বিচারের রাজনীতি ও রাজনীতির বিচার

বিচার একটি রাজনীতি নিরপেক্ষ বিষয়। বিচারালয় তাই চোখ বন্ধ রেখে ন্যায়দণ্ড ধারণের অঙ্গীকারে আবদ্ধ একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান। নিরপেক্ষতার শপথ নিয়ে দেশের প্রচলিত আইনে বিচারকাজ নিষ্পন্ন করেন বিচারকেরা। কিন্তু বিচারকেরা যে আইনের ভিত্তিতে বিচার করেন, সে আইন তৈরি করেন রাজনীতির মানুষেরাই এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাউকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়েরও পুরোপুরি বস্তুনিষ্ঠ ও রাজনীতি নিরপেক্ষ, তা হলফ করে বলা যায় না। আবার বিচারকেরা রক্ত-মাংসের মানুষ, তাঁদের চোখ-কান সব সময় খোলা থাকে, বাইরের প্রবহমান আলো-বাতাস ও চাপ-তাপ তাঁদেরও প্রভাবিত করতে পারে। কারণ তাঁদেরও আবেগ, অনুরাগ, রাগ-বিরাগ, নানা মানবিক দুর্বলতা থাকা স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ বিচারকদের ন্যায়পরায়ণতা, বিচারবোধ, সততা, সৎসাহস এবং সুগভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ওপর নিঃশর্ত বিশ্বাস স্থাপন করে থাকে। বিশ্বব্যাপী এটিই স্বীকৃত নিয়ম ও রীতি। 

ইতিহাসে ন্যায়ালয় ন্যায়দণ্ড ধারণের অঙ্গীকার সব সময় সঠিকভাবে পালন করতে সক্ষম হয়েছে তা দেখা যায় না, কখনো কখনো এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। এই ব্যতিক্রম ঘটেছে রাজনীতির কারণে, আবার পরে রাজনীতিই তা শুধরে নিয়েছে এবং ইতিহাসের নির্মম রায়ে সুবিচার পাওয়া গেলেও যে ব্যক্তি সুবিচার সময়মতো পেল না, সে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিকারবঞ্চিত থেকেই গেছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দে ৫০০ জুরির সংখ্যাগরিষ্ঠ ২২০-এর বিপরীতে ২৮০ জনের ভোটে সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। ইতিহাসের রায় সক্রেটিসের পক্ষে থাকলেও ৭০ বছর বয়সে তিনি হেমলক পান করে অন্যায় দণ্ডাদেশ মাথা পেতে নিয়ে জীবন দিয়ে যান। সক্রেটিসের এই বিচার নিঃসন্দেহে একটি রাজনৈতিক বিচার।

ভারতীয় উপমহাদেশ নানা রাজনৈতিক বিচারের উর্বর ক্ষেত্রভূমি। প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক A. G. Noorani Indian Political Trials: 1757-1947 (2005) শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেছেন। এ বইতে বারোটি (১২) রাজনৈতিক মামলার ওপর বিশ্লেষণ হাজির করেছেন জনাব নূরানি। এই বারোটি রাজনৈতিক মামলার প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা হচ্ছেন যথাক্রমে মহারাজ নন্দকুমার (১৭৭৫), সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর (১৮৫৮), বালগঙ্গাধর তিলক (১৮৯৭,১৯০৮ ও ১৯১৬), শ্রী অরবিন্দ ঘোষ (১৯০৮), মাওলানা আবুল কালাম আজাদ (১৯২১), মাওলানা মোহাম্মদ আলী-মাওলানা শওকত আলী (১৯২১), মহাত্মা গান্ধী (১৯২২) প্রমুখ। উপমহাদেশ তথা বিশ্বের ইতিহাসে এই ব্যক্তিরা আজ অমর। তাঁদের বিরুদ্ধে করা মামলার দুরভিসন্ধি ও রাজনৈতিক হীন চক্রান্ত ইতিহাস স্বীকৃত।

উপমহাদেশের তিনটি দেশ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর নামে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মামলার বিরাম নেই। বাংলাদেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের তিনজন প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তি অনেক মামলায় অভিযুক্ত হন। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অনেকগুলো মামলায় অভিযুক্ত এবং ছয় বছরের মতো জেলও খেটেছেন। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও দুবারের বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বর্তমানে ৩৭টি মামলায় অভিযুক্ত এবং একটি মামলায় সাজা ভোগ করছেন। তিনবারের অন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও ১১টি মামলা দায়ের করা হয় (২০০৭-২০০৮), যা অবশ্য আইনি প্রক্রিয়ায় নিষ্পত্তি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের এই তিন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর নামে মামলা দায়ের, মামলা সচল রাখা, অচল করা, দ্রুততর, মন্থর কিংবা প্রত্যাহার করা সবকিছুতে রাজনীতির সংস্রব রয়েছে বলে অনেকের ধারণা।

বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রসমূহকে তিনটি প্রধান বিভাজনে দেখা হয়। যেমন কার্যকর রাষ্ট্র (Effective state), দুর্বল, ভঙ্গুর বা অকার্যকর রাষ্ট্র (Weak/fragile state) এবং ব্যর্থ রাষ্ট্র (Failed state)। অকার্যকর বা দুর্বল রাষ্ট্র, যারা ব্যর্থতার দিকে অগ্রসরমাণ, তাদের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে যা উল্লেখ করা হয়, তার মধ্যে আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, রাজনীতি ও দুর্নীতির সীমানা অচিহ্নিত হয়ে পড়া, বিচারালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকা উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচকে যথেষ্ট অগ্রগতি সত্ত্বেও আইনের শাসন, গণতন্ত্র, দুর্নীতি, মানবাধিকার প্রভৃতি সূচকে ক্রমাবনতি মধ্যম আয়ের দেশের পথে অগ্রসরমাণ একটি জাতি-রাষ্ট্রের ভঙ্গুরতাকে বাড়িয়ে দিতে পারে। ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে, ২০১৮ সালে তা পুনরুদ্ধার সম্ভব না হলে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়তে পারে।

এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অপরাধ দমনে ভারতের একটি উদ্যোগ আমাদের চোখ খুলে দিতে পারে। ভারতের রাজনীতিতে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধিতে নাগরিক উদ্বেগ ক্রমাগত বাড়তে থাকায় রাষ্ট্র ও সরকার অনেকগুলো বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। ২০১৪ সালের এপ্রিলের ৭ থেকে ১২ মে পর্যস্ত সময়ে যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে ৮১ কোটি মানুষ অংশগ্রহণ করে, যা ভারতকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতি ও অপরাধ ভারতীয় গণতন্ত্রের উজ্জ্বলতাকে কিছুটা ম্লান করে দিয়েছে বৈকি। লোকসভার ৫৪৫ সদস্যের ৩০ শতাংশ ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত। লোকসভা ছাড়াও বিধানসভা, রাজ্যসভার অনেকে একই অভিযোগে অভিযুক্ত। ২০১৪ সালের লোকসভা ও আটটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের পরপর এসব বিষয় নিয়ে ১ হাজার ৫৮১টি মামলা হয়। এই মামলাগুলো ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে রুজু করা হয়। এসব নির্বাচিত প্রতিনিধির কেউ এসব মামলায় দুই বছরের বেশি সময়ের জন্য সাজাপ্রাপ্ত হলে আইনসভার সদস্যপদ হারাবেন এবং পরবর্তী ছয় বছর আর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।

সম্প্রতি সরকারের এক সিদ্ধান্তে অর্থ মন্ত্রণালয় রাজনীতিবিদদের এই বিপুলসংখ্যক মামলা দ্রুত (আগামী জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে) নিষ্পত্তির জন্য ১৫টি বিশেষ আদালত গঠনের জন্য ৮ কোটি রুপির একটি বিশেষ বরাদ্দ অনুমোদন করা হয়েছে। এই অর্থে নবগঠিত দুটি আদালত ১৮৪ জন লোকসভা সদস্যের মামলার শুনানি করবেন। বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, তেলেঙ্গানায় একটি করে বিশেষ কোর্ট যথাক্রমে বিধানসভা সদস্যদের ১৪১,১০৭, ৮৭ এবং ৬৭টি মামলার শুনানি করবে। তা ছাড়া অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ এবং তামিলনাড়ুতেও একটি করে আদালত গঠিত হবে। অন্য ২১ রাজ্যে বিশেষ আদালত হবে না, তারা স্বাভাবিক আদালতে শুনানি শেষ করবে। কারণ, ৬৫ টির কম মামলা থাকলে কোনো রাজ্য বিশেষ আদালত পাবে না। এর মধ্যে গুজরাটে ৫৪, ঝাড়খন্ডে ৫২ এবং ওডিশায় ৫২টি মামলা রয়েছে, যা সাধারণ আদালতে নিষ্পত্তি হবে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপরাধের বহুবিধ অভিযোগের কথা শোনা গেলেও মামলা হয় না। ভারতে মামলার একটি বড় উৎস নির্বাচনকালীন হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যাবলি। অসত্য তথ্য, প্রদত্ত তথ্যের সঙ্গে আয়-ব্যয়ের গরমিল এবং সম্পদের তথ্য মামলার একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দেশে তথ্য নেওয়া হলেও নির্বাচন কমিশন এসব তথ্যের সত্য-মিথ্যা যাচাই করে না। এনবিআর কিংবা দুদকও এ ব্যাপারে নীরব থাকছে। রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নির্বাচন-এ তিনটি বিষয়কে স্বচ্ছ করতে হলে রাজনীতির অপরাধগুলোর বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং তা হতে হবে দলনিরপেক্ষভাবে। রাজনীতির গোলকধাঁধা থেকে বের হতে না পারলে আদালত এবং রাজনীতি দুটিই কলুষিত হতে থাকবে।

ড. তোফায়েল আহমেদ: রাজনীতি ও লোকপ্রশাসনের অধ্যাপক, স্থানীয় সরকার ও শাসন বিশেষজ্ঞ
[email protected]