ফেসবুক বিতর্কে বাংলাদেশের নির্বাচন

দিন দশেক আগে লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান-এর সহযোগী সাপ্তাহিক অবজারভার-এ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক অপব্যবহারের বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে বিশ্বের নানা প্রান্তে এ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। ওই খবরের মূল কথা হচ্ছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নামের একটি ব্রিটিশ কোম্পানি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মনোবিদের কাছ থেকে ফেসবুকের পাঁচ কোটি ব্যবহারকারীর মনস্তাত্ত্বিক গঠন প্রকৃতির তথ্য-উপাত্ত কিনে তা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পক্ষে কাজে লাগিয়েছে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা (সিএ) অন্যান্য দেশেও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় একই ধরনের কাজে যুক্ত ছিল এবং আছে বলে খবরটিতে বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে তো বটেই, বিতর্কে আমাদের প্রতিবেশী ভারতও পিছিয়ে নেই। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কাসহ যেসব দেশে সিএর কার্যক্রমের কথা উঠেছে, সেসব দেশে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। তবে বাংলাদেশ হচ্ছে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম-আগামী নির্বাচনে তাদের যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার খবর নিয়ে কোথাও কোনো কথা নেই।

অবজারভার-এর প্রথম খবরটি প্রকাশের এক দিন পর ১৯ মার্চ ভারতীয় পত্রিকা হিন্দুস্তান টাইমস দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সিএর তৎপরতা নিয়ে খবর প্রকাশ করলে ভারতের প্রধান দলগুলো এ বিষয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। ক্ষমতাসীন বিজেপির মুখপাত্র ও আইনমন্ত্রী রবিশংকর প্রসাদ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সিএকে কাজে লাগানোর অভিযোগ করেন। যদিও পরে জানা যায় যে কংগ্রেস নয়, সিএকে কাজে লাগাতে চেয়েছে বিজেপি। এর আগে রাজ্যপর্যায়ের নির্বাচনে বিহারে ক্ষমতাসীন জনতা দল ইউনাইটেড সিএর সাহায্য নিয়েছিল।

হিন্দুস্তান টাইমস জানায়, সিএ ও তার ভারতীয় শরিক ওভেলানো বিজনেস ইন্টেলিজেন্স (ওবিআই) প্রাইভেট লিমিটেড ২০১৯ সালের নির্বাচনের বিষয়ে বিজেপি ও কংগ্রেস উভয়ের সঙ্গেই কথা বলেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে ওয়াকিবহাল একজনকে উদ্ধৃত করে তারা জানায়, প্রতিষ্ঠানটি শ্রীলঙ্কার ২০২০ সালের নির্বাচন নিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের সঙ্গে এবং বাংলাদেশের ২০১৯ সালের নির্বাচন (নির্বাচনটি চলতি বছরের শেষেও হতে পারে) নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে। ওই ব্যক্তি আরও জানিয়েছেন যে কোনো কিছু এখনো চূড়ান্ত হয়নি, এগুলো ছিল প্রাথমিক আলোচনা।

সিএ তার ওয়েবসাইটে বলেছে যে ভারতের বিহার রাজ্যের নির্বাচনে তারা যতগুলো আসন বাছাই করেছিল, তার ৯০ শতাংশে সফল হয়েছে এবং তাদের গ্রাহক ভূমিধস বিজয় পেয়েছে। সিএ বলেছে, তাদের কাজ ছিল মত বদলাতে পারে এমন ভোটারদের চিহ্নিত করা। তা ছাড়া গ্রাম পর্যায়ে দল সংগঠিত করায় প্রচারকৌশল ঠিক করার দায়িত্বও ছিল তাদের। সিএর ভারতীয় শরিক ওবিআইয়ের প্রধান নির্বাহী অমরিশ ত্যাগি ভারতীয় জনতা দল ইউনাইটেডের জ্যেষ্ঠ নেতা ও রাজ্যসভার সাবেক সদস্য কেসি ত্যাগির ছেলে। অমরিশ ত্যাগি এরপর ২০১২ সালে উত্তর প্রদেশে কাজ করেছেন বিজেপির নিতিন গড়কড়ির জন্য। তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের মধ্যে ট্রাম্পের পক্ষেও প্রচারকাজ চালিয়েছেন। তবে অমরিশ ত্যাগি ভারতে সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো কাজ করার কথা অস্বীকার করেছেন। প্রযুক্তিবিষয়ক ভারতীয় পোর্টাল বিবকম ডটকম জানিয়েছে, সিএ ও তার ভারতীয় অংশীদার নিশ্চিত করেছেন যে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা আইন ভাঙার জন্য দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে নির্বাচনগুলোতে তাদের সহযোগিতামূলক কাজ চালিয়ে যাবে। ওবিআইয়ের অমরিশ ত্যাগি বিবকমকে বলেছেন যে সামাজিক মাধ্যমের বিষয়ে বিভিন্ন দেশের আইনে ভিন্নতা আছে।

ওবিআই কিংবা সিএ ছাড়াও এ ধরনের কৌশলগত সেবা আরও অনেক কোম্পানিই দিয়ে থাকে। সিএর অভিভাবক কোম্পানি হচ্ছে স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশনস ল্যাবরেটরি (এসসিএল)। এর বিশেষত্ব হচ্ছে ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীর আচরণের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (বিহেভিয়ারিওল সায়েন্স) কাজে লাগিয়ে জনমত প্রভাবিত করা। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এর তথ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার বা উইপোনাইজেশন অব ইনফরমেশন বলে অভিহিত করে থাকেন। এসসিএলের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, তারা শতাধিক দেশে নানা ধরনের বিষয়ে জনমত সমীক্ষা, প্রচারকৌশল ঠিক করা এবং সরাসরি প্রচারকাজ পরিচালনার মতো কাজ করেছে। তারা পাশ্চাত্যের সামরিক জোট ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা দপ্তরের হয়েও বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করে থাকে। এসসিএলের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে আছে আফগানিস্তানের মতো যুদ্ধপীড়িত এলাকায় জনমত সংগঠিত করার অভিজ্ঞতা। নেপালে মাওবাদী বিদ্রোহীদের আচরণ বদলানোর ক্ষেত্রেও তারা কাজ করেছে বলে তাদের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে।

নির্বাচন প্রভাবিত করার কাজটি তারা যেসব দেশে করেছে, সেসব জায়গায় তারা যে শুধু তাদের নিয়োগকারী দল বা প্রার্থীর বার্তা প্রচার করেছে তা নয়, তারা জাতিগত বিরোধ কাজে লাগিয়ে বিরোধ তীব্রতর করা, প্রতিপক্ষের ভোটারদের মনে ভীতি ছড়ানোর মতো অপকর্মও করেছে। নাইজেরিয়ায় তারা প্রেসিডেন্ট জনাথন গুডলাকের পক্ষে নির্বাচনী সমাবেশের আয়োজন করে। প্রতিপক্ষের সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে আসা নিরুৎসাহিত করতে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালানোর পরোক্ষ স্বীকারোক্তি রয়েছে তাদের। লাটভিয়ায় তারা জাতিগত উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়েছে। এখন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে এসব কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর খোদ ব্রিটিশ সরকার বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। একদিকে ব্রিটিশ সরকার ওই সব দেশে নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার এবং গণতন্ত্র শক্তিশালী করায় অর্থ ব্যয় করেছে, আর অন্যদিকে সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেও তারা সেসব দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বেআইনি প্রভাব বিস্তার করেছে। ভারতসহ বিশ্বের অন্তত বারোটি দেশে তাদের অফিস রয়েছে। তবে নির্বাচনবিষয়ক কার্যক্রম আলাদাভাবে পরিচালনার লক্ষ্যেই তারা সিএর রাজনৈতিক শাখা প্রতিষ্ঠা করেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচনে ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারে এমন কোনো ভূমিকা কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান নিতে পারে কি না। নির্বাচনে সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা কী হবে সে বিষয়ে এখনো কোনো নীতি অথবা বিধিমালা তৈরি হয়নি এবং বিষয়টিতে জাতীয় পর্যায়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও লক্ষণীয় নয়। নির্বাচনী আইনে বিদেশি প্রচার বিশেষজ্ঞ নিয়োগে বাধা না থাকলে অতীতে সে রকম কোনো ঘটনা ঘটেছে কি না, সেই প্রশ্নও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে কোনো বক্তব্য আসেনি। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা গত চার দিনেও প্রথম আলোর ই-মেইলের কোনো জবাব দেয়নি। বলে রাখা ভালো, চ্যানেল ফোরে প্রচারিত গোপনে ধারণকৃত এক আলোচনায় সিএর প্রতিনিধিরা জানিয়েছিলেন যে তাঁরা প্রোটনমেইল নামের এমন ই-মেইল ব্যবহার করেন, যা নির্দিষ্ট সময়ের পর আপনা-আপনি ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে তাঁদের কার্যক্রমের ডিজিটাল ছাপ তদন্তকারীরা কতটা ধরতে পারবেন বলা মুশকিল। ট্রাম্পের নির্বাচন এবং ব্রেক্সিটের গণভোটে তাঁদের ভূমিকা সম্পর্কে যেসব বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো প্রথমে তাঁরা অস্বীকার করলেও পরে স্বাধীন তদন্ত অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন। এ নিয়ে আলাদা একাধিক তদন্ত শুরুও হয়েছে। ফেসবুকও কাঠগড়ায় এবং দুঃখ প্রকাশের পর জাকারবার্গকেও এসব তদন্তে হাজির হতে হবে।

বাংলাদেশে ফেসবুক, টুইটার এবং নতুন নতুন অনলাইন পোর্টালে রাজনীতিকদের পক্ষে-বিপক্ষে প্রচারণা যে নতুন মাত্রা পেয়েছে, তা আর নতুন কোনো খবর নয়। সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইনের প্রচারযুদ্ধে সরকারবিরোধীরা যে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তার একাধিক দৃষ্টান্তের কথা আগেও আলোচনা করেছি (ভুয়া খবর, ফেসবুক, টুইটার ও নির্বাচন, প্রথম আলো, ১৫ জানুয়ারি, ২০১৮)। বিদ্যমান ৫৭ ধারা অথবা প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিধানগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যে দলনিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এমন আলামত একেবারেই অনুপস্থিত। সরকারি দলের নেতাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সমালোচনার ক্ষেত্রে ৫৭ ধারার যথেচ্ছ ব্যবহার এবং কথিত মানহানি মামলার নজির ভূরি ভূরি। বিপরীতে বিরোধী নেতা-নেত্রীদের চরিত্র হননকারী ভুয়া তথ্য বা অভিযোগের প্রতিবাদ গণমাধ্যমে যেমন যথেষ্ট গুরুত্ব পায় না, ঠিক তেমনি আদালত থেকে তাঁদের আইনগত প্রতিকার পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।

আমাদের নাজুক গণতন্ত্রে সরকারি দল ও তার সহযোগীরা এক মাসে চার-পাঁচটি জনসমাবেশের সুযোগ পেলেও বিরোধীদের অনুরোধ-আবেদন দিনের পর দিন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার নজির সবারই জানা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত দলগুলোর সবাই কি সোশ্যাল মিডিয়ায় সমান সুযোগ পাবে? আলামতগুলো অবশ্য ভিন্ন বার্তা দেয়। একইভাবে নির্বাচনী প্রচারকাজে সহায়তার জন্য বিদেশি পরামর্শক কিংবা স্ট্র্যাটেজিস্ট নিয়োগের ভালো-মন্দ ও প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের বিষয়েও দ্রুতই বাস্তবসম্মত নীতিমালা দরকার। সেই নীতিমালা হতে হবে ন্যায়ভিত্তিক ও বৈষম্যহীন।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক