ধর্ষণের বিরুদ্ধেও কি আমরা জাগতে পারি না?

আমরা কি ধরেই নিয়েছি ধর্ষণের প্রতিকার কিংবা প্রতিরোধ অসম্ভব? প্রথম আলো ফাইল ছবি
আমরা কি ধরেই নিয়েছি ধর্ষণের প্রতিকার কিংবা প্রতিরোধ অসম্ভব? প্রথম আলো ফাইল ছবি

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবির চতুর্থ দিনে ছাত্র বিক্ষোভে উত্তাল ছিল ঢাকাসহ সারা দেশ। সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশে। স্থবির হয়ে যায় সেদিন ঢাকার চাকা। সেদিন ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষ আরেকবার প্রত্যক্ষ করে তারুণ্যের ক্ষমতা। প্রমাণিত হয়, যদি লক্ষ্য হয় অটুট, সংকল্পে থাকে দৃঢ়তা আর আন্দোলনে থাকে সমন্বয়, তবে যেকোনো অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলতে সক্ষম তরুণসমাজ। তারা পারে যেকোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা ঘটাতে। তরুণেরা যেদিন আন্দোলনের চরম উত্তেজনাকর মুহূর্তগুলো পার করছিল, ঠিক সেদিনই বেশ কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছিল ধামরাইয়ের শ্রীরামপুরে চলন্ত বাসে একজন পোশাককর্মীর ধর্ষণের শিকার হওয়ার খবরটি। এ ছাড়া চোখে পড়েছে শিশুসহ আরও কয়েকজন নারী ধর্ষণের খবর। রোজ সংবাদপত্রের পাতায় একাধিক ধর্ষণের খবর আজ আর আমাদের বিচলিত করে না। তবে কি আমাদের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে, নাকি ধর্ষণের বিষয়টি মামুলি কোনো অপরাধে পরিণত হয়েছে? নাকি আমরা ধরেই নিয়েছি ধর্ষণের প্রতিকার কিংবা প্রতিরোধ অসম্ভব!

গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায়, সারা বাংলাদেশে গত ১৩ মাসে মোট ২১ জন নারী গণপরিবহনে ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এই গণপরিবহনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বাস, প্রাইভেট কার, অটোরিকশা ও ট্রাক। অন্যদিকে, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৭ সালে মোট ৮১৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ৪৭ জন নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ ২০১৭ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৬৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের ‘শিশু অধিকার পরিস্থিতি-২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৭ সালে মোট ৫৯৩টি কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২১টি শিশুকে। অর্থাৎ ২০১৭ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৪৯টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। দুটি পরিসংখ্যানকে এক করলে যা পাওয়া যায়, তা হলো ২০১৭ সালে প্রতি মাসে ১১৭ জন হিসাবে বছরে প্রায় দেড় হাজার নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে বাংলাদেশে। এ তো গেল শুধু রিপোর্টকৃত ধর্ষণের ঘটনার পরিসংখ্যান। তবে এই সংখ্যার কয়েক গুণ বেশি ঘটনা রয়ে গেছে পর্দার অন্তরালে; যেহেতু ধর্ষণের অধিকাংশ ঘটনাই অপ্রকাশিত থাকে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষুব্ধ তরুণসমাজের প্রতিবাদ দেখে সেদিন মনে হয়েছিল, তারা সমাজ কি পারে না ধর্ষণের বিরুদ্ধে এ রকম একটি গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে? যে আন্দোলন প্রতিরোধ ও প্রতিকার করবে ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সব সহিংসতা ও যৌন নির্যাতন!

অ্যাকশন এইড কর্তৃক বিশ্বের অনিরাপদ ১০টি দেশে পরিচালিত নগরে নারী ও মেয়েশিশুর প্রতি সহিংসতাবিষয়ক ‘কার শহর?’ শীর্ষক গবেষণায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ষষ্ঠ। ‘এ’ থেকে ‘ডি’ গ্রেডের মধ্যে বাংলাদেশ আছে ‘ডি’ গ্রেডে। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা, আইনের বাস্তবায়ন না হওয়া, জেন্ডারবান্ধব নগর-পরিকল্পনার অভাব, নারী ও মেয়েশিশুর জন্য সীমিত ও অনিরাপদ গণপরিবহনব্যবস্থা বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম বড় কারণ। এ ছাড়া সহিংসতা নিরসনে ও জেন্ডারবান্ধব গণপরিবহন নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনায় নেই পর্যাপ্ত বাজেট। নারীর জন্য নিরাপদ নয় আমাদের ফুটপাত, গণপরিবহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, হাসপাতাল, এমনকি থানাসমূহ। গবেষণাটিতে নগর-পরিকল্পনায় জেন্ডার সংবেদনশীলতার বিষয়ে বাংলাদেশের মান শূন্য। এ-ই যখন বাস্তব অবস্থা- তখন ঢাকা দক্ষিণের নগরপিতা ব্যস্ত সড়ক ঝাড়ু দিয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখানো নিয়ে। কিন্তু প্রতিদিনের রাস্তায় ফাঁদ পেতে থাকা হায়েনার দলকে কোন ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করা যাবে, তা জানতে বড় ইচ্ছে করে। আর কোন ক্ষমতাধর বাবা বা মা এই কুলাঙ্গারদের শায়েস্তা করার দায়দায়িত্ব নেবেন, তাও ভাবনার বিষয়। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই নারী ধর্ষণে ও নির্যাতনে অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে বাংলাদেশের নাম উঠবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে। এর জন্য বোধ করি কোনো বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে না। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে দুরুদুরু বুকে নগরের ব্যস্ত সড়কে কিংবা ফাঁকা গলিতে যে কী এক বিভীষিকাময় পথ চলতে হয় নারীকে, তা একমাত্র তিনিই জানেন। নববর্ষ বরণের মতো সর্বজনীন একটি উৎসবে যোগ দিতে গিয়েও নারীকে ভাবতে হয় তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লক্ষ করেছি, অনেকেই নারীকে বাইরে বের হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। তাঁরা নারীকে বলেছেন নিজের আত্মরক্ষার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে। কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছেন হাতব্যাগে সেফটিপিন-জাতীয় তীক্ষ্ণ কিছু এবং অতিরিক্ত ওড়না কিংবা কাপড় রাখতে।

নারীকে হেনস্তাকারী এই পুরুষদের প্রতিরোধে কি আমরা আরেকটি গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি না? সেই আন্দোলন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পাওয়ার উদ্দেশ্যে ঝাড়ু হাতে কোনো লোকদেখানো আন্দোলন হবে না। বরং সে আন্দোলন হবে এমন কার্যকর আন্দোলন, যা স্বল্পতম সময়ে ধর্ষণসহ সব ধরনের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করে বাংলাদেশকে সম্মানের সঙ্গে স্থান করে দেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে। এই আন্দোলন ধর্ষক ও নিপীড়কের প্রতি শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি অবলম্বন করবে। এর ভাষা হতে হবে বোধোদয় ও সমস্যা চিহ্নিত করার মতো ক্ষুরধার। দ্রুততম সময়ে অপরাধীদের আইনি প্রক্রিয়ায় আনতে এবং তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে, এই আন্দোলন সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে গড়ে তুলবে সামাজিক প্রতিরক্ষার বেষ্টনী। কাজটি কিন্তু মোটেই সহজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন দৃঢ় সংকল্প, কার্যকর পদক্ষেপ এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রচুর বিনিয়োগ। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে।

নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সব সংগঠনকে এক হয়ে কাজ করতে হবে তরুণদের সঙ্গে। তাজা তরুণ রক্ত যারা এককালে নেতৃত্ব দিয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরতন্ত্র পতন আন্দোলন, তারা যে ঘুমিয়ে পড়েনি, তা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে সম্প্রতি কোটা সংস্কার দাবির আন্দোলনে। মোবাইল ফোন, প্রযুক্তি, ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়াকে সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগিয়ে কীভাবে রাতারাতি একটি আন্দোলনকে সংগঠিত করতে হয়, তা দেখিয়ে দিয়েছে ‘মিলিয়নিয়ার্স’ বা সহস্রাব্দের প্রজন্ম। তাই এগিয়ে এসো তরুণ প্রজন্ম। আরেকটিবার দেখাও তোমার ক্ষমতা। বাংলাদেশকে মুক্ত করো ধর্ষণ আর নারী নির্যাতনের অভিশাপ থেকে।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক।
[email protected]