শ্রীলঙ্কায় নিদাহাস ট্রফির নিদারুণ স্মৃতি

শ্রীলঙ্কায় নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে শেষ বলের ছক্কায় হারের পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। হাহাকার আর আহাজারি আর নেই। কিন্তু তির তির করে বুকের গভীরে একটি কষ্টের স্রোত ঠিকই বয়ে যায়। বাংলাদেশের হৃদয়ে এটি হয়তো বয়ে যাবে অনেক দিন। এই নিয়ে যে পঞ্চমবার ফাইনালে হারতে হলো বাংলাদেশকে। কবে কোন ক্রিকেট টুর্নামেন্টের শিরোপা উঠবে বাংলাদেশের হাতে?

সিংহলিজ ভাষায় নিদাহাস মানে স্বাধীনতা। শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতাপ্রাপ্তি আর শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট বোর্ডের ৭০ বছর পূর্তিতে আয়োজিত হয়েছিল ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট, যার নাম নিদাহাস ট্রফি। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য সেটি হয়ে রইল নিদারুণ স্মৃতি।

স্মৃতিটা প্রথমত দুঃখের, শিরোপার খুব কাছে গিয়েও পরাজয়ে ভেঙেছে বুক। বহু দিন মনে পড়বে ম্যাচের শেষ বলটিতে অবিশ্বাস্য এক ছক্কা হাঁকিয়ে ভারতের দিনেশ কার্তিক জয়োল্লাস করছেন। মাটিতে মাথা নুয়ে পড়ে আছেন বোলার সৌম্য সরকার। ১৯৮৬ সালে শারজায় অস্ট্রেলেশিয়া কাপে পাকিস্তানের জাভেদ মিয়াঁদাদ এভাবেই শেষ বলের ছক্কায় ভারতের চেতন শর্মাকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন দুঃস্বপ্নের অতলে। নিদাহাস ট্রফির স্মৃতিটা বাংলাদেশের জন্য আনন্দের, স্বাগতিক শ্রীলঙ্কাকে দুটি ম্যাচেই হারিয়ে দিয়ে ওঠা গেছে ফাইনালে। স্মৃতিটা ভয়জাগানিয়াও, অলিখিত সেমিফাইনালে রূপ নেওয়া শ্রীলঙ্কার সঙ্গে দ্বিতীয় ম্যাচে আমাদের দল যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা শুভ ইঙ্গিত দেয় না।

এই প্রতিক্রিয়ার সূত্র ধরেই চলে আসে ক্রিকেট জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গ। বাংলাদেশে নব্য জাতীয়তাবাদের মাধ্যম যেন ক্রিকেট। সমাজ আর রাষ্ট্রের নানা ব্যর্থতার মধ্যে দেশের মানুষ জাতীয়ভাবে একটু সাফল্যের স্বাদ পেতে উন্মুখ থাকে। দলগতভাবে বাংলাদেশ নাম নিয়ে সেটি মাঝেমধ্যে এনে দেন আমাদের ক্রিকেটাররা। তাই আমরা সবাই যেন উৎকট ক্রিকেট জাতীয়তাবাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি। আমরা প্রকৃত সামর্থ্যকে পাল্লায় না তুলে সব সময় জয় চাই। খেলার সীমানা কতটুকু, সেটা ভুলে যাচ্ছি। বেমালুম ভুলে বসে থাকছি দিন শেষে ক্রিকেট একটি খেলাই, যার মধ্যে জয়-পরাজয় থাকে, আনন্দের উল্টো পিঠে থাকে বেদনা।

শ্রীলঙ্কার সঙ্গে দ্বিতীয় ম্যাচে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা অনাকাঙ্ক্ষিত। অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ভুল বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন আইসিসির কাছে। ক্ষমা চেয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। ভুল উপলব্ধি করতে পারলেই তো কেউ ক্ষমা চায়। কিন্তু আপনি যদি জরিপ করে দেখেন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ ওই দিন সাকিবের প্রতিক্রিয়াকে বাহবা দিয়েছেন। না, সাকিব আম্পায়ারের অবিচারের প্রতিবাদে ম্যাচ বর্জনের ডাক দিয়ে ঠিক করেছেন। যৌক্তিক নো-বল কেন ডাকবেন না আম্পায়ার?

আর কত চলবে অবিচার? কিন্তু এমনটা যাঁরা ভাবেন, তাঁরা বোঝেন না যে আম্পায়ারের মানবিক ভুল হতে পারে। তাঁর ভুল ধরার জন্য ওপরের কাচঘেরা ঘরে বসে একজন শ্যেনদৃষ্টিতে ম্যাচ দেখেন-ম্যাচ রেফারি। আম্পায়ার ভুল করলে তাঁর শাস্তিও হয়, যা প্রকাশ্যে আসে না। ম্যাচ রেফারির চোখে ওই দিন আম্পায়ারের ভুলটা নিশ্চয়ই চোখে পড়েছিল বলেই হয়তো কম শাস্তির ওপর দিয়ে পার পেয়েছে বাংলাদেশ। ম্যাচ ফির ২৫ শতাংশ জরিমানার সঙ্গে একটি করে ডিমেরিট পয়েন্ট যোগ হয়েছে সাকিব ও নুরুলের নামের পাশে।

বড় শাস্তি এড়ানো গেছে-এ যদি একটু তৃপ্তি দেয়, তবে উদ্বেগের কাঁটা বিদ্ধ করে আয়োজক দেশটির সমর্থকদের বৈরী আচরণ। বাংলাদেশ ফাইনালটা কলম্বোর রানাসিংহে প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে খেলেনি, খেলেছে যেন মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়েতে। গ্যালারি-ভর্তি শ্রীলঙ্কান সমর্থক সেদিন ভারতের হয়ে গলা ফাটাল। ম্যাচ শেষে নিজেদের জাতীয় পতাকা নিয়ে শ্রীলঙ্কান সমর্থকেরা ভারতীয় দলের জয়োৎসবেরও অংশ হলো। এই দৃশ্য পীড়াদায়ক।

ম্যাচের দ্বিতীয় শেষ বলে মাহমুদউল্লাহর হাঁকানো ছক্কায় ফাইনাল-বঞ্চিত হওয়ার দুঃখ, নাগিন নৃত্যে জয় উদ্যাপন, ম্যাচ বর্জনের হুমকি শ্রীলঙ্কানদের এতটাই বাংলাদেশবিদ্বেষী করে তুলল? পাকিস্তানের সঙ্গে ক্রিকেট সম্পর্কটা ভালো নয়। ২০১৫ বিশ্বকাপ বাংলাদেশকে করে তুলেছে ভারতবিদ্বেষী, যা খাটে উল্টোভাবেও। বন্ধুত্ব বা সম্পর্কের উষ্ণতা অবশ্য একপক্ষীয় বিষয় নয়। তারপরও বন্ধুহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকিটা বাংলাদেশের সামলানো হবে কষ্টকর। বন্ধুহীন হয়ে পড়ার চেয়ে বন্ধুত্ব ধরে রাখাটাই দেশের ক্রিকেটের জন্য মঙ্গল। ক্রিকেট জাতীয়তাবাদের কুয়াশা এই সত্যটাকে যেন ঢেকে না দেয়।

নিদাহাস ট্রফি শেষ লড়াইটায় বাংলাদেশ দলের ভাগ্যকে নিয়ে পরিহাস করেছে, তবে দিয়েছেও তো অনেক। এটি ফিরিয়ে দিয়েছে বিশ্বাস। টি-টোয়েন্টি যে ভয়ের বৃত্তে আটকে রেখেছিল এত দিন, সেটি ভেঙে দিয়েছে। বাংলাদেশ দল ভাবতে পারছে যে টি-টোয়েন্টি আর অচেনা ভুবন নয়। এখানেও মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ-তামিম-মোস্তাফিজদের হিসাবের বাইরে রাখতে পারবে না কোনো দলই। টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে টানা অষ্টম জয় তুলে নিয়েও ভারত যেমন নিজেদের বুকে ফুঁ দিয়ে বলছে এবার বরাতজোরে বেঁচে গেছি। দেশের মাটিতে শ্রীলঙ্কার কাছে ওয়ানডে, টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে টানা ছয় ম্যাচ হারের পর ‘গেল, গেল’ রব উঠে গিয়েছিল। সেটি থামানো গেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যা ছিল তা-ই আছে। রাতারাতি দলটি জয়ের সামর্থ্যহীন ক্রিকেট বামনে পরিণত হয়নি।

আগামী জুন মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর। আগামী বছর ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপের প্রস্তুতি কোন পথ ধরে এগোবে, সেটির পথরেখাও এঁকে দিয়েছে নিদাহাস ট্রফি। চন্ডিকা হাথুরুসিংহের বিদায়ের পর তাঁর উত্তরসূরি এখনো পায়নি বিসিবি। খুব শিগগির প্রধান কোচ নিয়োগ দিয়ে বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। বিশ্বকাপের ফল পরিণামে আইসিসি র‍্যাঙ্কিংয়ে আটের বাইরে নিয়ে ফেললে বাংলাদেশের সামনে পড়ে থাকবে দুর্গম পথ।

পবিত্র কুন্ডু: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি