আওয়ামী লীগে নিজেদের মধ্যে রক্তারক্তি। তবে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দলাদলির পুরোটাই হচ্ছে ভাগ-বাঁটোয়ারার লড়াই। জাতীয়ভাবে রাজনৈতিক ভিন্নমতের প্রতিনিধিত্ব যারা করে, বিএনপি এখনো তাদের মধ্যে প্রধান। বিএনপির রাজনীতিতে ধর্মের একটা ভূমিকা আছে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত এবং জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আছে, এমন অনেকের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে দলটি বহুল সমালোচিত। তবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে বিএনপির এই প্রাধান্য অনেকটাই খর্ব হয়েছে আওয়ামী লীগের পাল্টা ব্যবস্থায়। হেফাজতে ইসলামের মতো চরম রক্ষণশীল ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্য এখন নজিরবিহীন উচ্চতায়। হেফাজতে ইসলামের অনেকেই এখন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথাও ভাবছেন। বিএনপি এবং অন্য দলগুলো নির্বাচনে অংশ না নিলে এসব ইসলামপন্থী সেই শূন্যতা পূরণে উৎসাহী হতে পারে। সে রকম ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির উত্থানের সম্ভাবনা কি আদৌ নাকচ করে দেওয়া যায়?

ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে বিএনপির প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য লেনদেন নিয়ে আমাদের নাগরিক সমাজ সমালোচনায় যতটা সোচ্চার, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ধর্মীয় দলগুলোর বোঝাপড়ার বিষয়ে ঠিক ততটাই নীরব। কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি যে ক্ষমতাসীনদের আরও কর্তৃত্বপরায়ণ করে তুলছে, সেই আলোচনাও প্রায় অনুপস্থিত। খালেদা জিয়ার মামলার রায় বিএনপির সংকটকে ঘনীভূত করেছে ঠিকই, কিন্তু জাতীয় রাজনীতি মোটেও সংকটমুক্ত হয়নি। বিএনপিকে যেকোনোভাবে নির্বাচনে আনতে পারলেই সংকটমুক্তি ঘটবে, বিষয়টি এমনও নয়। গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার এবং আইনের শাসনসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ন্যূনতম বোঝাপড়ার প্রয়োজন হবে।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক