দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশ

বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) দুর্নীতির যে ধারণা সূচক প্রকাশ করেছে, তাতে আশাপ্রদ হওয়ার মতো কিছু নেই। যদিও এবার বাংলাদেশ সূচকে দুই ধাপ এগিয়ে আছে। গত বছর ছিল নিচের দিক থেকে ১৫ তম, এবার ১৭ তম। দুর্নীতির সূচকের এই ওঠা-নামা দুদিক থেকেই দেখা যায়। দুর্নীতির সূচকে পরপর চারবার চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ ১৫ বা ১৭ নম্বরে আসা কিছুটা অগ্রগতি বটে। কিন্তু এই ধারায় অগ্রগতি হতে থাকলে দুর্নীতিমুক্ত সূচকের কাছাকাছি মানে যেতে কয়েক দশক লেগে যাবে। মনে রাখা দরকার, দুর্নীতির সূচকে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে আমাদের অবস্থান এখনো লজ্জাজনকভাবে পেছনের দিকে। তালিকার ওপরের দিক থেকে ধরলে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৪৩ তম। আর দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। এ অঞ্চলের ছয়টি দেশ যথাক্রমে-ভুটান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ এমনকি পাকিস্তানও বাংলাদেশের ওপরে। একমাত্র আফগানিস্তানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমরা প্রথম দাবি করতে পারি।
সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে হওয়ার কারণ হিসেবে যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে আছে বড় বড় দুর্নীতির ঘটনার বিচার না হওয়া, প্রতিশ্রুতি পূরণ না করা, অর্থ পাচার, খেলাপি ঋণ, ভূমি-নদীর অবৈধ দখল, বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বেড়ে যাওয়া, দুদকের কার্যকারিতা ও স্বাধীনতার ঘাটতি এবং জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা। এ ছাড়া আইনের শাসনের ঘাটতি এবং গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ার কথাও বলেছে তারা।
তবে বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশে ডিজিটালাইজেশন, আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতিকাঠামো তুলনামূলকভাবে শক্ত হওয়ায় সূচকে তার কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। একসময়ের নিষ্ক্রিয় ও নখদন্তহীন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সক্রিয়তাও চোখে পড়ার মতো। তবে টিআই যখন দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করছে, তখনো আমরা দেখছি ব্যাংকিং খাতে একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটছে। সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দুর্নীতির বিচারকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের শূন্যসহিষ্ণুতা বলে দাবি করতে পারে। কিন্তু জনগণ যখন দেখবে দুই কোটি টাকার দুর্নীতির বিচার হলেও হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিবাজেরা বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন না, তখন সেই দাবি হাস্যকর হয়ে পড়ে।
পৃথিবীর যেসব দেশ দুর্নীতি কমাতে পেরেছে, সেসব দেশে ক্ষমতাসীনদের কেউ দুর্নীতি করে পার পায়নি। উদাহরণ হিসেবে জাপান, চীন এমনকি ভারতের কথাও উল্লেখ করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানকে বাদ দিয়ে শুধু অতীতের দুর্নীতি নিয়েই টানাটানি করা হয়। অতীতে কেউ দুর্নীতি করলে অবশ্যই তার বিচার হবে। সেই সঙ্গে বর্তমানের দুর্নীতিবাজদের বিচারের মুখোমুখি করতে না পারলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অরণ্যে রোদনে পরিণত হবে। দুর্নীতি কমাতে হলে কে ক্ষমতায় আছে, কে বিরোধী দলে-সেটি বিচার না করে সব দুর্নীতিবাজকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
টিআই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেছে। দুর্নীতি ও আইনের শাসনের ঘাটতির সঙ্গে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ার যোগসূত্র আছে। এটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা হলেও বাংলাদেশে মারাত্মক রূপ নিয়েছে। অনেক সময় নীতিনির্ধারকেরা ভাবেন সত্য আড়াল করেই দুর্নীতি কমানো ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সত্য যত বেশি চেপে রাখা হবে, সমাজে দুর্নীতি তত বাড়বে। জবাবদিহি কমবে। আর আইনের শাসনও হয়ে পড়বে নড়বড়ে।
তাই দুর্নীতির সূচকে দুই ধাপ অগ্রগতি নিয়ে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। আমাদের যেতে হবে আরও বহুদূর।