বাঙালির জনসভার উপাখ্যান

জনসভার লোকসমাগম নয়, এর উদ্দেশ্যই বিবেচ্য
জনসভার লোকসমাগম নয়, এর উদ্দেশ্যই বিবেচ্য

বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় ৭ মার্চের জনসভার চতুর্সীমানায় কোনো বাস-ট্রাক ছিল না। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসেছিল হেঁটে। দেশের ভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন দলমতের মানুষ এসেছিল। তাদের কাউকেই আওয়ামী লীগের নেতারা ধরে-বেঁধে টি-শার্ট, টুপি উপহার দিয়ে, হাত খরচার টাকা দিয়ে, বাসে-ট্রাকে চড়িয়ে আনেননি। কাচ্চি বিরিয়ানি, তেহারির প্যাকেট তো দূরের কথা, স্রেফ চাল-ডাল দিয়ে রান্না করা খিচুড়ির ব্যবস্থাও ছিল না। জনসভায় আসা ক্যাডারদের মিছিল থেকে কোনো তরুণীর গায়ে হাত দেওয়া তো অকল্পনীয়।

জননেতার জনসভায় শুধু কি দলের কর্মী-ক্যাডাররাই আসবেন? একাত্তরের মার্চে তা দেখিনি। বামপন্থী শ্রমিকনেতা কাজী জাফর আহমদের নিয়ন্ত্রণে ছিল গাজীপুরের টঙ্গীর শিল্পাঞ্চল। ১৯৬৯-৭০-এ তাঁর কয়েকটি শ্রমিক সমাবেশে টঙ্গী গিয়েছিলাম গত শুক্রবার প্রয়াত সাংবাদিক সৈয়দ মাহমুদ ও অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ডা. সাইফ-উদ-দাহারের সঙ্গে। কাজী জাফরের নির্দেশে সেখানকার শ্রমিকেরা জীবন দিতে পারতেন। তিনি ছিলেন ভাসানীপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও শ্রমিক সংগঠনের নেতা। তাঁর সংগঠনের শ্রমিকেরা তাঁর সম্মতি নিয়েই কাজ ফেলে ৭ মার্চ রেসকোর্সে এসেছিলেন কয়েক হাজার। এসেছিলেন হেঁটে, বাস-ট্রাকে নয়। সেই দীর্ঘ হাঁটায় বীরত্ব ছিল না, ছিল অঙ্গীকার ও প্রত্যয়। দেশের মুক্তি।

একাত্তর শব্দটি উচ্চারিত হওয়ামাত্র এখন শুধু বীরত্ব ও নির্যাতনের কথাই শুনি, কিন্তু একাত্তরে আরও বহু বিষয় ছিল, যা আজকের প্রজন্মের অনেকেরই অজানা। আজ সরকারি-আধা সরকারি অফিসগুলো ভরে গেছে বৃদ্ধ বীরে অথবা বীরের পুত্র-কন্যাদের দ্বারা। সত্যিকারের বীরত্বের পরিচয় যাঁরা দিয়েছিলেন, তাঁরা আজ বিপন্ন বোধ করেন।

কোটি কোটি টাকা খরচ করে খুব একটা বিশাল জনসভা করাই জাতীয় জীবনের বড় ব্যাপার নয়। জনসভার উদ্দেশ্য কী এবং তা থেকে মানুষের প্রাপ্তি কী, সেটাই বিবেচ্য। বড় জনসভায় নিজস্ব কোনো গুণ বা ক্ষমতা নেই। আসল ব্যাপার, সেই সভার প্রভাব জাতীয় জীবনে কতটা গভীর।

৭ মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিজ কানে শোনার সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছে, তাঁরা ইতিহাসের সাক্ষী। সেই জনসভার স্মৃতি আমাদের বয়সী অনেকের মধ্যে আজও অম্লান। আর যদি একদিনও ওই ভাষণ রেডিও-টেলিভিশনে না বাজানো হতো, তাহলেও আমাদের স্মৃতিতে আমৃত্যু জাগরূক থাকবে। জনগণের সমর্থনে বহু নেতার ভেতর থেকে একজন নেতা তৈরি হন। অন্যদিকে নেতা জনগণের মন গঠনে ভূমিকা রাখেন। যখন জনগণ ও নেতা একাত্ম হয়ে যান, তখনই কোনো লক্ষ্য অর্জিত হয়। একাত্তরে তা-ই হয়েছিল।

দেশপ্রেম এমন এক আবেগ, যার জন্য মানুষ যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে দ্বিধা করে না। দেশপ্রেমের পরীক্ষা হয় দু-একবার জাতির সংকটের সময়। আমাদের দেশপ্রেম অবশ্য মাত্রার দিক থেকে বিশ্বের যেকোনো জাতির চেয়ে বেশি। তার প্রমাণ প্রতিদিন পাওয়া যায়। বেইলি রোডে অফিসার্স ক্লাবে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। এক বৈঠক খানা হয়ে যাওয়ার পর টেবিলে বসে গল্পস্বল্প হচ্ছিল। আমন্ত্রণকর্তা এসে সবিনয়ে বললেন, বিরিয়ানির চালটা পাকিস্তানি বাসমতী। এক ভদ্রলোক তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে দাঁত খিলাল করছিলেন। পাশে তাঁর স্ত্রী মুখে পান পুরে চিবোচ্ছিলেন। আমন্ত্রণকারীর কথা শুনে ভদ্রলোক আঁতকে উঠলেন। বললেন, আগে কস নাই, পাকিস্তানি বাসমতী হইলে তো আমি খাইতামই না। আমি বললাম, খেয়ে যখন ফেলেইছেন, এখন উগলে দিলেও প্রায়শ্চিত্ত হবে না। দখলদার বাহিনীর বর্বর অত্যাচারের শিকার হয়েছে কোরিয়া ও ভিয়েতনামের মানুষ।

কয়েক দিন আগে ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট এসে ঘুরে গেলেন বাংলাদেশ। তাঁর দেশে ৩০ বছরব্যাপী ফরাসি-মার্কিন বর্বরতা পৃথিবীর ইতিহাসের অংশ। নিহত ৩০ লাখ। আমেরিকা বোমায় পুড়িয়ে দিয়েছে দেশটির গ্রামের পর গ্রাম। ১৯৭৫-এ যেদিন আমেরিকার পরাজয় ঘটে এবং মুক্তি পায় ভিয়েতনামের মানুষ, সেদিনের কথা আমার মনে আছে। এএফপি-রয়টার সায়গন (হো চি মিন সিটি) থেকে প্রতিবেদন পাঠাচ্ছিল। মার্কিন সামরিক-বেসামরিক নাগরিকদের বাড়িঘরে ও অফিসে ব্যবহৃত আসবাব প্রভৃতি বিলাসদ্রব্য ভিয়েতনামের মুক্তিসেনারা রাস্তায় এনে নষ্ট করে ফেলে দেন। তাঁরা ওসব ব্যবহার করবেন না। যুদ্ধের পরে অবশ্য আমেরিকাই ভিয়েতনামের ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় পার্টনার। একই কাজ করেছে জার্মানি ও জাপান। ষোলোই ডিসেম্বরের পর আমাদের চোখ গিয়ে পড়ে অবাঙালিদের বাড়ি-গাড়ি এবং মোহাম্মদপুর-মিরপুর-তেজগাঁওয়ের প্লটের ওপর।

আমরা ভেতরটাকে খালি করে দিয়ে বাইরের আয়োজন আড়ম্বরকে বড় করে তুলেছি। বড় বড় অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশ নিয়ে ব্যস্ত। এককালে জনসভার আকার দিয়ে কোনো দল ও নেতার জনপ্রিয়তা পরিমাপ করা যেত। হরতালের সফলতা দিয়ে হরতাল আহ্বানকারীদের জনসমর্থন বোঝা যেত। এখন হরতালের কার্যকারিতা হারিয়েছে, জনসভারও। জনগণ এখন সব বোঝে। তাদের দাবিয়ে রাখা সম্ভব, বোকা বানানো সম্ভব নয়। সচেতন ৫০ জন মানুষের সভা ট্রাকে নিয়ে আসা ৫০ হাজার মানুষের জনসভার চেয়ে কার্যকর।

শুধু ময়দানে নয়, বড় বড় সভা হচ্ছে হলঘরেও। কখনো বিরাট প্যান্ডেল করে। সভার সঙ্গে ‘পণ্ড’ শব্দটি এখন খুব ব্যবহৃত হয়। তবে প্যান্ডেলের বা হলের সভায় বসার চেয়ারগুলো প্লাস্টিকের, কাঠের নয়। প্লাস্টিকের চেয়ারে মাথা কাটে, ফাটে না। জখম হলেও মৃত্যুর আশঙ্কা নেই। কয়েক দিন আগে চট্টগ্রামে যেভাবে সরকারি দলের এক সভায় চেয়ার উড়তে দেখা গেল, ফাল্গুনের বাতাসে গাছের পাতাও অত ওড়ে না।

এখন উপলক্ষ ও দিবসের শেষ নেই। দিবসও এক দিনে শেষ হয় না, দিবস গড়ায় হপ্তায়। উপলক্ষ চলে মাসব্যাপী। সরকারি দলের দিবস পালন উপলক্ষে ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও দোকানদারদের নাভিশ্বাস উঠেছে, শুধু প্রাণবায়ুটা বেরোনো বাকি। গরু ও খাসির যদি মানুষের মতো ভাষা থাকত এবং গান গাইতে পারত, তাহলে আমাদের ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’কে একটু বদলে গাইত-‘কসাইয়ের ছুরিতলে কত প্রাণ হলো বলিদান’। আমার পরিচিত এক মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিককে সেদিন বললাম, দাদা, ডায়াবেটিসের প্রকোপ বেড়েছে, মিষ্টির বেচাকেনা ভালো তো? তিনি তাঁর কপালে হাত ঠুকে বললেন, ‘মিষ্টির ব্যবসা ভালো, তবে আমারে এক শিশি বিষ দেন। ওই যে মোটরসাইকেল নিয়ে খাড়াইয়া রইছে রাস্তার ওপাশে চারজন।’

প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় আজকাল প্রায়ই সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ‘আমৃত্যু অনশন’ হচ্ছে। তেমনি তিন-চার বছর যাবৎ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ‘স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভা’ হচ্ছে। একশ্রেণির পত্রপত্রিকার কারণে অনেক শব্দ তার অর্থ হারিয়েছে। ‘বিরাট’ তো নয়ই, ‘বিশাল’ শব্দটিতেও মন ভরে না। ‘স্মরণকালের বৃহত্তম’-তাতেও সন্তুষ্টি নয়, এরপর শুরু হতে পারে হাজার বছরের বৃহত্তম অথবা সর্বকালের বৃহত্তম জনসভা।

এককালে বড় বড় জনসভায় দেখেছি স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনসমাগম, ৭ মার্চ তো অবিস্মরণীয়। ৯ মার্চ ভাসানীর পল্টনের জনসভাও ছিল বড়। সত্তরের জলোচ্ছ্বাসের পর পল্টনে তাঁর জনসভাটিও স্মরণীয়। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১০ জানুয়ারি স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের দিন সোহরাওয়ার্দীতে বঙ্গবন্ধুর যে জনসভা, সেটিও ঐতিহাসিক। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তির পর ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের যে সভায় তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ সম্বোধন করা হয়, তা ছিল বিরাট।’ ৭২-এর মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এলে সোহরাওয়ার্দীতে যে সভা হয়, সেটিও ছিল বিশাল। ওই সব জনসভায় লোকদের ধরে আনতে হয়নি। বাস-ট্রাকেরও প্রয়োজন হয়নি।

আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে, উৎপাদন বাড়ছে, কলকারখানায় অবকাঠামোর উন্নতি হচ্ছে, অর্থনীতি বড় হচ্ছে, কিন্তু পৃথিবীর মানুষের কাছে আমরা ছোট হয়ে যাচ্ছি। অতিরিক্ত মিটিং-মিছিলে জনদুর্ভোগের শেষ নেই। বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতে করণীয় কী? সেদিন একজন জানতে চাইলেন, জনসভার বিকল্প কী হতে পারে? আমি বলেছিলাম ‘উঠানবৈঠক’।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক