তরুণদের আবেগকে সম্মান করুন

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা এই তরুণদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন
অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা এই তরুণদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন

কয়েক দিন ধরে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছে সারা দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন শুরু হয়েছে অনেক আগেই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ হয়েছে, মানববন্ধন হয়েছে, তরুণেরা তাদের দাবিগুলো তুলে ধরেছে। কিন্তু যাঁদের হাতে কোটা সংস্কারের ÿক্ষমতা, তাঁরা কেউ মন দিয়ে তাদের কথা শোনেননি। তরুণেরা কোটা পদ্ধতি তুলে দেওয়ার কথা বলেনি, বলেছে সংস্কারের কথা। এবং তাদের পক্ষে যুক্তি ছিল। সেই যুক্তিগুলোও কেউ গ্রাহ্য করেননি। কেউ ভাবেননি যে এই আন্দোলনের পেছনে তরুণদের আবেগের বিনিয়োগ আছে, স্বপ্নের বিনিয়োগ আছে। তারা তাদের ভবিষ্যতের জন্য, আত্মসম্মানের জন্য আন্দোলনে নেমেছে।

আমরা যারা দীর্ঘদিন এই তরুণদের সঙ্গে প্রতিদিন অনেকটা সময় কাটিয়েছি, তাদের আশা-নিরাশা ও প্রত্যাশার কথাগুলো শুনেছি, দেখেছি তারা নিজেদের চেষ্টায় ও মেধায় জীবনে একটা অবস্থান তৈরি করতে চেয়েছে। শিক্ষাজীবন শেষে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছে। এদের অনেকে এসেছে অসচ্ছল ও দরিদ্র পরিবার থেকে। এরা আশা করেছে একটা ভালো চাকরি নিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবে, বাবা-মাকে একটু স্বস্তি দেবে। তারা দেশকেও তাদের সাধ্যমতো কিছু দিতে চেয়েছে। সরকারি চাকরিকে তারা এর সবচেয়ে ভালো একটা উপায় হিসেবে দেখেছে। তাদের বিশ্বাস, মেধা থাকলে, ÿক্ষমতা থাকলে সরকারি চাকরি পাওয়া যায় এবং তাতে ঘুষ দিতে হয় না, কারও করতল তৈলাক্ত করতে হয় না। তারা দেখেছে, চাকরির বাজার চাহিদার তুলনায় ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। অনেক চাকরি আছে, সেগুলোতে সদর দরজা দিয়ে ঢোকা যায় না। তরুণেরা আবার সদর দরজাটা পছন্দ করে, তারা যোগ্যতা দিয়ে মাথা উঁচু করে সেই দরজাটা পার হয়ে নিজেদের সম্মান জানাতে চায়।

বাংলাদেশে একটা করপোরেট বাজার তৈরি হয়েছে, একটি করপোরেট সংস্কৃতিও তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেই বাজার এবং সেই সংস্কৃতি একটি মফস্বলের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ছাত্রকে-সে মেধাবী হলেও-গ্রাহ্য করবে না। কারণ, ওই ছাত্রকে সহজেই চমকের সমাজের অধিবাসী বিবেচনা করা যাবে না। বাংলাদেশের এনজিওগুলো একসময় ভালো চাকরি দিত, এখন বড় কিছু এনজিও ছাড়া অন্যগুলোর দিনকাল খারাপ। বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রতিবছর উন্নত হচ্ছে, আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি এখন সাতের ঘরে জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু আমরা কি সবার জন্য, বিশেষ করে শিক্ষিত যুবশ্রেণির জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পেরেছি? প্রতিবছর যে অসংখ্য শিক্ষিত তরুণ বুকে হাহাকার নিয়ে একটা চাকরির খোঁজে অফিস আর সওদাগরি পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়, তাদের কি আমাদের চোখে পড়ে?

আর একটা চাকরি পেলেই যে সব পাওয়া হয়ে যায়, তা-ও তো নয়। চাকরিটা, যে চাকরি পেল, তার মেধাকে কি মূল্য দিচ্ছে? যে চাকরি তার পাওয়ার কথা ছিল, তা কি সে পেয়েছে? নাচার হয়ে কেউ যদি এমন একটি চাকরি নেয়, যা তার প্রত্যাশারও অর্ধেক, তাহলে সেই চাকরি তাকে আত্মসম্মান দেবে না। যে চাকরিতে সম্মান থাকে না, তা গলায় একটা ফাঁস হয়েই থেকে যায়। আমি আমার অনেক ছাত্রছাত্রীকে দেখেছি, অসম্মানের চাকরি ছেড়ে বেকারত্বকে বেছে নিয়েছে। এদের আমরা কীভাবে সম্মানটা ফিরিয়ে দিতে পারি?

পারতাম যদি আমাদের চাকরির বাজারের সংস্কৃতিটা মানবিক হতো, যদি সেখানে ঊর্ধ্বতন-অধস্তনের সীমারেখা একটা উপনিবেশীয় ভাব নিয়ে হাজির না হতো, যদি অফিসের পরিসরটা হতো খোলামেলা, যেখানে প্রত্যেকের জন্য একটা সুন্দর জায়গা তোলা থাকত। একটি ছেলে তার বিয়ের বার্ষিকীতে রাত নয়টায় বাসায় ফিরে যদি স্ত্রীকে গলায় দুঃখ নিয়ে জানায়, তার বস তাকে অযথা বসিয়ে রেখেছেন, যেহেতু তিনি জানেন ছেলেটার জন্য দিনটা একটা উদ্যাপনের দিন। অথবা একটি মেয়ে যদি দুপুরে তার সন্তানকে স্কুল থেকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য বসকে এক ঘণ্টার ছুটি দিতে অনুরোধ করলে তিনি বলেন, তাহলে অফিসের পর এক ঘণ্টা থেকে এই অনুপস্থিতি পুষিয়ে দিতে হবে, তাহলে তাদের মনের অবস্থা কী হতে পারে, তা কি আমরা জানতে চেষ্টা করি? অথচ এ দুটি গল্প সত্য-এ রকম অনেক গল্পই আমার জানা।

আমাদের রাষ্ট্র কি কাজের সংস্কৃতিটাকে সংবিধানসম্মত করেছে? ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-শ্রেণিনির্বিশেষে এই সংস্কৃতিটাকে সবার জন্য কি উদার করেছে? কাজের বাজারে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে?

তরুণেরা বরং দেখেছে, এ দেশে বিত্ত ও ক্ষমতাশালীরা তাঁদের ইচ্ছামতো একটা সংস্কৃতি চালু করে দিয়েছেন, যাতে শোষণ ও বঞ্চনাটাই বড়। তরুণেরা দেখছে, দেশে দুর্নীতি কীভাবে সুস্থ চর্চাগুলোকে পঙ্গু করে দিচ্ছে, ব্যাংক লোপাট হচ্ছে, হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে, কিন্তু কারও কোনো বিচার হচ্ছে না। দেশে নির্যাতন-নিপীড়ন বেড়েছে, কিন্তু দুর্বৃত্তরা ধরা পড়ছে না। তরুণেরা যে আদর্শ নিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে, তার কোনো বাস্তবায়ন দূরে থাক, তার স্বীকৃতিটুকু একসময় কোথাও তারা দেখতে পায় না। তারা বরং দেখে ÿক্ষমতার দম্ভ, বিত্তের মহড়া। তাদের আশাভঙ্গের যে বেদনা, তা কি আমরা বুঝতে পারি? তা যে একসময় প্রবল ক্রোধে রূপ নিতে পারে, তা-ও কি আমরা আন্দাজ করতে পারি?

তারপরও তরুণেরা চেষ্টা করে জীবনের একটা ঠিকানার জন্য, একটা অবস্থানের জন্য, একটুখানি আত্মসম্মানের জন্য। অনেক বছর ধরেই আমি দেখছি, বিসিএস পরীক্ষাটাকে একটা অনিবার্য গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছে অসংখ্য তরুণ। সকাল সাতটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ লাইন দেখে ভাববেন না এরা সবাই নিজ নিজ বিষয়ে অধ্যয়নের জন্য গ্রন্থাগার খোলার অপেক্ষায়। তারা অপেক্ষায় বিসিএস বিষয় অধ্যয়নের জন্য। ক্লাসে অনেকে বিসিএস গাইড নিয়ে আসে। মনে কষ্ট লাগে, কিন্তু বুঝি, এটিই এখন বাস্তবতা। এখন ফেসবুকের যুগ। বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি পেয়ে কেউ যখন উচ্ছ্বসিত হয়ে সংবাদটি জানায়, তা অন্যদের জন্য একটা স্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায়। এই বিসিএস বাস্তবতা নিয়ে ঝগড়া করার কিছু নেই, বরং একে খোলামনে দেখতে হবে। বুঝতে হবে, এর পেছনে তরুণদের স্বপ্নের একটা বিনিয়োগ আছে। তারা যে নিজেদের বিষয় পাঠকে অবহেলা করে, তা-ও তো নয়। তারা ভালো ফল করে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে নিজেদের, পরিবারের, দেশের জন্য কিছু করতে চায়। করেও তারা, সুযোগ পেলেই করে। তাদের এই আশাটাকে কেন সম্মান জানানো হবে না?

তরুণদের আন্দোলনে ভুল-ভ্রান্তি থাকতেই পারে। যেমন এখন যে আন্দোলন চলছে, তাতে কিছু দুর্বৃত্ত ঢুকে পড়েছে, যাদের উদ্দেশ্য খুব অস্পষ্ট নয়। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়িতে বর্বরের মতো হামলা করেছে, চারুকলা অনুষদের ছাত্রছাত্রীদের নববর্ষ উদ্যাপনের জন্য তৈরি নানা সরঞ্জাম ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কিন্তু এদের দায় তো আন্দোলন যারা করছে, তাদের ওপর পড়ে না। উপাচার্য মহোদয় নিজেই বলেছেন, এরা শিক্ষার্থী নয়, এরা দুর্বৃত্ত। পুরো ক্যাম্পাস যখন কাঁপছে, কেন আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রথমেই শিক্ষার্থীদের দিকে জলকামান দিয়ে, টিয়ার গ্যাস শেল ছুড়ে একটা সংঘর্ষের দিকে একে নিয়ে যাবে? একটুখানি ধৈর্য ধরে এদের কথা শুনলে কেমন হতো? আর আমাদের গোয়েন্দা বাহিনীর অগোচরে দুর্বৃত্তরা উপাচার্যের বাড়িতে ঢুকে এমন বীভৎসতা যে দেখাল, তা-ও বা কেন হবে?

যারা আন্দোলন করছে, তারপরও তারা আলোচনার পথটি বেছে নিয়েছে। তারা সেতুমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসেছে। এখন সরকারের তরফে যত দ্রুত সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় ততই মঙ্গল। কিন্তু তাদের নিয়ে যেসব ক্ষোভের কথাবার্তা বলছেন সরকারের মন্ত্রী-সাংসদেরা, যে ভাষায় তাদের আক্রমণ করেছেন, তাতে তাদের ক্ষোভ বাড়লে দোষটা কার? আমার অবাক লাগে, সরকারের যেসব মন্ত্রীকে আমি একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় আগুন ঝরানো বক্তৃতা দিতে শুনেছি, আদর্শের প্রশ্নে আপসহীনতার পতাকা ওড়াতে দেখেছি, তাঁরাই এখন তরুণদের এই আন্দোলনকে পড়তে পারছেন না। কেউ তাদের গাল দিচ্ছেন, কেউ বলছেন তারা ষড়যন্ত্র করছে, কেউ বলছেন তারা রাজনীতি করছে। কিন্তু কেউ বলছেন না, এই তরুণেরা একটা ন্যায্য অধিকারের জন্য পথে নেমেছে, যেহেতু তাদের যুক্তির কথা কেউ শুনতে রাজি না। কেউ এ কথাও বলছেন না, এরা সরকারের বিরুদ্ধে অথবা সরকারি দলের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামেনি, নেমেছে নিজেদের একটি সম্মানজনক ও সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা এই তরুণদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিও এদের সমর্থন দিয়েছে। কারণ শিক্ষকেরা জানেন, এই তরুণেরা স্বপ্ন দেখে, তাদের আবেগ আছে পরিবার নিয়ে, দেশ নিয়ে। আমি একজন শিক্ষক হিসেবে জানি, এই তরুণদের আবেগকে, তাদের অহংকারকে যদি সম্মান জানানো হয়, তারাও তার প্রত্যুত্তর দেয়। তারা প্রত্যুত্তর দেয় দেশটাকে সেবা দিয়ে।

আমি আশা করব, যাঁরা বর্তমান কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করবেন, তাঁরা যেন আন্দোলনকারী তরুণদের ভুল না বোঝেন। এদের ভেতরে কিছু অনুপ্রবেশকারী থাকতে পারে, যাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন, কিন্তু সিংহভাগ তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করে, মুক্তিযুদ্ধকে স্মৃতিতে রাখে। তারাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।

এদের আস্থায় নিলে সরকারেরই লাভ হবে। এদের সম্মান জানালে এরাও প্রতিদান দেবে-একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ তারা দেশটাকে উপহার দেবে।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ