আসিফারা ফেরে না

শিশু আসিফার ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা কাঁপিয়ে দিয়েছে ভারতের বিবেকবান মানুষকে।
শিশু আসিফার ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা কাঁপিয়ে দিয়েছে ভারতের বিবেকবান মানুষকে।

‘মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায়...’! প্রায় মাস চারেক আগে জানুয়ারির ১০ তারিখে আট বছরের আসিফা, ডি নদীর তীরে বেড়ে ওঠা মেরির মতো, আমাদের মেঘনাপাড়ের আমিনার মতো তাদের গবাদিপশুগুলো ঘরে ফিরিয়ে আনার জন্য বের হয়। মা বলছেন, ভেড়া আর ঘোড়াগুলোকে খুবই ভালোবাসত আসিফা। ঘোড়ার মুখ দেখে আসিফা কি বুঝতে পেরেছিল তার তেষ্টা পেয়েছে? একটু দূরে একটা ঝিলের পাড়ে নিয়ে যায় তাদের জল খাওয়ানোর জন্য। জলপান করে ঘোড়া আর ভেড়ারা ফিরে আসে জম্মুর কটুয়া গ্রামে আসিফাদের বাড়ি। ফেরে না আসিফা। গুজ্জার সম্প্রদায়ের আট বছরের এত্তটুকু মেয়ে যে এখনো ডান হাত, বাঁ হাত চেনে না ঠিকমতো, সে কোথায় যাবে? অবলা প্রাণীগুলো বলতে পারে না কী দেখেছে তারা, ফেরেনি কেন আসিফা? 

কারা এই গুজ্জার?
কাশ্মীরের সবচেয়ে অচ্ছুত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী গুজ্জারদের মেয়ে আসিফাদের কেউ গুনতিতে ধরে না। গুজ্জাররা জম্মু-কাশ্মীরের প্রায় অস্পৃশ্য জাতিগোষ্ঠী। এদের মধ্যে বন গুজ্জারদের অবস্থা আরও খারাপ। ২০০৫ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর কাশ্মীরে কাজ করতে গিয়ে এই নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠীর সীমাহীন দারিদ্র্য আর সংখ্যাগুরু জাতিগোষ্ঠীর অবহেলা অনেক ত্রাণকর্মীর মতো এই লেখককেও নতুন এক সংকটের মুখোমুখি করে। যে যত গরিব, সে তত প্রান্তিক এলাকায় বাস করে। সেই হিসাবে পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচুতে তাদের আবাস। কঠিন শীতে তারা নেমে আসে সমতলে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ এলাকা জম্মু উপত্যকায়। শীতের শেষে মার্চ-এপ্রিলে আবার ফিরে যায় পাহাড়ের উঁচুতে। এদের প্রায় সবাই ইসলাম ধর্মের অনুসারী। কাশ্মীরও মুসলিমপ্রধান রাজ্য। কিন্তু গরিবদের ধর্ম যা-ই হোক, তাদের পরিচয় গরিবই থেকে যায় শেষ পর্যন্ত। পাহাড়ের কম উঁচু উর্বর অঞ্চলে বসবাসকারীরা ত্রাণের কোনো গাড়ি গুজ্জারদের গ্রামে যেতে দিতে রাজি ছিল না। বলা বাহুল্য, বাধা দেওয়া মানুষদের বেশির ভাগ ছিল মুসলিম। ধর্মের দোহাই দিয়ে কোনো কাজ হয়নি। এ রকম একটা অতিপ্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটা অভাগী বেটিকে যা খুশি তা-ই করা যেতেই পারে। হত্যা আর ধর্ষণকারীদের অঙ্কটা সে রকমই ছিল। অঙ্ক প্রায় মিলেই গিয়েছিল। যাযাবরের এক নাবালিকা লাপাত্তা—এ আর এমন কী! বনে-বাদাড়ে ঘুরতে গিয়ে বাঘ-ভালুকে খেয়ে থাকবে! বছর দুয়েক আগে কুমিল্লার তনুকেও তো কোনো এক বন্য প্রাণী মেরে রেখে গিয়েছিল! সংবাদমাধ্যমে এমন খবর ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা এ দেশেও হয়েছে।

মূলধারায় সংবাদমাধ্যমের নীরবতা
আসিফার নিখোঁজ আর তার ধর্ষণের শিকার বিকৃত লাশের হদিস পাওয়ার খবরে শুধু কাটুয়া নয়, জম্মু ও কাশ্মীরের সব গুজ্জার-অগুজ্জার গ্রাম যখন বিচার আর তদন্তের দাবিতে উত্তাল, তখন কাশ্মীরে চলছিল টিউলিপ পার্কের শানদার উদ্বোধন। আসিফার চেয়ে টিউলিপবাগানের ছবি তখন সংবাদমাধ্যমের কাছে অনেক বেশি আবেদনময় অনেক বেশি ফাটাফাটি লেগেছিল। টিউলিপের ছবি পর্যটক টানে, টাকা আনে, ব্যবসায়ীদের লাভ হয়। আসিফার কান্না তার বাবা-মায়ের আহাজারি যে হিন্দুস্তানের ছবি তুলে ধরে, তা কি পর্যটকদের আকর্ষণ করে? করে না। সংবাদমাধ্যম তাই বুঝি দেশের বৃহত্তর কল্যাণের কথা ভেবে চুপ থেকে যায়। ভেতরের পাতায় দুই ইঞ্চির বেশি জায়গা হয় না আসিফার খবরের। তাকে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে অজ্ঞান করে দিনের পর দিন মন্দিরের প্রধান আর তার ছেলে, ছেলের বন্ধুরা মিলে বলাৎকারের ঘটনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সেই বলাৎকার আর হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়ার কথা খবরে আসে না, চাপা পড়ে যায়।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে ভারতের একজন সিনিয়র সম্পাদক ও সাংবাদিক শেখর গুপ্ত রাজধানী দিল্লির মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলোর পক্ষপাতদুষ্ট চরিত্রের কথা স্বীকার করেন।

করব দিতেও বাধা
আসিফার লাশ দাফন করার সময়ও বাধা দেয় ধর্ষণ আর হত্যাকারীদের পক্ষের লোকজন। পুলিশের ধারণা, জম্বু থেকে এই গরিব গুজ্জারদের চিরদিনের জন্য বিদায় করে দেওয়ার জন্যই এ কাণ্ড ঘটানো হয়েছে। তারা যেন ভয়ে পালিয়ে যায়। তাই তারা লাশও দাফন করতে দেয়নি। আসিফার মা-বাবা এখনো ফেরারি, কোথায় আছেন কেউ জানে না। সংবাদকর্মীরা ফোনে আসিফার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি তাঁদের হদিস জানাননি। শুধু বলেছেন, বেঁচে আছেন বিচারের আশায়।

মোদীও বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘নিশ্চিতভাবেই বিচার হবে’। কিন্তু এমন শীতল উত্তরে সন্তুষ্ট হয়নি প্রতিবাদীরা।
মোদীও বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘নিশ্চিতভাবেই বিচার হবে’। কিন্তু এমন শীতল উত্তরে সন্তুষ্ট হয়নি প্রতিবাদীরা।

বিচার হবে কি
বিচার, চার্জশিট, তদন্ত—এসব ঠেকানোর জন্য ক্ষমতাসীন বিজেপির সব পর্যায়ের নেতা আর প্রশাসন জানকবুল চেষ্টা করেছেন। জম্মুর আইনজীবীদের বার এককাট্টা হয়ে চার্জশিট দাখিলের সময় আদালতের দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখে। দুই মন্ত্রী তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে মাঠে নামেন অপরাধীদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে। ১১ এপ্রিল জম্মুতে যে হরতাল হয়, তাতে যোগ দিয়ে রাস্তা মাতিয়ে রেখেছিল বার অ্যাসোসিয়েশন। শুধু কি বার অ্যাসোসিয়েশন আর বিজেপির এমএলএ, মন্ত্রী, সাংসদ? শিশু ধর্ষণ নির্যাতন আর হত্যার পক্ষে সাফাই গাওয়ার লোকের কোনো অভাব ‘আধুনিক’ হিন্দুস্তানে নেই। এক নামজাদা ব্যাংকের ম্যানেজার তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ভালোই হয়েছে, মেয়েটাকে মেরে ফেলা হয়েছে। না হলে বড় হয়ে ওই মেয়েই ভারতের ওপর বোমা ফেলত। অবশ্য সব ভারতীয় এটাকে সমর্থন করেছেন, তা বলা যাবে না। এই পোস্ট নিয়ে অনেক ঝড় উঠেছে। শেষ পর্যন্ত ব্যাংক তাদের ম্যানেজারকে বরখাস্ত করেছে। কিন্তু কারণ দেখাতে গিয়ে আবার তারা রাজনীতি করেছে। জানিয়েছে, কাজে অবহেলার জন্য এই বরখাস্ত। এসব থেকেই অনুধাবন করা যায়, ভারতের রাজনীতির নৌকা কতটা নির্মম হচ্ছে দিন দিন।

পরিস্থিতি কি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে
চার মাস একটা শিশু অপহরণ, ধর্ষণ আর পরিকল্পিত খুনের ঘটনা চেপে রাখার পরও যখন আড়াল করা যায়নি, তখন শুধু দুজন মন্ত্রীর পদত্যাগ দিয়ে এ যাত্রায় কাশ্মীরের জোট সরকার দম নেওয়ার সময় পেলেও বিচার ঠেকানো যাবে কি? অবশ্য বিচারকদের ওপরও কাশ্মীরের মানুষের ভরসা কম। শুধু কি কাশ্মীরে? কোথাও কি গরিব মানুষ এখন আর ভরসা পাচ্ছে। ভয়ে গা ঢাকা দেওয়া আসিফার পরিবার কীভাবে কোর্টে হাজির হয়ে সওয়াল-জবাবে অংশ নেবে? সাক্ষীই-বা তারা কোথায় পাবে? তদন্তকারী দল এখন পর্যন্ত সব আলামত হাতে পেয়েছে। পুলিশদের সম্পৃক্ততা এবং অপরাধীদের সঙ্গে যোগসাজশ-লেনদেন ধর্ষণে অংশগ্রহণ সবই তদন্তে উন্মোচিত হয়েছে। ধৃত ঘাতক ও ধর্ষণকারীর স্বীকারোক্তিও পাওয়া গেছে। এসব প্রকাশের পরেই পরিস্থিতি চটজলদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির নিজের ভাইও এখন বিচার চেয়ে মানুষের মিছিলে যোগ দিয়েছেন।
মূলধারার কাশ্মীরিদের কাছে যে গুজ্জাররা ছিল অবহেলিত, তাদেরই এক কচি শিশুর করুণ পরিণতি কাশ্মীরের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব মানুষকে প্রতিবাদী করে তুলেছে। সময় লেগেছে চার মাস। দিল্লির সেই মেডিকেল ছাত্রীর ধর্ষণ আর হত্যাচেষ্টার মতো এই প্রতিবাদের ঝড় সঙ্গে সঙ্গে ওঠেনি ঠিকই, তবে ক্রমেই আসিফার নির্যাতন আর হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় বেগবান হচ্ছে। বন্ধ হোক সব অনাচার, শিশু নির্যাতন, গুম, খুন, ধর্ষণ। কোনো কবি যেন আর না লেখে,
আমরা যাইনি ম’রে আজো—তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়:
মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নায় প্রান্তরে
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন—এখনো ঘাসের লোভে চরে।

পুনশ্চ: যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমসের ভাষায় বললে, বড় বড় শহরে হাজারো মানুষের প্রতিবাদ, বিরোধীদের চাপে কোণঠাসা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ইতিমধ্যে জম্মুর দুজন বিজেপি মন্ত্রী পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। তাঁরা ধর্ষকদের পক্ষে মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। এরই মধ্যে উত্তর প্রদেশেও এক কিশোরীর ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে মানুষ। মোদীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী যোগী আদিত্যনাথের এক সহযোগী নেতাসহ স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও। ইতিমধ্যে সেই সহযোগী গ্রেপ্তার হয়েছেন। মেয়েটি মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তার বাবা পুলিশি হেফাজতে মারা যান। আন্দোলন চলছে এসবের প্রতিবাদেও।

গওহর নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণকর্মী এবং শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।