জাতীয় নির্বাচন শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়

কথাটি এসেছে সরকারের এবং সরকারি দলের অতি দায়িত্বশীল একটি মহল থেকে। বলা হয়েছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে তাদের জয়লাভের ব্যাপারটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বক্তব্যটি নিয়ে উত্তপ্ত সমালোচনা হলে দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, গত ১০ বছরে তারা দেশের এত ভালো করা করেছে যে জনগণ ব্যাপক ভিত্তিতে তাদেরই সমর্থন জানাচ্ছে। কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যাপক জনসমর্থন থাকলে নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় যাওয়ারই কথা। সে অর্থে এ ধরনের উক্তি দোষের বলা যাবে না। তবে প্রশ্ন থাকবে ওই জনসমর্থনের হিসাব-নিকাশ করলেন কে বা কারা? এটার জন্য তো রয়েছে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা। আর তা হচ্ছে নির্বাচন।

নির্বাচনে জয়লাভ করতে রাজনৈতিক দলগুলো তৎপরতা চালায় অহর্নিশ। গণমাধ্যমও ঘুম হারাম করে নেমে পড়ে। আসেন বিদেশি পর্যবেক্ষকও। তদুপরি নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্রের বেসামরিক ও সামরিক কর্ম বিভাগেরও প্রধান কাজ হয়ে যায় এটা। তাই কর্মযজ্ঞটি অনেকগুলো আনুষ্ঠানিকতার সমাহার হলেও নির্বাচনে কারও জয়লাভ শুধু আনুষ্ঠানিকতা-এরূপ বলার সুযোগ নেই। আর কথাটির যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা-ও প্রশ্নবিদ্ধ। যদিও সরকারি দল সরকারি ব্যয়ে নিয়মিত নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালাচ্ছে, তাদের মূল প্রতিপক্ষ এখনো বৃত্তের বাইরে। তারা নির্বাচনী প্রচার করার সুযোগ কতটুকু পাবে, সেটা অনিশ্চিত। এখন পর্যন্ত তাদের শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে করা হচ্ছে গ্রেপ্তার। এটা যদি আইনের প্রয়োগ হয়, তাহলে কিছু বলার নেই। রাস্তা বন্ধ করে জনসভার অনুমতি দেওয়া হয়নি, এমনটি বলা হয় ইদানীং। এ অবস্থান সব ক্ষেত্রে সমর্থনযোগ্য। তবে ব্যতিক্রম ঘটছে প্রায়ই। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলকে রাস্তাঘাট বন্ধ না করে ছুটির দিনে কিছু সভা-সমাবেশ করার সুযোগ দেওয়া একান্তই প্রয়োজন।

নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচন আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে হওয়ার কথা রয়েছে। নির্বাচন শব্দটির মাঝেই অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ, অবাধ ইত্যাদি বাক্য অন্তর্ভুক্ত। তাই এর সঙ্গে অকারণ বিশেষণ যুক্ত করে ভারাক্রান্ত করা অপ্রয়োজনীয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের দেশে এমনটা না হওয়ায় এসব বিশেষণ ব্যবহৃত হচ্ছে। সত্যিকার অর্থে নির্বাচন হবে কি না-এ নিয়ে জনগণও সংশয়বাদী থাকছে। সংশয়ে আছে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক রাজনৈতিক দলগুলো। আমাদের উন্নয়ন-সহযোগী সংস্থাসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলো এ দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ দেখতে চায়। এর জন্য তারা প্রেরণাও দেয়। বিশ্ব সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধির জন্যও এটা অতি প্রয়োজনীয় একটি দিক। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার অন্য দেশের সঙ্গে বোঝাপড়ায় অনেক বেশি শক্তিশালী অবস্থানে থাকে। আর এতে গলদ থাকলে ঘটে বিপরীতটা।

এখন প্রধান বিরোধী দলকে বৃত্তের বাইরে রেখে সরকারি দল গগনচুম্বী জনপ্রিয়তার কথা বলে। আরও বলে আগামী নির্বাচনেও তাদের জয়লাভ আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। তখন এ ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের মাঝেই বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে। নির্বাচনটিতে তার সব বৈশিষ্ট্য থাকবে কি না, এ নিয়ে কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করলে অমূলক বলা যাবে না। হতে পারে সরকারি দলের এ হিসাব-নিকাশ যৌক্তিক ভিত্তির ওপরই তৈরি। হতে পারে জনগণের ভোটে তারাই আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবে। সংসদীয় গণতন্ত্রে একই দল দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা, একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ভারতেও জওহরলাল নেহরু একটানা ১৭ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কংগ্রেসি শাসন ছিল কয়েক যুগ। বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকার চালিয়েছে ৩৪ বছর। সুতরাং এ দেশেও এমনটা হতে পারে।

অন্যদিকে দেশ ও জাতির জন্য অনেক যুগান্তকারী অবদান রেখে ক্ষমতা হারিয়েছেন কেউ কেউ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভের পর যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে চার্চিল হেরে যান। তেমনি ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে অসাধারণ সাফল্য লাভ করেও পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতা হারান ইন্দিরা গান্ধী। তিনি তখন লোকসভার সদস্যও হতে পারেননি। ১৯৯১ সালে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে জয়লাভের পরও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ হেরে যান পরবর্তী নির্বাচনে। তাই ভোট দেওয়ার জন্য জনগণ বিবেচনায় কী নেবে, তা অনুমান করা সহজ নয়।

এমনিতেই আমাদের দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র একটি ভঙ্গুর অবস্থার মাঝ দিয়ে চলছে। এটাতে হোঁচট খেতে হচ্ছে বারবার। ১৯৯০-এ স্বৈরশাসনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে বলে দাবিও আজকে ফিকে হয়ে গেছে। সে পতিত স্বৈরশাসকই এখন সরকারের অংশীদার এবং বিরোধী দলেও আছেন। তিনি স্বপ্ন দেখছেন আগামী নির্বাচনে সরকার গঠন করার। আর রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। ১৯৯১-এর সফল নির্বাচনের পর ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারিতে একটি বিতর্কিত নির্বাচন হয়। সে সংসদ ক্ষণস্থায়ী হলেও আজকের শাসক দলের দাবিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু হয়। ওই ব্যবস্থায় ১৯৯৬-এর জুনে আবার একটি নির্বাচন হয়। তেমনি নির্বাচন হয় ২০০১-এ।

এরপরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে দলমুখী করতে ২০০৪-এ বিচারপতিদের বয়স বাড়ানোর জন্য করা হয় সংবিধান সংশোধন। অন্যদিকে ২০০৬-এ সরকারও মেয়াদান্তে নানামুখী টানাপোড়েনে সদ্য সাবেক ক্ষমতাসীন দলের প্ররোচনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের পদটি রাষ্ট্রপতি নিজেই নিয়ে নেন। কিন্তু বিধি বাম ছিল। এল এক-এগারো। অনেক নিন্দিত-নন্দিত ওই সরকারের সময়কালেই দেশে তৈরি হয়েছে সব নাগরিকের ছবিযুক্ত একটি ভোটার তালিকা ও পরিচয়পত্র। ২০০৮-এর শেষে হয় জাতীয় নির্বাচন। সে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা দলটি একটি আদালতের রায়কে ভিত্তি করে সংবিধান থেকে তুলে দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। সরকার ক্ষমতায় থেকে এবং সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হয় ২০১৪-তে। অংশ নেয়নি প্রধান বিরোধী দল। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ১৫৩ জন সাংসদ। অবশিষ্টগুলোতেও প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধরন-ধারণ দেশবাসীর জানা। যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন রইলেন তাঁরাই। যা-ই হোক সংসদ আছে। আছে সরকারি ও বিরোধী দল। সেই ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারি কিংবা ২০১৪-এর নির্বাচনের মডেলকে বিবেচনায় নিয়ে যদি সরকারি দলের জয়লাভকে আনুষ্ঠানিকতা বলা হয়, তাহলে অসত্য বলা যাবে না।

মোদ্দা কথা, আসন্ন নির্বাচন সফল হোক, এটা দেশবাসী চায়। তার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন ও সরকারের। কমিশন এখানে তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে অনড়। এমনটাই যদি হয়, তবে তফসিল বেশ আগে, ধরা যাক ছয় মাস, ঘোষণা করতে দোষ কোথায়? এটা তো কমিশনেরই এখতিয়ার। তারা তো বিভিন্ন প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থাও নিতে শুরু করেছে। বর্তমান ব্যবস্থায় খেলার মাঠকে একেবারে সমতল হয়তো করা যাবে না। তবে সম্পূর্ণ বৈষম্যমূলক একটি ব্যবস্থায় বিরোধী দলকে রেখে সফল নির্বাচন আশা করা যায় না।

জাতীয় নির্বাচন স্থানীয় সরকার নির্বাচন নয়। সিটি করপোরেশন বা দু-একটি উপনির্বাচনও এর মডেল হতে পারে না। এক দিনে ৩০০ আসনের ভোট গ্রহণ হবে। ১০ কোটির ওপরে ভোটার। ভোটকেন্দ্র হবে প্রায় ৫০ হাজার। নিরাপত্তাব্যবস্থা চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের ব্যাপক দলীয়করণ নির্বাচন পরিচালনা ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তাই ভোট গ্রহণের আগে নির্বাচন কমিশন উদ্যোগ নিয়ে বেশ কিছু বদলির ব্যবস্থা প্রয়োজন হবে। পেশিশক্তির ব্যবহার বন্ধ করার জন্যও নিতে হবে পদক্ষেপ। এসব সমস্যা সমাধানে কমিশন কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের কথা অনেকে বলছেন, কিন্তু তাতে ফল দেবে বলে মনে হয় না। বরং জটিলতা তৈরি হতে পারে। ১৯৯১ থেকে আজ পর্যন্ত চারটি সফল নির্বাচন উপহার দিয়েছে বিদ্যমান প্রশাসনব্যবস্থা। আবার বিতর্কিত দুটো নির্বাচনও তাদেরই। বিষয়টা নির্ভর করছে তাদের কীভাবে চালাবেন, এর ওপর। সরকারি দলের জয়লাভের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকতা বলে যদি তারা ধরে নেয়, তাহলে মনে করতে হবে ফলাফল নির্ধারণে জনগণের তেমন ভূমিকা থাকবে না। এ আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হোক-এমনটাই আমরা চাই।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]