তরুণদের চাওয়াগুলো বিবেচনায় নিন

বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেটের বিস্তার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উত্থান এবং সর্বোপরি সমস্যা সমাধানকেন্দ্রিক শিক্ষার চাহিদা এতটাই বেড়েছে যে উন্নত দেশগুলো তাদের মেধা-মননের একটা বড় অংশই এ কাজে ব্যয় করছে। উদ্দেশ্য একটাই, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় নিজেদের তারুণ্যকে তৈরি করা। জাতিসমূহের তাই একটা বড় কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে তৃণমূল পর্যায়ে উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়া, শিক্ষাকে সহজলভ্য করা এবং কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের পরেই এখন উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড মানুষের মৌলিক চাহিদায় পরিণত হয়েছে।

তবে আমরা সম্ভবত এই ভূগোলকে ব্যতিক্রমী দেশ হিসেবে নিজেদের চিহ্নিত করছি। ঢাকার বাইরে ব্রডব্যান্ডের বিকাশের কথা ধরা যাক। এটিকে নিঃসন্দেহে শূন্যের কোঠায় ধরা যায়। সম্প্রতি আমার পরিচিত এক তরুণ দক্ষিণে নিজের জেলা শহরে ফিরে গেছেন ব্রডব্যান্ড সেবা দেওয়ার জন্য, চালু করেছেন নিজের আইএসপি প্রতিষ্ঠান। সেখানে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেছেন-ঢাকায় যে পাইকারি দরে ব্যান্ডউইটথ কিনতে পাওয়া যায়, তাঁর শহরে সেটি কিনতে হয় তিন গুণ দামে। ঢাকায় সেকেন্ডে প্রতি মেগাবিট ব্যান্ডউইটথের দাম ভ্যাটসহ ৬৯০ টাকা। কিন্তু বেচারাকে কিনতে হয় মাত্র ২ হাজার ১২ টাকায় (২,০১২) ! শুধু তা-ই নয়, আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশই ইউটিউবসহ গুগলের অনেক সেবা ব্যবহার করে। এ জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান আলাদা করে সার্ভার বসিয়ে এই সেবা দেয়। একে বলা হয় গুগল গ্লোবাল ক্যাশ (জিজিসি)। ঢাকা শহরের ছোট আইএসপিগুলো এই সেবা কিনতে পারে সেকেন্ডপ্রতি মেগাবিট ৫০ থেকে ১০০ টাকায়। কিন্তু আমাদের যুবাটিকে কিনতে হয় মাত্র ৬৯০ টাকায়! এত দামে ব্যান্ডউইটথ কিনে যখন তিনি ভোক্তাদের পৌঁছে দিতে চান, তখন ভোক্তা পর্যায়ে দামটা কেমন হয়?

অথচ এখন আমরা সবাই জানি, ১ হাজার নতুন সংযোগ ৮টি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, আর সেই কর্মসংস্থানকে কেন্দ্র করে বিকাশ ঘটে সৃজনশীল অর্থনীতির। সৃজনশীল অর্থনীতির প্রাণভোমরা হলো ডিজিটাল এক্সাইটমেন্ট বা চাঞ্চল্য। এর কারণে বিশ্বের বড় ট্যাক্সি কোম্পানির (উবার) নিজের কোনো ট্যাক্সি থাকে না, সবচেয়ে বড় দোকানের (আলিবাবা ডট কম) নিজের কোনো মজুতও থাকে না। কিন্তু আমরা কী আমাদের তরুণদের সে রকম কোনো পরিবেশ দিচ্ছি, যা তাঁকে নতুন যুগের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে উৎসাহিত করবে?

সর্বশেষ হিসাবে দেশের প্রায় পৌনে পাঁচ কোটি লোক কর্মহীন। এদের একটি বিরাট অংশ চাকরির চেষ্টা বাদ দিয়েছে। কারণ, হরেদরে বছরে যত কর্মসৃজন হয়, চাকরিপ্রত্যাশীর সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে রয়েছে চাকরি পরীক্ষার জন্য দুর্গম অঞ্চল থেকে ঢাকায় আসার খরচ! এদের একটা অংশকে কেমন করে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা যায়, সেটি কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? নাকি আমরা প্রতি পদে পদে তার জন্য নানা রকম বাধা তৈরি করছি?

উদ্যোগের শুরুই হয় একটি ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে। সেই ব্রিটিশ আমলের আইনের আওতায় এখনো এই দেশে ট্রেড লাইসেন্স করতে হলে ‘বর্গফুট’ জায়গা থাকতে হয়। কিন্তু এই ডিজিটাল যুগে এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়, যার কোনো অফিস লাগে না। নিজের বিছানায় ল্যাপটপ খুলে চালু করে দেওয়া যায় বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান। ওই তরুণের কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র আছে, কিন্তু সেটি দিয়ে তাঁর ট্রেড লাইসেন্স হয় না। তাঁকে ঘরভাড়ার একটি জাল দলিল তৈরি করতে হয় বটে! মিথ্যা দিয়ে শুরু করা উদ্যোগটি যখন বিকশিত হতে শুরু করে, তখন তার পাশে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে দাঁড়াতে দেখা যায় না। কারণ, আমাদের ব্যাংকগুলো এখনো বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের পরিমাপ করতে পারে না।

ফলে একজন তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা যখন ব্যাংকে যান, তখন ব্যাংক তাঁর স্থাবর সম্পত্তির হিসাব চায়। অথচ মাত্র ৫৫ জন তরুণের হাতে তৈরি ‘হোয়াটস আপ’ নামের একটি যোগাযোগের সফটওয়্যার বেচাকেনা হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলারে! অন্যদিকে আমাদের দেশেও বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং করে যেসব প্রতিষ্ঠান, তারা এরই মধ্যে ৪০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান করেছে মাত্র সাত-আট বছরে। এসব প্রতিষ্ঠানের মূল যে সম্পদ, ‘তাঁরা রাত হলে বাসায় গিয়ে ঘুমান’। সেটির মূল্যায়ন হচ্ছে না বলে প্রতিষ্ঠানগুলো বড় হতে পারছে না।

বাংলাদেশ কলসেন্টার ও আউটসোর্সিং অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আহমাদুল হক সেদিন কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, সরকারের বেশ কিছু কাজ বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশে দাঁড়ালে আগামী কয়েক বছরে এই খাতে লক্ষাধিক নতুন কর্মসৃজন সম্ভব। গেল বছরের বাজেট বক্তৃতা অনুসারে ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছর নতুন ১৩ লাখ কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবছর আমাদের দেশে প্রায় ২২ লাখ ছেলেমেয়ে কর্মবাজারে প্রবেশ করছে এবং এটি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি কিন্তু আশানুরূপভাবে হচ্ছে না। অথচ বাংলাদেশে বিদেশিদের কর্মসংস্থান বাড়ছে ভয়াবহভাবে। বছর তিনেক আগেও দেশে কর্মরত বিদেশিরা ৩১৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স তাঁদের দেশে পাঠাতেন। এখন সেটি ৫০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। বিদেশিদের একটি বড় অংশ কাজ করছেন গার্মেন্টস এবং কয়েকটি বিশেষায়িত সেক্টরে। বলা হয়, দক্ষতার অভাবে আমাদের কর্মীরা এগিয়ে যেতে পারছেন না।

আমরা কথায় কথায় বলি, বাংলাদেশ তরুণদের দেশ। সেই কথার প্রতিফলন আমরা দেখতে চাই এবারের বাজেটে। সারা দেশে তরুণেরা যাতে একই দামে ইন্টারনেট সেবা পেতে পারেন, তার ঘোষণা দেখতে চাই বাজেটে। আমরা চাই, আমাদের তরুণদের গার্মেন্টস এবং সহায়ক শিল্প, যেখানে বিদেশিরা কাজ করছেন, তার উপযোগী করে গড়ে তুলতে বিশেষ উদ্যোগ। দেখতে চাই ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ট্রেড লাইসেন্স আইন কেবল সংশোধনই হয়নি, আমাদের তরুণ উদ্যোক্তা ঘরে বসেই তাঁর কাঙ্ক্ষিত লাইসেন্সটি পেয়ে যাচ্ছেন। আমরা দেখতে চাই, আমাদের ব্যাংকগুলো ঘটি-বাটির মতো মেধা-বুদ্ধিকে দাম দিতে শিখেছে। আমাদের প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে। এমন তরুণবান্ধব বাজেট আমাদের এটুকু আস্থা দেবে যে সরকার তরুণদের ভুলে যায়নি!

মুনির হাসান: প্রথম আলোর যুব কর্মসূচি সমন্বয়ক