পুতিনকে নিয়ে দোলাচলে রুশরা

রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে পুতিনের নির্বাচনী বিলবোর্ড। এতে লেখা—‘প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট, ক্ষমতাধর রাশিয়া!’ অন্যপাশে লেখা, ১৮ মার্চ ২০১৮। ছবি টুইটারের সৌজন্য
রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে পুতিনের নির্বাচনী বিলবোর্ড। এতে লেখা—‘প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট, ক্ষমতাধর রাশিয়া!’ অন্যপাশে লেখা, ১৮ মার্চ ২০১৮। ছবি টুইটারের সৌজন্য

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হবেন, তা একরকম নিশ্চিত বলা যায়। তাঁর ব্যাপক সমর্থনের দিকে তাকিয়ে এ কথা আমরা জোর দিয়েই বলতে পারি। আগামী রোববারের নির্বাচনে পুতিনকেই বেশির ভাগ ভোট দিতে তৈরি। এসব ভোটার বিশ্বাস করেন, পুতিনের হাতেই স্থিতিশীল উন্নয়নের চাবিকাঠি। তবে ভিন্নমতও রয়েছে। রাশিয়ায় নেতা পরিবর্তনের সময় এসেছে—এ প্রজন্মের অনেক নাগরিক তা-ই মনে করছেন।

ভোটের লড়াইয়ে পুতিনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আলেক্সেই নাভালনিকে রাষ্ট্র অনেক আগেই সরিয়ে দিয়েছে। তাই বলতে গেলে, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়াই ৬৫ বছরের পুতিন পরবর্তী ছয় বছর মেয়াদে ক্রেমলিনের দায়িত্বভার নিতে যাচ্ছেন।

নির্বাচনে আটজন প্রার্থীর মধ্যে একমাত্র পুতিন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা তেমন কোনো উত্তাপ ছড়াতে পারেনি। পুতিনের নির্বাচনী প্রচারণাও চলছে নিভৃতে। আগের মতো এবারও নির্বাচন নিয়ে কোনো টেলিভিশন বিতর্কে অংশ নিচ্ছেন না পুতিন। সাম্প্রতিক দিনগুলোয় জনসমক্ষে পুতিনের উপস্থিতি একই সঙ্গে সরকারি দাপ্তরিক কাজ ও নির্বাচনী প্রচারণা—দুটোই চালাতে হচ্ছে। সর্বশেষ মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে ‘ক্ষমতাধর রাশিয়া’ শিরোনামে বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন পুতিন।

২০১৪ সালে গণভোটের মাধ্যমে ক্রিমিয়া রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী উপদ্বীপবাসী এবারই প্রথমবারের মতো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেবেন। এখানেও পুতিনের জনপ্রিয়তা একচেটিয়া। স্থানীয় লোকজনের বেশির ভাগ রুশ ভাষাকেই মাতৃভাষা হিসেবে মনে করেন।

ক্রিমিয়া করায়ত্ত করার ঘটনায় সেখানকার বাসিন্দারা দোষের কিছু দেখেন না, বরং তাঁরা গর্বিত। স্থানীয় প্রকৌশলী আন্দ্রেই লুকিনিখ বলেন, পুতিনই হচ্ছেন একমাত্র প্রার্থী, যিনি সংকটকালে আস্থার জোগান দিতে পারেন।

পুতিনের ওই ভক্ত আরও বলেন, ‘আমাদের নেতা অন্য সবার থেকে আলাদা, রাষ্ট্রে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখতে যা প্রয়োজন, পুতিন তা-ই করছেন।’

রাশিয়ায় নির্বাচনকে সামনে রেখে সে দেশে জোরদার নির্বাচনী ডামাডোল তেমন চোখে পড়ছে না। ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো নির্বাচন নিয়ে কোনো টিভি বিজ্ঞাপন এখানে নেই। র‌্যালি আর জনসভা করছেন প্রার্থীরা। পুতিন ছাড়া অন্য প্রার্থীরা নিয়মিত নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যমের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন।

তবে রাশিয়ার সরকারি-বেসরকারি গণমাধ্যমগুলো নির্বাচন নিয়ে নিয়মিত খবর প্রকাশ করছে। আর অনলাইন সংস্করণেও আলাদা ইন্টারঅ্যাকটিভ কনটেন্ট প্রকাশ করছে। তারা বলছে, এখন রাশিয়ায় অনেক বিরোধী দলের বা বিরোধী মতের প্রার্থী রয়েছেন। জনগণ যাঁকে ভোট দেবে, তিনিই জয়ী হবেন। তবে সেই সংখ্যা নিতান্তই কম। যেমন ইকাতিরেনবুর্গ শহরের বর্তমান মেয়র কিন্তু ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড রাশিয়ার নন। তিনি বিরোধী দলের মেয়র। নভোসিবিরস্ক শহরের মেয়রও বিরোধী দলের। ইরকুৎস্ক শহরের গভর্নর কমিউনিস্ট পার্টির। তাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন জনগণের সরাসরি ভোটে।

রুশদের ভোটাধিকার প্রয়োগে উৎসাহিত করতে রাশিয়াজুড়ে নির্বাচন কমিশন বড় বড় বিলবোর্ড বসিয়েছে। পুতিনসহ নির্বাচনে অংশ নেওয়া বাকি প্রার্থীদের ছবিসংবলিত প্রচারণা খুব কম দেখা যাচ্ছে। সাইবেরিয়ার সবচেয়ে বড় শহর নভোসিবিরস্কের একটি সড়কের পাশে পুতিনের ছবিসহ একটি বিলবোর্ড বসিয়েছেন তাঁর ভক্তরা। একপাশে লেখা রয়েছে ‘প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট, ক্ষমতাধর রাশিয়া!’ অন্যপাশে লেখা, ১৮ মার্চ ২০১৮।

ভ্লাদিমির পুতিন টানা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন আর সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত তিনবার তিনি ক্রেমলিনের দায়িত্ব নেন। সে যা-ই হোক, ১৮ মার্চে ভোটার উপস্থিতি পুতিনকে চিন্তিত করতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, ভোটার উপস্থিতি আশাব্যঞ্জক না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এতে দীর্ঘ মেয়াদে পুতিনের রাষ্ট্র পরিচালনার বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করছেন।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুতিনের বিরতিহীন অংশগ্রহণ পরবর্তী সময়ে রুশ সমাজে জটিল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। একটি দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের মধ্যে যে আগ্রহ থাকা দরকার, তা সেখানে দেখা যাচ্ছে না।
এমনকি ভোটের ফলাফল নিয়েও কোনো বিস্ময়কর পরিবর্তন যেহেতু হচ্ছে না, তাই পুতিন এখন ভোটারদের নির্বাচনে কীভাবে আগ্রহ তৈরি করা যায়, সেই লড়াইটাই করে যাচ্ছেন। ইরিনা নামের এক রুশ নারী, যিনি তাঁর নামের দ্বিতীয় অংশ প্রকাশ না করার শর্তে সিএনএনকে বলেন, ‘আমাদের এখানে অনেকেই মনে করছেন যে ভোটের ফলাফল অনেক আগেই চূড়ান্ত হয়ে গেছে। তাই অনেকেই ভোটকেন্দ্রে যাবেন না এবং ভোট দেবেন না।’

ইরিনার মতো আজকের রুশ সমাজের বেশির ভাগ তরুণ-তরুণী সে দেশের রাজনীতির ওপর আগ্রহ হারাচ্ছেন। তাই আসন্ন নির্বাচন নিয়ে তাঁদের মধ্যে কোনো উত্তেজনা নেই। ১৯ বছর বয়সী ইউলিয়া ইভানোভনা থাকেন সাইবেরিয়ার নভোসিবিরস্ক শহরে। ইউলিয়ার মতো তরুণ প্রজন্মের রুশদের কাছে মস্কোর রাজনীতি শিহরিত করে না। তিনি বলেন, ‘পুতিন জয়ী হওয়ার পথে...আমাদের দেশে সব সময় তাই হয়ে আসছে।’

আধুনিক রাশিয়ায় পুতিনের প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা আলেক্সেই নাভালনি। নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে তাঁর ওপর অনেক আগেই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। নাভালনি নিজেও নির্বাচন বয়কট করেছেন। রাশিয়ার তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ, যারা নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তারা তাঁর সমর্থক।

ক্রেমলিন আসন্ন নির্বাচনে ৭০-৭০ ফলাফলে জিততে চায়। অর্থাৎ ৭০ ভাগ ভোট নিয়ে জিততে চায় পুতিন এবং ভোটার উপস্থিতি হবে ৭০ ভাগ। এতে পশ্চিমা যেসব নেতা রাশিয়াকে একনায়কতন্ত্র দেশ হিসেবে সমালোচনা করে আসছেন, তাঁদের জন্য এটি পাল্টা জবাব হবে বলে মনে করছেন পুতিনপন্থীরা।

তবে ৭০-৭০ পরিকল্পনা যে কার্যকর হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। রাশিয়ার লেভাদা সেন্টার নামে একটি স্বাধীন গবেষণা সংস্থার নভেম্বরে পরিচালিত জরিপে অংশ নেওয়া রুশরা জানান, মাত্র ২৪ শতাংশ রুশরা নিশ্চিত করে বলেছেন, তাঁরা ভোট দিতে যাবেন। আর ৩৪ শতাংশ হয়তো যাবেন, কিন্তু নিশ্চিত নন।

২০১৬ সালে রুশ সরকার লেভাদা সেন্টারকে ‘বিদেশি চর’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। সরকার দাবি করছে, সংস্থাটি বিদেশি দাতাদের অর্থে পরিচালিত হয়। এদের অধিকাংশ জরিপ ফলাফলই অনেকটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে থাকে।

অন্যদিকে, ক্রেমলিন-সমর্থিত রাশিয়ান পাবলিক ওপিনিয়ন সেন্টার বলছে, নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিত থাকবে আশাব্যঞ্জক এবং অন্তত ৭০ শতাংশ ভোট পড়বে। আর ৬৯ দশমিক ১ শতাংশ রুশরা ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষে ভোট দেবেন। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম থাকলেও তা পুতিনের ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসবে না। কারণ, রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য হতে হলে ভোটের হার সর্বনিম্ন একটা সংখ্যায় যে পৌঁছাতে হবে, এ-সংক্রান্ত কোনো নিয়মনীতি সে দেশের সংবিধানে নেই। তবে প্রেসিডেন্ট হতে হলে তাঁকে অবশ্যই ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেতে হবে।
জামিল খান: সাংবাদিক ও গবেষক