একুশের শিক্ষা

আমাদের ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে সীমিত ছিল না। এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে ছিল আমাদের স্বাধিকার ও আত্মপরিচয়ের প্রত্যয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। ১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করার পর পৃথিবীর প্রায় সব দেশ এই দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্‌যাপন করে থাকে মাতৃভাষার মর্যাদার স্মারক হিসেবে। ফলে একুশে ফেব্রুয়ারির মহিমা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের গৌরব ও আনন্দের বিষয়। কিন্তু সেই আনন্দ ম্লান হয়ে যায় যখন ইউনেসকোর তাগিদ সত্ত্বেও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিশ্ববাসীকে জানানোর কোনো উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে না নেওয়ার খবর পত্রিকায় আসে। এমনকি আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউট নামের যে প্রতিষ্ঠানটি ২০০১ সালে মহা ঢাকঢোল পিটিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, সেই প্রতিষ্ঠানটিও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। এটি দুর্ভাগ্যজনক।

ভাষা আন্দোলনের মর্মবাণী ছিল এর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন। ভাষা আন্দোলনের কয়েক বছরের মধ্যেই পাকিস্তান সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়। স্বাধীনতার পর থেকে এটি পালিত হয়ে আসছে জাতীয় শহীদ দিবস হিসেবে। কিন্তু ভাষাশহীদদের প্রধান যে অঙ্গীকার সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন, সেটি আমরা করতে পারিনি স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও। দেশে ৩০ শতাংশের মতো মানুষ এখনো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘কোন শিক্ষাকে স্থায়ী করিতে চাইলে, গভীর করিতে হইলে, ব্যাপক করিতে হইলে তাহাকে চিরপরিচিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়৷’ আমরা মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন করতে পারিনি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বাংলা চালু থাকলেও বাংলা এখনো উচ্চশিক্ষার বাহন হয়নি। বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রকৌশলসহ বহু বিষয়ে বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনা করা সম্ভব হয়নি। ফলে এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। অথচ জাপান, কোরিয়াসহ বহু দেশ মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষার সব দরজা খুলে দিয়েছে, যাদের লোকসংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম।

প্রতিবছরই একুশে ফেব্রুয়ারি সামনে রেখে আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রবর্তনের কথা বলি। নিরক্ষরতামুক্ত দেশ গড়ার কথা বলি। কিন্তু সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাস্তবায়নে এক কদম এগিয়েছি, সে কথা বলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে যাদের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত, তাদের নিষ্ক্রিয়তা বা অবিমৃশ্যকারিতা আমাদের পীড়িত ও ব্যথিত করে। অন্যদিকে সরকারি কাজকর্মে বাংলা চালু থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্য, উচ্চশিক্ষা, গবেষণাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ইংরেজি প্রাধান্য পেয়ে আসছে। বাংলায় আইন প্রণীত হলেও উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা চালু হয়নি। কয়েক বছর আগে উচ্চ আদালত বাংলা ভাষা ব্যবহারে শৃঙ্খলা আনতে একটি কমিটি করে দিলেও তার কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। যে দেশে ভাষার জন্য মানুষ জীবন দিয়েছে, সেই দেশে মাতৃভাষার অবমাননা অত্যন্ত লজ্জাকর।

যদি আমরা নিজেদের আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে দাবি করি, তাহলে শিক্ষা, সরকারি-বেসরকারি দপ্তরসহ সর্বস্তরের বাংলা ভাষা
প্রচলনে আমাদের একটি মহাপরিকল্পনা নেওয়া এবং দ্রুততম সময়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সেটিই হতে পারে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রেষ্ঠ উপায়। জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সবার মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক।