বঙ্গীয় ভোটাধিকার প্রয়োগের আট দশক

বার্ষিকী উদ্‌যাপনে বাঙালি অদ্বিতীয়। স্বনামধন্যদের জন্ম-মৃত্যু-বিবাহবার্ষিকীর অন্ত নেই, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ঘটা করে পালিত হয়। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের উপলক্ষের শেষ নেই। তবে কখনো দু-একটি জরুরি বার্ষিকী পালনের কথা মনে থাকে না। বাঙালি প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করে ১৯৩৭ সালে। সে হিসাবে বাঙালির ভোটাধিকার প্রয়োগের ৮০ বছর পূর্তি হয়ে গেল ২০১৭ সালে।

তখন উপমহাদেশ পরাধীন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ক্ষমতাসীন। দুর্বার স্বাধীনতা আন্দোলন চলছে। তার মধ্যেই ১৯৩৫-এ ‘ভারত শাসন আইন’ প্রণয়ন করে সীমিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। সেই আইনের আওতায় ১৯৩৭-এর ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচন হয়। সমগ্র বাংলায় আসন ছিল ২৫০ টি। গরিব মানুষের ভোটাধিকার ছিল না। ভোট হয় পৃথক নির্বাচন প্রথায়। হিন্দু প্রার্থীদের হিন্দুরা, মুসলমান প্রার্থীদের মুসলমানরা। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে। তবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল আরও কিছু দল: হিন্দু মহাসভা, কৃষক প্রজা পার্টি প্রভৃতি। স্বতন্ত্র হিন্দু প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিলেন ৩৯ জন এবং মুসলিম স্বতন্ত্র ৪৩ জন। কংগ্রেসের মনোনয়নে ৫২ জন এবং লীগের মনোনয়নে ৩৯ জন নির্বাচিত হন।

সেই নির্বাচনে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, কিন্তু মারামারি হয়নি, জাল ভোট পড়েনি, দলীয় কর্মীদের ব্যালটে সিল মারার প্রশ্নই আসে না। তবে সবচেয়ে ভালো হতো যদি কংগ্রেস, কৃষক প্রজা পার্টি এবং হিন্দু ও মুসলমান স্বতন্ত্র সদস্যরা মন্ত্রিসভা গঠন করতেন। নেতাজির অগ্রজ শরৎ বসু চাইলেও কংগ্রেস হাইকমান্ড মুসলমানদের সঙ্গে সরকার গঠনে ঘোর আপত্তি করেন। ফজলুল হক অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুসলিম লীগের সঙ্গে সরকার গঠন করেন। লীগের ভাগ্য খুলে যায় এবং বদলে যায় বাংলা ও ভারতবর্ষের ইতিহাস।

দ্বিতীয় নির্বাচন হয় ১৯৪৬-এ, যা ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ম্যান্ডেট। বাঙালির তৃতীয় অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন হয় ১৯৫৪-তে, যা মুসলিম লীগের কবর খোঁড়ে। চতুর্থ নির্বাচন হয় ১৯৭০-এ, যা বঙ্গবন্ধুর উত্থান ঘটায় এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করে। সুতরাং স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে দিলে বাঙালি জানে কোন নির্বাচনে কাকে ভোট দিতে হয়।

আগামী নির্বাচন অতি চমৎকার সময়ে হতে যাচ্ছে। নির্বাচনের আগের কয়েক মাসের মধ্যে রমজান মাস। তারপর ঈদুল ফিতর। তারপর ঈদুল আজহা এবং দুর্গাপূজা। প্রাক্-নির্বাচন ইফতার পার্টি হবে পৃথিবীর সেরা ইফতার পার্টি। লেবুর শরবত, ছোলা, পেঁয়াজি, বেগুনি, হালিমের পাশাপাশি এবার কাচ্চি বিরিয়ানি ছাড়া যিনি ইফতার পার্টি দেবেন, তাঁর পক্ষে নির্বাচনী কর্মী খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে না। ইফতার পার্টি শুধু খানাপিনাতেই সীমাবদ্ধ নয়; অনেকের ইফতারির খাওয়া জুটুক না জুটুক, মার খাওয়াটাই হবে নিয়তি। ভোটের আগেই কতজন জখম হয় কে জানে।

ঈদে দামি পাঞ্জাবি-পায়জামা-কটি ও জুতা কেনার বড় অঙ্কের টাকা তো দিতেই হবে, সঙ্গে হাতখরচের পরিমাণটাও খুব অল্প নয়। তা ছাড়া, ঈদের পর থেকে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত চলবে ঈদ পুনর্মিলনী। প্রাক্-নির্বাচন ঈদ পুনর্মিলনী যে সবখানেই শান্তিপূর্ণ হবে, সেই সম্ভাবনা কম।

নির্বাচনপূর্ব কোরবানিতে যেমন-তেমন গরু হলে হবে না। গরুর আকার ও দাম নিয়ে চলবে প্রতিযোগিতা। প্রার্থীদের কেউ খোঁজ করবেন উপমহাদেশের সবচেয়ে উঁচু ও মোটাতাজা গরুটির। কেউবা গরুর সঙ্গে শুধু খাসি নয়, উটও কোরবানি দেবেন।

সব সম্প্রদায় ও শ্রেণি-পেশার মানুষকে খুশি করার এক অপূর্ব উপলক্ষ বঙ্গীয় নির্বাচন। স্থানীয় ভূমি অফিসের সঙ্গে যোগসাজশ করে বহু বিঘা অর্পিত সম্পত্তি নির্ঝঞ্ঝাটে ভোগদখল করার সৌভাগ্য হয়েছে যাঁর, তিনিও এলাকার মন্দিরে মন্দিরে যাবেন। বরাদ্দ টাকার প্যাকেটটা পুরোহিতের কাছে না দিয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিটির কাছে হস্তান্তর করে ছবি তুলবেন। আসার সময় বলে আসবেন: ‘শ্মশানের জমিটা কেউ দখল করার পাঁয়তারা করলে আমারে খবর দিবেন। সব সময় সংখ্যালঘুদের পাশে আমারে পাইবেন।’

এবারই প্রথমবার ভোট হবে, যখন সংসদ বহাল থাকবে। সুতরাং সংসদ সদস্যরা তো থাকবেনই। বিশ্বের সংসদীয় গণতন্ত্রে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নির্বাচন হয়। স্বপদে থাকেন শুধু স্পিকার। যিনি এমপি আছেন, নতুন নির্বাচনে তিনিই যদি প্রার্থী হন এবং নির্বাচিত হন, তাহলে তিনি ডবল এমপি হয়ে গেলেন। সংসদ রেখে নির্বাচনের এই অভিনব পদ্ধতিতেও ভালো হয় পুরোনো এমপিরা কেউই যদি প্রার্থী না হন। অবশ্য তাতেও সমস্যা আছে। পুরোনো এমপিরাও রইলেন এবং নতুন আরও ৩০০ নির্বাচিত হলেন, তাতে কিছু সময়ের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধির সংখ্যা দাঁড়াবে ৬৫০ জনে।

রোববার প্রথম আলো এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘ভোটের বছরে স্কুল ভবনের পর এবার নিজের এলাকায় মাদ্রাসা ভবন নির্মাণের সুযোগ পাচ্ছেন সাংসদেরা। প্রত্যেক সাংসদ অন্তত ছয়টি করে মাদ্রাসা ভবন তৈরি করবেন। এর বাইরে মন্ত্রীদের জন্য বরাদ্দ থাকবে আরও ২০০ মাদ্রাসা নির্মাণের টাকা। পুরো প্রকল্পটিতে খরচ হবে ৭ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা।...এর আগে অবশ্য চলতি অর্থবছরেই সাংসদদের জন্য আরও তিনটি প্রকল্প পাস করা হয়। এসব প্রকল্পে সাংসদদের ইচ্ছায় নতুন স্কুল ভবন, মসজিদ-মন্দির নির্মাণ করা হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এটি সাংসদদের নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ করার শামিল। এ ধরনের প্রকল্পের সুবিধা ভোগ করবে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল। ভোটের বছরে ভোটার তুষ্টির জন্যই এসব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।’

২০১৩ সালে যাঁরা ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে এসেছিলেন, মাদ্রাসা ভবন নির্মাণের প্রকল্প গৃহীত হওয়ায় তাঁদের আনন্দের সীমা নেই। ভোটারের সংখ্যা হিসেবে দেখলে তাঁরা কম নন। মাদ্রাসা শিক্ষার এমন পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারের প্রতি আমাদের মধ্যপ্রাচ্যের বন্ধুরা অত্যন্ত প্রীত ও প্রসন্ন হবেন। একমুখী শিক্ষার আর কোনো সম্ভাবনা রইল না। এক রাষ্ট্রে দুই-আড়াই রকমের নাগরিক তৈরি হবে, যা জাতীয় সংহতির পথে বড় অন্তরায়।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে যা হওয়ার তা হচ্ছে, এবার ঘনিয়ে আসছে সাধারণ নির্বাচন। এখন যেসব দেশে গণতন্ত্র আছে, সেগুলোর অনেক দেশের মানুষ ভোটাধিকার পেয়েছেন বাঙালির অনেক পরে। তাঁদের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশিদের চেয়ে ঢের কম। সেদিক থেকে আমরা ভাগ্যবান।

যে জাতি ৮০ বছর আগে থেকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করছে সেই জাতি, তার নেতারা ও কর্মকর্তারা জানেন নির্বাচন কী। কীভাবে আঙুলে কালি লাগিয়ে ব্যালট পেপার নিয়ে পর্দার আড়ালে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীর প্রতীকে ছাপ মারতে হয়। তারপর ভাঁজ করে ব্যালট বাক্সে ঢোকাতে হয়। কর্মকর্তারা জানেন সেই ব্যালট কীভাবে গুনে কোন প্রার্থী কত ভোট পেলেন তার ঘোষণা দিতে হয়। ১৯৩৭,১৯৪৬ এবং ১৯৫৪ পর্যন্ত তাঁরা জাল ভোট কথাটি শোনেননি। চার দশক যাবৎ জাল ভোটের সঙ্গে যোগ হয়েছে কারচুপি শব্দটি। তারপর ব্যালট বাক্স ছিনতাই। ভোটকেন্দ্রে বচসা ও মৃদু হাতাহাতি পর্যন্ত সহ্য করা যেত, কিন্তু গুলিবিদ্ধ হয়ে মরতে চায় না কেউ।

একুশ শতকে এসে বঙ্গীয় নির্বাচনে যোগ হয়েছে আরও দুটি নতুন উপাদান। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং চাহিবামাত্র ব্যালট পেপারের বান্ডিল ও ব্যালট বাক্স হস্তান্তর না করলে নির্বাচন কর্মকর্তাকে কেন্দ্রে তালাবদ্ধ করে রাখা। এখন প্রার্থী ও এজেন্টদের পকেটে থাকে পিস্তল আর ক্যাডারদের পকেটে তালা-চাবি-যাঁর যখন যেটা ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে।

এসব বিষয় আট দশকের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একটি জাতিকে বিশ্ববাসীর চোখে হেয়প্রতিপন্ন করে। সুতরাং আমাদের নেতাদের ভাবতে হবে, তাঁরা জাতির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবেন, না কালিমালিপ্ত করবেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক