এ এক বিস্ময়কর আবিষ্কার

প্রথম আলো: আপনি তো সুন্দরবনের দুটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান দেখলেন। দেখে কী মনে হলো?

সুফি মোস্তাফিজুর রহমান: আমাদের দৃষ্টিতে সুন্দরবন মানুষের কাছে একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল। মনে করা হয়, সুন্দরবন এলাকায় মানববসতি সাম্প্রতিক সময়ের। কিন্তু এখানকার ভূমি কতটা প্রাচীন, তা সুনিশ্চিতভাবে এখনো বলা যায়নি। এ নিয়ে নানা মত আছে। এখানে যে প্রাচীন মানববসতি থাকতে পারে, এমন ভাবনা করা হয়নি। এ নিয়ে তেমন কোনো কাজও হয়নি। সম্প্রতি আমরা এসব প্রত্নস্থানের কথা শুনেছি। তা দেখার জন্য আমরা সুন্দরবনের বেশ কয়েকটি স্থানেও গেলাম। যা দেখলাম, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। এ এক বিস্ময়কর আবিষ্কার। খেজুরদানা এলাকায় আমরা ইটের তৈরি বেশ কিছু অবকাঠামো দেখেছি। সেসব ইটের আয়তনও বোঝার চেষ্টা করলাম। ইটের বিস্তৃতি ৭০০ থেকে ৮০০ মিটার। আমরা যেতে পেরেছি মাত্র দুটি স্থানে। এমন আরও কয়েকটি জায়গা আছে বলে শুনেছি। এগুলো সুন্দরবন এলাকায় বড় ধরনের বসতির ইঙ্গিত দেয়।
বসতির ধরন এখনই সুনির্দিষ্টভাবে বোঝা না গেলেও এটা পরিষ্কার যে এখানে বড় ধরনের বসতি ছিল। বসতিগুলো অবশ্যই পাল আমলের। এ ধরনের বসতি ওই সময়ে ওই এলাকায় সমৃদ্ধির পরিচয় বহন করছে। এই মাপের ইট অবশ্যই ১০০০ থেকে ১২০০ বছর আগে ব্যবহৃত হতো। বাংলাদেশে এ ধরনের ইটের ব্যবহার শুরু হয়েছিল ৭০০ থেকে ৮০০ বছর আগে। ১৩ শতকে সর্বশেষ এ ধরনের ইট ব্যবহৃত হয়েছে। গুপ্ত আমল অর্থাৎ ৩২০ থেকে ৫৫০ খ্রিষ্টাব্দেও ওই বসতিটি গড়ে উঠে থাকতে পারে। তবে এ নিয়ে আরও গবেষণা দরকার। আপেক্ষিক তারিখ নির্ণয় পদ্ধতিতে যদি দেখি, তাহলে ওই স্থাপনাগুলো ১০০০-১২০০ বছর আগের। দেড় হাজার বছর আগেরও হতে পারে।
এ ধরনের বসতি জোয়ার-ভাটা এলাকায় গড়ে ওঠার কথা নয়। কেননা, ওই এলাকাটি এখন জোয়ারে ডুবে যায়, ভাটায় এর একাংশ ভেসে ওঠে। এ ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশে এ-জাতীয় স্থাপনা গড়ে উঠলেও তার পক্ষে এত দিন টিকে থাকা সম্ভব নয়। এই স্থাপনাগুলোর গড়ে ওঠা প্রমাণ করছে, সমুদ্র এখান থেকে আরও দূরে ছিল। ১০০০ বছর আগে এখানে জোয়ার-ভাটা ছিল না। বসতির প্রকৃতি ও সমুদ্রের অবস্থান বোঝার জন্য আরও গবেষণা দরকার। তবে এখন পর্যন্ত যা পেয়েছি, তা বাংলাদেশে বসতির ইতিহাসে একটি নতুন সংযোজন। বাংলাদেশের ইতিহাস যে হাজার বছর আগে কত সমৃদ্ধ ছিল, এর মধ্য দিয়ে তা আমরা জানতে পারলাম। আমরা ময়নামতি, পাহাড়পুর ও মহাস্থানগড় আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে যেমন বাংলাদেশের ইতিহাসের নতুন দিক সম্পর্কে জানতে পেরেছি, সুন্দরবনের আবিষ্কারটিও তেমনি নতুন একটি ধারার সূচনা করল।
এই সভ্যতা সম্পর্কে এর আগে অনেকে নানা ধরনের তথ্য আমাদের দিয়েছিলেন। কিন্তু এভাবে বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে কেউ কখনো বলেননি। এখানে ইসমে আজম আমাদের সামনে বিজ্ঞানসম্মত কিছু অকাট্য আবিষ্কার তুলে ধরেছেন। এসব আমাদের সুন্দরবন ও বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মানববসতির ইতিহাস নতুন করে লেখার উৎস জোগান দিল।

প্রথম আলো: এখানে আমরা বসতির চিহ্ন পেলাম। এই বসতি কারা গড়ে তুলল? তারা কী করত? কেন তারা হারিয়ে গেল? এসব বিষয়ে কোনো প্রাথমিক ধারণা কি আমরা করতে পারি?

সুফি মোস্তাফিজ: সুন্দরবন অঞ্চল সম্পর্কে জনপ্রিয় ইতিহাসের যেসব বই ও বয়ান আমরা পাই তাতে বলা হয়, সেখানে মোগল আমলে কিছু বসতি ছিল; লবণ চাষ হতো। পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা এখানে আসতেন লবণ আমদানি করতে। যাঁরা লবণ তৈরি করতেন, তাঁরা অবশ্যই স্থানীয় কেউ ছিলেন। কিন্তু এর আগের ইতিহাস আমাদের জানা নেই। তা আমাদের খুঁজতে হবে। এখানে এসে আমরা যা দেখলাম, তাতে মনে হচ্ছে এখানকার মানুষেরাই সেই লবণ প্রস্তুত করতেন। লবণকেন্দ্রিক বসতি ও বাণিজ্যের সঙ্গে এখানকার মানুষেরা যুক্ত থাকতে পারেন। অনেক স্থাপনা দেখে মনে হয়েছে, অনেকটা বৌদ্ধস্তুপার (বৌদ্ধদের প্রার্থনাস্থল) মতো। তবে এগুলো নিয়ে আরও কাজ করতে হবে।
এখানকার বসতিগুলোর প্রকৃতি কী ছিল, তা জানতে পারলে আমরা বলতে পারব, তারা কত দিন এখানে টিকে ছিল। তার ওপর নির্ভর করে বলা যাবে কেন তা ধ্বংস হয়ে গেল। আমরা দেখেছি, কোথাও নদী বা সমুদ্র থাকলে এবং সেখানে অনুকূল পরিবেশ থাকলে সেখানে সভ্যতা গড়ে ওঠে। ভালো উৎপাদনব্যবস্থা ও প্রশাসন থাকলে সেটি টিকে থাকে। আবার প্রকৃতি বিরূপ হলে তা আবার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। নদী দূরে সরে গেলে, মহামারি হলে, নিজেদের কোনো দুর্বলতা দেখা দিলে বা কোনো বহিঃশত্রুর আক্রমণের মুখে পড়লে জনপদ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
৭৫০ থেকে ১২০০ সালে আমাদের এখানে বৌদ্ধসভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। সুন্দরবনের এই স্থাপনাগুলো বৌদ্ধসভ্যতার নিদর্শন হয়ে থাকলে বৌদ্ধশাসনের অবসানের পর, ১৩০০ সালের পর তা আর টিকে থাকার কথা নয়। কেননা, এরপর তো তা আর শাসকদের সমর্থন পাবে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এটি ধ্বংস হলো, তা জানার জন্য আমাদের আরও গবেষণা করে দেখতে হবে।

সুফি মোস্তাফিজুর রহমান
সুফি মোস্তাফিজুর রহমান

প্রথম আলো: বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, সমুদ্র ছিল এখান থেকে বেশ দূরে। এ ছাড়া এলাকাটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণও। অতীতেও পরিবেশের নানা পরিবর্তন ঘটে থাকতে পারে। সেগুলোর কোনো প্রভাবও কি ওই বসতির ওপরে পড়ে থাকতে পারে?

সুফি মোস্তাফিজ: পরিবেশ এখনো মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে। প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা থেকে অতীতের পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার মতো গবেষণা আমাদের দেশে এখনো তৈরি হয়নি। আমরা উয়ারী-বটেশ্বরে এ বিষয়ে চেষ্টা করছি। সুন্দরবনের এই আবিষ্কার আমাদের এ বিষয়ে আরেকটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল।

প্রথম আলো: সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে এই আবিষ্কারের গুরুত্ব কী বলে মনে করেন?

সুফি মোস্তাফিজ: সুন্দরবনের ভেতরে যে মানববসতির এত প্রাচীন ইতিহাস লুকিয়ে ছিল, তা আমরা হয়তো কখনো জানতামই না। ইসমে আজম বাঘ গণনা করতে গিয়ে প্রাচীন মানববসতির এই নিদর্শনগুলো আবিষ্কার করেছেন। পরে নিজেই পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতো অনুসন্ধান চালিয়ে গেছেন। আমাদের মতো পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিকের চোখে এত দিন তা ধরা পড়েনি। যদিও এ ধরনের স্থাপনা খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমাদেরই।
সুন্দরবনের মতো জোয়ার-ভাটা ও কাদামাটির অরণ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খুঁজে বের করার বিষয়টি উন্নত দেশগুলোতে মেরিন আর্কিওলজি নামে পরিচিত। এর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা দরকার। তাতে জাহাজ লাগে। সামুদ্রিক এলাকায় দীর্ঘদিন থেকে কাজ করতে হয়। পানির নিচে তলিয়ে থাকা ভূমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা স্থাপনা খুঁজে বের করার প্রয়োজন পড়ে। এর বৈশিষ্ট্য বোঝা খুবই কঠিন। ইসমে আজম একা একা বহু কষ্ট করে এই কাজগুলো করেছেন।
প্রথম আলোর সৌজন্যে আমরা যে সুন্দরবনে গেলাম, তাতেই বুঝতে পেরেছি কাজটি কত কঠিন। সুন্দরবনে যাওয়ার পথে নৌকার ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেল। ভাটায় আমাদের নৌকা সমুদ্রের দিকে ভেসে যাচ্ছিল। সমুদ্রে ভেসে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা ছিল। আমাদের পুরো দলটি সমুদ্রে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে পারতাম। কাউকে খবর দেব, তারও সুযোগ ছিল না। সেখানে তো মোবাইল ফোনের সংযোগ বা কোনো নৌযান নেই। এক দিন কাজ করতে গিয়েই আমরা এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ে গেলাম। অন্য প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকার সঙ্গে এর পার্থক্য হচ্ছে এখানে জীবন বাজি রেখে কাজ করতে হয়। ইসমে আজম এই বনে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খুঁজে বেরিয়েছেন। অনেক কিছুর সন্ধান আমাদের দিয়েছেন। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সুন্দরবনে হাজার বছরের পুরোনো বসতির নিদর্শন আবিষ্কারের মূল ব্যক্তি হিসেবে ইসমে আজমের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।