ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা

রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো যখন ক্রমাগত লোকসান দিয়ে আসছে, মূলধন জোগাতে সরকার জনগণের করের অর্থ ঢালছে, তখন লোকসানে পড়া অগ্রণী ব্যাংকের লাভের মুখ দেখা নিঃসন্দেহে সুসংবাদ। ২০১৬ সালে ব্যাংকটি যেখানে ৬৯৭ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছিল, ২০১৭ সালে সেটি কাটিয়ে উঠে ৮৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। কিন্তু একটি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের যৎসামান্য মুনাফা (উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে ব্যাংকটির মুনাফার পরিমাণ ছিল ৯০৫ কোটি টাকা) পুরো ব্যাংকিং খাতে যে ভয়াবহ অব্যবস্থাপনা, অস্থিরতা ও সংকট চলছে, তা কাটিয়ে উঠতে কতটা সহায়ক হবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। তারপরও অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কিঞ্চিৎ ধন্যবাদ পেতে পারে। নিষ্ঠা ও সততা থাকলে যে লোকসানি প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়া যায়, সেটি তারা প্রমাণ করেছে। প্রশ্ন হলো অগ্রণী ব্যাংক লাভ করতে পারলে অন্য তিন রাষ্ট্রীয় ব্যাংক কেন পারবে না? বেসরকারি ব্যাংকের বেলায়ও এ কথা প্রযোজ্য। যেসব ব্যাংক নিয়মনীতি মেনে চলছে, সেসব ব্যাংক মোটামুটি ভালো ব্যবসা করছে।

অগ্রণী ব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বেসরকারি ব্যাংক থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঞ্চয় তুলে নেওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রীর ‘হস্তক্ষেপ’ চেয়েছেন। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের (ফারমার্স ব্যাংক) তারল্য সংকটের কথা উল্লেখ করলেও ব্যাংকিং খাতের অন্যান্য সমস্যা ও সংকট সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। ব্যাংকিং খাতের বহুবিধ সমস্যা। রাতারাতি বেসরকারি ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটেছে। আগে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এক পরিবার থেকে দুজন পরিচালক থাকতে পারতেন আর এখন আইন করে সেটি চারজন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র আরও পাকাপোক্ত হয়েছে এবং নিশ্চিতভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক ঝুঁকি বেড়েছে। ফারমার্স ব্যাংকের সংকটের প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রথমে ঋণসীমা আগামী জুন মাসের মধ্যে কমাতে বলেছিল। পরে সেটি ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ইতিমধ্যে ব্যাংকগুলো তারল্য ঘাটতির অজুহাত দেখিয়ে ১-২ শতাংশ সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য।

দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকিং খাতে যে স্বেচ্ছাচারিতা চলছে এবং গুরুতর অনিয়ম ও বিচ্যুতিকে যেভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে, তা ব্যাংকিং খাতের সংকটকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। যখন সোনালী ব্যাংকে হল-মার্কের মতো কেলেঙ্কারি ঘটল, তখন বলা হলো ‘ও কিছু না’। শুরু থেকে যে বেসিক ব্যাংক ভালোভাবে চলে আসছিল, সেই বেসিক ব্যাংক লুটপাটের আখড়া বানানো হলো সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর আমলে। অথচ তিনি এত দিন ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। বিভিন্ন মহলের চাপ ও প্রতিবাদের মুখে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও শেষ পর্যন্ত তিনি বিচারের মুখোমুখি হবেন কি না, সেই সংশয় রয়েই গেছে।
এই প্রেক্ষাপটে শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত প্রত্যাহার না করার বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর ‘হস্তক্ষেপ’ ব্যাংকিং খাতকে সুরক্ষা দিতে পারবে বলে মনে হয় না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আমানতের ২৫ শতাংশ বেসরকারি এবং ৭৫ শতাংশ সরকারি ব্যাংকে জমা রাখতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা নেই। গ্রাহক তখনই একটি ব্যাংকে আমানত রাখবেন, যখন তিনি সেটি পুরোপুরি নিরাপদ মনে করবেন। তাই সরকারি প্রতিষ্ঠানে ‘হস্তক্ষেপ’ করার আগে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা আবশ্যক। যে দুষ্টচক্র ব্যাংকিং খাতকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিয়ে ব্যাংকিং খাতের সংকট দূর করা যাবে না। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ আরও জরুরি বলে মনে করি।