ব্যাংকে তারল্যসংকট

কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেছিলেন, একটি বেসরকারি ব্যাংক সমস্যায় পড়লেও সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাত ভালো অবস্থায় আছে এবং ব্যাংকে কোনো তারল্যসংকট নেই। তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবের মিল আছে বলে মনে হয় না।
গত বুধবার প্রথম আলোতে ‘বাড়ছে ডলারের দাম ও সুদহার: ব্যাংকে অর্থসংকট’ শিরোনামে যে খবরটি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বিনিয়োগ ও ব্যবসা–বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবারই উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা। কেননা, ব্যাংকের তারল্যঘাটতি তো শুধু ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি বাড়াবে না। শিল্প–ব্যবসা-বাণিজ্য তথা জনজীবনেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে একদিকে আমানত কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে ডলারের দাম ও সুদহার বাড়ছে। দুই দিক থেকেই দুঃসংবাদ। কম সুদে আমানত পাওয়া না গেলে ব্যাংক বেশি সুদে আমানত সংগ্রহের চেষ্টা করবে। শেষ পর্যন্ত চাপটা পড়বে ঋণগ্রহীতার ওপরই।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনমতে, তারল্যসংকটের কারণে বৃহত্তম বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক শাখাগুলোতে ঋণ দেওয়ার সীমা কমিয়ে দিয়েছে। আগে কেন্দ্রের অনুমোদন ছাড়া শাখা ব্যবস্থাপকেরা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারতেন। এখন সেই ঋণ দিতে কেন্দ্রের অনুমোদন লাগবে। শুধু ইসলামী ব্যাংকে নয়, অন্যান্য বেসরকারি ব্যাংকেও আমানত ঘাটতি আছে। কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংক এই ঘাটতি পূরণে কর্মীদের বেশি বেশি আমানত সংগ্রহের জন্য চাপ দিচ্ছে। কখনো কখনো চাকরির শর্ত হিসেবেও জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে সুস্থ প্রতিযোগিতা থাকলে এর প্রয়োজন হতো না।
মাস কয়েক আগে বেসরকারি ব্যাংক ফারমার্স আমানতসংকটে পড়লে ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা দেখা দেয়। অনেক প্রতিষ্ঠান বেসরকারি ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেয়। এর আগে আর্থিক অনিয়মের কারণে ব্যাংকটিকে জরিমানা করা হয়েছিল, পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে সরিয়ে দেওয়া হয়। সে সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু পদক্ষেপ নিয়ে আবার সংশ্লিষ্টদের
চাপে পিছিয়ে আসে।
এই প্রেক্ষাপটে তারল্যসংকট যে নতুন করে ঝুঁকি তৈরি করেছে, তাতে সন্দেহ নেই। নির্বাচনের বছরে ব্যবসা-বাণিজ্যে একধরনের অনিশ্চয়তা আছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার কী পদক্ষেপ নেয় এবং সেই পদক্ষেপের প্রতি ব্যবসায়ী ও গ্রাহকেরা কতটা আস্থা রাখতে পারেন, তার ওপরই নির্ভর করবে সেই অনিশ্চয়তা কাটবে কি কাটবে না।
প্রথম আলোর খবরে আরও বলা হয়, কোনো কোনো ব্যাংক ১৩ শতাংশ সুদহারে গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত নিচ্ছে, যা কিছুদিন আগেও ছিল এক অঙ্কের ঘরে। সুদের হার নিয়েও একধরনের বিশৃঙ্খলা রয়েছে, যা সুস্থ ব্যাংকিংয়ের সহায়ক নয়। ব্যাংকগুলোতে আমানত সংগ্রহের বিষয়ে প্রতিযোগিতা থাকবে। কিন্তু সেটি হতে হবে নিয়মনীতি মেনে। কোনো ব্যাংক যদি ১৩ শতাংশ সুদে আমানত গ্রহণ করে, গ্রাহকদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সেই সুদ ১৭–১৮ শতাংশে পৌঁছাবে। সে ক্ষেত্রে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব
পড়তে বাধ্য।
ব্যাংকিং খাতের এই সংকটের মুখে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি আরও চাপ বাড়িয়েছে। এর ফলে আমদানি ব্যয় বাড়বে ও রপ্তানি আয় কমবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়বে। এখানেও ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনে অনুৎপাদনশীল খাতে আমদানিকে নিরুৎসাহিত
করতে হবে।
নির্বাচন নিয়ে যাতে কোনো রকম অনিশ্চয়তা তৈরি না হয়, সে বিষয়েও সরকারকে সজাগ থাকতে হবে। বিভিন্নমুখী সমালোচনার মুখে ঋণ আদায়ে যে কিছুটা গতি এসেছে, সেটি অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই।