চিলমারীর বাঁধবাসী: উচ্ছেদই যখন আইন

পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ বেআইনি
পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ বেআইনি

১৯৮৮ সালের মহাপ্লাবনের পরেও যাঁরা জন্মেছেন, তাঁরাও বিলক্ষণ জানেন কী ভয়াবহ বন্যা ছিল সেটা। কমবেশি প্রায় ছয় সপ্তাহ ডুবেছিল সারা দেশ। বিমানবন্দর সেনানিবাস—কিছুই শুকনো ছিল না সেবার। তারপর অনেকগুলো দশক পেরিয়ে গেছে। ৮৮’র বন্যাকে স্মরণ করে রাখার জন্য সে সময় জন্ম নেওয়া শিশুর নাম অনেকেই বন্যা বা প্লাবন রেখেছিলেন। সেসব বন্যা আর প্লাবন নামের অনেকেই বড় বড় পাস দিয়ে এখন দেশে-বিদেশে কাজ করছেন। পরিবর্তন এসেছে জীবনযাপন, ব্যয়, ভোগ, উদ্‌যাপনের রীতিনীতিতে। এককথায় ৮৮’র বাংলাদেশ হারিয়ে গেছে। আমাদের উন্নয়ন আর উন্নতির জলে বদলেছে অনেক কিছু, শুধু বদলায়নি কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন নদীসংলগ্ন জনপদের প্রান্তিক মানুষদের ভাগ্য। এঁদের অনেকেই সেই ভয়াবহ বন্যায় আর এর পরের নদীভাঙনের শিকার হয়ে ভাসতে ভাসতে বিভিন্ন বাঁধে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। খেটে খাওয়া নিঃস্ব এসব মানুষের ঢাকায় চলে আসারও সাহস হয়নি।


গ্রামগঞ্জে-চরে খেটে, এনজিওদের কিস্তি টেনে কোনোমতে বেঁচে আছে তারা। এবার উন্নয়নের ঝাপটা তাদের এক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। বাঁধের ওপর সাজানো সংসার, মাচাভরা শিম, লাউ, গরু-ছাগল আর মুরগির বাক্স নিয়ে তাদের চলে যেতে বলেছে প্রশাসন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্তারা নোটিশও ঝুলিয়ে দিয়েছে। উচ্ছেদে কোথায় যাবে তারা? উন্নয়নের ছোবলে ছোবলে নীল হয়ে যাওয়া এসব মানুষের কাছে কোনো উত্তর নেই।

এর মধ্যেই গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ আরও চওড়া করার দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে এলজিইডি। তিস্তা নদীর হরিপুর চিলমারী অংশে তৈরি গার্ডার সেতুর সংযোগ সড়ক হবে বেড়িবাঁধ। তাই এই বেড়িবাঁধকে চওড়া করা দরকার। উন্নয়নের বাবুদের এই চিন্তার বলি হচ্ছে কালু দাস, গোপাল দাস, সুশীলা রাণী ও অনিল বর্মণদের দল। ছিন্নমূল এই জলদাসদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। দেশের আইনকানুন, ন্যায়-রীতিনীতি কোনোটাই এ রকম উচ্ছেদকে সমর্থন করে না। বিকল্প ব্যবস্থা বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে কোনো মানুষকেই তার ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা যায় না।

রাজধানীর জন্য এক আইন আর দূর গ্রামের নদীর বাঁকে কিংবা পরিত্যক্ত বাঁধের ওপর বসবাসকারীদের জন্য ভিন্ন আইন কিন্তু আমাদের সংবিধান অনুমোদন করে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উলিপুর অফিস গত ৭ জানুয়ারি প্রায় সাড়ে তিন হাজার পরিবারের নামে এক গণ-উচ্ছেদ নোটিশ জারি করে। চিলমারী উলিপুর এলাকার রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের ফকিরহাট থেকে রমনা ইউনিয়নের পাত্রখাতা এলাকা পর্যন্ত বিস্তর এলাকায় গত ৩০-৩৫ বছর যাবৎ এঁরা বসবাস করে আসছেন। উচ্ছেদ নোটিশে উচ্ছেদের কারণকে ‘যুক্তিপূর্ণ’ করার জন্য বসবাসকারীদের মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আপনি/আপনারা বাঁধের উপরিতল/স্লোপ কেটেছেন, যা অবৈধ/নিয়মবহির্ভূত। আপনার অবস্থানের কারণে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইত্যাদি ইত্যাদি...’ বাস্তব অবস্থা কিন্তু ভিন্ন।

যেখানে মানুষের বসবাস, সেখানেই বাঁধ বেশি মজবুত। মানুষ নিজেদের প্রয়োজনেই ভূমি রক্ষা সহায়ক নানা গাছগাছড়া, ঘাস, ঢোলকলমি ইত্যাদি লাগিয়ে থাকে ও বাঁধের যত্ন নেয়। ইঁদুরকে গর্ত খুঁড়তে দেয় না। ছোটখাটো বর্ষানালি বা রেনকাট নিজেদের গরজেই মেরামত করে। গত বছরের বন্যায় (২০১৭) বিভিন্ন জায়গার বাঁধের ভাঙনের জন্য ইঁদুরকে দায়ী করা হয়েছিল; দায়ী করা হয়েছিল বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণে লোকবলের অভাবকে। আদতে বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তেমন অর্থ বরাদ্দ থাকে না আজকাল। বসবাসকারী মানুষ বিনা পয়সায় এ কাজটা করতে পারে। বানভাসি মানুষদের সঙ্গে বাঁধের দায়িত্ব ও ভোগদখলের একটা নিয়মনীতি তৈরির সময় এসেছে। প্রায় দশক দুই আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড ভোলার চরফ্যাশনের জনগণ ও স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করে এ রকমের একটি বাঁধ তৈরি করেছিল। মানুষ বাঁধের ওপর বসতের অধিকার আর বাঁধ রক্ষার দায়িত্ব নেওয়ায় সে বাঁধ আজও টিকে আছে। বাঁধের ওপর ফলবান গাছগাছালি আর কলা-পেঁপে চাষ মানুষকে যেমন আয়ের পথ দেখিয়েছে, তেমনি শূন্য রক্ষণাবেক্ষণ খরচে সে বাঁধ দাঁড়িয়ে আছে। এ উদাহরণ অন্যত্র অনুসরণে বাধা কোথায়? মানুষের সম্পদ মানুষকে দিয়েই পাহারা দিতে হবে। এটা কোটালদের কাজ নয়। কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় যে চোর-পুলিশ খেলা চলছে, তা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত। পুনর্বাসন বা বিকল্প ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত এসব অসহায় নারী-পুরুষ-শিশুকেľসমূলে উচ্ছেদ অন্যায়। এ রকম অন্যায্য, অবিবেচনাপ্রসূত ও বিবেকহীন উদ্যোগের বিরুদ্ধে কম‌পক্ষে পাঁচটি রায় আছে আদালতের। আইন ও সালিশ কেন্দ্র বনাম সরকার (১৯ বিএলডি পৃ: ৪৮৮), মধুমালা বনাম সরকার (৫৩ ডিএলআর পৃ: ৫৪০), ব্লাস্ট বনাম সরকার (বিএলসি পৃ: ৩৮৪) এবং কামাল বনাম সরকার (২১ বিএলডি পৃ: ৪৪৬)—এগুলোর বয়ান পাওয়া যাবে। প্রয়োজনে আদালতের কড়া নাড়াতে হবে। উচ্ছেদের আগে পুনর্বাসনের আওয়াজ তুলতে হবে।

গওহার নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকর্মী। শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।