পর্যটকবান্ধব করার জন্য যা করণীয়

আমরা বেশ কিছু বছর ধরে কুয়াকাটা সি-বিচের কথা শুনে আসছি। কিন্তু ঢাকা থেকে ২৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এই স্থানে একবার এসে দ্বিতীয়বার ফিরে এসেছে এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজনের অবস্থাও তাই। এই বন্ধত্ব্যের প্রধান কারণ যাতায়াতের অসুবিধা। ওদিকে একটি স্থানকে পর্যটকবান্ধব করার প্রথম শর্ত হচ্ছে স্থানটিতে যাতায়াতের সুবিধা থাকা। তবে আশার কথা, ঢাকা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত পদ্মা সেতু আর পায়রা নদীর ওপর লেবুখালী সেতু দুটির কাজ এগিয়ে চলেছে। এই সেতু দুটির কাজ শেষ হয়ে গেলে কুয়াকাটা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াত করা সম্ভব হবে।

এখন দেখা যাক কুয়াকাটাকে একটি আদর্শ পর্যটকবান্ধব স্থান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অন্য কী কী বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

কুয়াকাটা টাউনশিপ

কুয়াকাটা কোনো শহুরে অঞ্চল নয়। কুয়াকাটার সন্নিকটে মহিপুরে কিছু জেলের আনাগোনা ছাড়া একমাত্র শীতকালে এখানে কিছু লোকসমাগম হয়। বছরের বাকি সময়গুলোতে এখানে আসা পর্যটকেরা তাই নির্জনতায় ভোগেন। এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য এখানে একটি থানা-উপজেলা, একটি কোস্টগার্ড স্টেশন, হাসপাতাল এবং দু-একটি স্কুল-কলেজ গড়ে তোলা জরুরি। সে ক্ষেত্রে স্থায়ী কিছু লোকসমাগম হয়ে আস্তে আস্তে এখানে একটি টাউনশিপ গড়ে উঠবে।

সি-বিচ

কমবেশি ১০ কিলোমিটার লম্বাটে এই বিচের এক স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা গেলেও বালু-কাদামিশ্রিত এই বিচ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আদর্শ কোনো বিচ নয়; রয়েছে নানাবিধ অব্যবস্থাও। বিচে আসা-যাওয়া করার ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট এবং পারিপার্শ্বিক অপরিচ্ছন্নতা এসব অব্যবস্থার অংশ। এসবের পরিবর্তন দরকার।

পাশাপাশি লম্বা বিচের কিছু অংশ বেছে নিয়ে, সেই স্থানে নির্ভেজাল বালু ভরাট (রিক্লেইম) করা গেলে বিচের মাটি-কাদার সমস্যাটি দূর হবে। পৃথিবীর অনেক বিচেই এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে। সর্বোপরি একটি আদর্শ বিচের জন্য অনুসন্ধান, উদ্ধার পার্টিসহ দু-একটি ওয়াচ টাওয়ার এবং টহল বোটের ব্যবস্থা করাও জরুরি।

দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই এখানে বনভোজনের জন্য আসেন। এসব আগন্তুকের জন্য ওয়াপদা বেড়ির পাশে, বিচসংলগ্ন দু-একটি স্থানকে বনভোজনের স্থান হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিলে লোকজনের সুবিধা হবে।

সুন্দরবন ভ্রমণ

আমরা অনেকেই হয়তো জানি না, কুয়াকাটার সন্নিকটে মহিপুর মাছের আড়ত থেকে মাত্র পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে আন্ধারমানিক নদীর পশ্চিম কিনারে অবস্থিত ফাত্রার জঙ্গলটি সুন্দরবনের সর্ব পূর্বের একটি অংশ। আমার মনে হয়, কুয়াকাটা দেখতে আসা পর্যটকদের কাছে জায়গাটিকে পরিচিত করানো দরকার। সুন্দরবনের মতো একটি বিশ্ব ঐতিহ্য বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কে না দেখতে চাইবে?

সে ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগে মহিপুর ও ফাত্রার জঙ্গলে দুটি কংক্রিটের জেটি নির্মাণ করে দেওয়া জরুরি। বন কর্মকর্তারা চাইলে জঙ্গলের ভেতরে দু-একটি ওয়াচ টাওয়ারসহ একটি ‘ক্যাটওয়াক’ নির্মাণ করে দিলে ‘সোনায় সোহাগা’ হবে। নদী পারাপারের অসুবিধা হবে না। এই ঘাট দুটি নির্মিত হলে ব্যক্তিমালিকানায় এক-দেড় কিলোমিটার প্রশস্ত আন্ধারমানিক নদীতে লঞ্চ পারাপারের ব্যবস্থা এমনিতেই গড়ে উঠবে।

রাখাইন সম্প্রদায়

একটা সময় ছিল যখন আরাকান থেকে আসা রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন, যারা মগ নামে পরিচিত, কুয়াকাটা অঞ্চলে বসবাস করত। টংঘরে বসবাস করে, চুরুট ও চোলাই মদপানের মধ্যে তারা আরাম-আয়েশে জীবন কাটাত। সে অবস্থা অনেকটাই আর নেই। বেশির ভাগ জমিজমা বেহাত হয়ে এই সম্প্রদায় এখন বিলুপ্তপ্রায়। বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী এই নৃগোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখতে পারলে ভালো হতো। এখানে বৌদ্ধধর্মের একটি মঠ আছে, এই মঠ রক্ষণাবেক্ষণ করে রাখা জরুরি।

মহিপুর মাছের আড়ত

মহিপুরে অবস্থিত মাছের আড়তটি বেশ পুরোনো। বাংলাদেশ ফিশারিজ ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (বিএফডিসি) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আড়তটির নৌকাঘাট এবং অন্য সব অবকাঠামোর অবস্থা খুবই জরাজীর্ণ। এগুলো সংস্কারসহ প্রয়োজনে বর্ধিত করা প্রয়োজন।

পরিশেষে, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে, ওপরে বর্ণিত কাজগুলো করার জন্য সঠিক চিন্তা ও সদিচ্ছাই যথেষ্ট বলে আমি মনে করি। এ কাজ করার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার দরকার নেই। অবকাঠামোগত দিকগুলো ঠিক হয়ে গেলে ব্যক্তি উদ্যোগে হোটেল-মোটেল, যোগাযোগের বাহন ইত্যাদি এমনিতেই গড়ে উঠবে।

ক্যাপ্টেন শামস উজ জামান মাস্টার মেরিনার এবং শিপিং কনসালট্যান্ট