মিয়ানমারের রোহিঙ্গা তালিকা

মিয়ানমারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেই রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট নিরসনের দুয়ার খোলা রাখতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো বিশ্বাস ও সম্প্রীতির সম্পর্ক একতরফা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। প্রত্যাবাসন চুক্তি করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে গোটা বিশ্বের সচেতন মহলের যে শঙ্কা ছিল, মিয়ানমার এক মাস সময়ের ব্যবধানে মাত্র ৩৭৪ জনের তথাকথিত ‘পরিচয় সত্যায়িত’ করে সেটাই সত্য বলে প্রমাণ দিয়েছে।

মিয়ানমার বিশ্বকে দেখাতে চাইছে যে তাদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার নৈতিক ভিত্তি তৈরি হয়েছে। কারণ, তারা প্রত্যাবাসন শুরু

করে দিয়েছে। প্রত্যাবাসন শুরু করা আলোকচিত্র ধারণ করার জন্য সীমান্তের ওপারে প্রস্তুতি সম্পন্ন করার প্রেক্ষাপটে অং সান সু চি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অনুষ্ঠেয় আসিয়ান-অস্ট্রেলিয়া শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো মিত্ররা যখন গণহত্যা ও বিতাড়নের জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে

সামরিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, তখন সিডনি নতুন করে মিয়ানমারকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে।

বাংলাদেশের উচিত হবে মিয়ানমারের এই ফাঁদে পা না দেওয়া। মিয়ানমারের পররাষ্ট্রসচিব বুধবার নেপিডোতে সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছেন, এরপর তাদের আর বিশ্বাস করা যায় না। মি. মিন্ট থু কার্যত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অসত্য তথ্য দেওয়া, এমনকি তিনজন তথাকথিত সন্ত্রাসীর নাম দেওয়ার নির্দিষ্ট অভিযোগ এনেছেন।

বাংলাদেশের এখন উচিত হবে অবশিষ্ট ৭ হাজার ৬৫৮ জনই নয়, বরং পুরো ৮ হাজার ৩২ জনের বিষয়ে মিয়ানমারকে দেওয়া নথিপত্র প্রকাশ করা। এ বিষয়টি আর পর্দার আড়ালে রাখা ঠিক হবে না। মিয়ানমারকে যদি আমরা এই ইস্যুতে ভ্রান্ত প্রমাণ করতে পারি, তাহলে সেটা বড় কূটনৈতিক বিজয় বলে গণ্য হবে। এখন বাংলাদেশকে যা করতে হবে তা হলো অনতিবিলম্বে বিশেষ দূত পাঠিয়ে উভয় দেশের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অভিন্ন মিত্রদের কাছে ওই নথিপত্র সরবরাহ করা।

বিশ্বকে অবশ্য এটা বোঝাতে হবে যে জাতিসংঘের বিদ্যমান আইনের মধ্যে উদ্বাস্তুদের পরিচয় নির্ধারণের যে প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতি রয়েছে, তা এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না-ও হতে পারে। কারণ, তারা কোনো ‘সাধারণ উদ্বাস্তু’ হিসেবে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেনি। আমরা মনে করি, তারা প্রত্যেকে ‘জেনোসাইড সারভাইভার্স’ (গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া), সে কারণে তারা কোনো ধরনের পরিচয়পত্র বহন করতে পারেনি।

এমনকি বিশ্ব যখন নিশ্চিত যে দশকের পরে দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে জাতিগত নিধনের প্রক্রিয়া কার্যকর থাকার মধ্যে নাগরিকত্বের সনদ বলতে সভ্য বিশ্ব যার সঙ্গে পরিচিত, তা তাদের নেই। আর এই ‘দুর্বলতা’ মিয়ানমারের

জানা আছে বলেই তারা এবার আটঘাট বেঁধেই নেমেছে। এটা বলা অতিরঞ্জিত হবে না যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিশ্বসম্প্রদায়ের ধিক্কার ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও মন্থর গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে। আর তারই অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে।

এটা লক্ষণীয় যে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ দায় এড়ানোর পথ তৈরিই নয়, উল্টো বাংলাদেশকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে প্রত্যাবাসনের কোনো দিনক্ষণ চূড়ান্ত করেনি। বরং তারা আলোকচিত্র ও আঙুলের ছাপের মতো বিষয় সামনে আনছে। গ্রামের পর গ্রাম মাটির সঙ্গে নিশ্চিহ্ন করার পর তারা এখন বলছে, ‘তালিকা চুক্তি অনুযায়ী’ হয়নি। সুতরাং তারা কী করে বুঝবে যে তারা আগে আরাকানেরই বাসিন্দা ছিল?

জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করতে তারা ইতিবাচক মনোভাব দেখানোটা একটা অগ্রগতি। তালিকা তৈরি ও যাচাইয়ে তারা উভয় দেশে যুক্ত থাকুক।