ক্যাম্পাসে হেলে পড়া শ্বেতকপোত এবং কানামাছি খেলা

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন। প্রথম আলো ফাইল ছবি
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন। প্রথম আলো ফাইল ছবি

গত সোমবার ক্যাম্পাস থেকে পুলিশ কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী তিন শিক্ষার্থীকে ‘জিজ্ঞাসাবাদের’ জন্য ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে আন্দোলনকারীরা ভয়ভীতিতে আছেন। তাঁদের একজন হলের বাইরে থাকেন, অন্যরা হলে থাকলেও খুব একটা বের হননি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও একধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি এএসএম মাকসুদ কামালের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রভোস্ট কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি আলোচনা হয়েছে। গত সোমবারের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সে বিষয়ে পুলিশ প্রশানকেও বলা হয়েছে।

গতকাল ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) কলাভবন, ছাত্রাবাস-সবখানে ছিল থমথমে ভাব। এরই মধ্যে ক্লাস-পরীক্ষা হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা কেউ মুখ খুলে কিছু বলছেন না। পরশুর ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও হতবিহ্বল। এরই মধ্যে শিক্ষক লাউঞ্জে এক নারী শিক্ষক আরেক নারী শিক্ষককে ঠাট্টা করে বললেন, ‘তুই মার খাসনি?’

ছাত্র আন্দোলন নিয়ে একজন শিক্ষকের এ মন্তব্য নির্মমই মনে হলো।

আলাপকালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বললেন, ৮ এপ্রিলের সংঘাত ঠেকাতে তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও পুলিশ উভয়ই ছিল বেপরোয়া। তাঁর দাবি, যাঁরা আন্দোলনে প্রকাশ্যে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরা সঠিক পথেই ছিলেন। পরে অন্য কোনো পক্ষ তাঁদের বিপথগামী করেছে। তাঁর ইঙ্গিত বাম ছাত্রসংগঠনের নেতাদের প্রতি।

তবে কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী একজন দৃঢ়ভাবে তাঁর ওই বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেছেন, আন্দোলনের পাঁচ নেতার চারজনই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অপরজন কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। তিনি যোগ করেন, ‘আন্দোলনকে যাতে কেউ ভিন্ন খাতে না নিয়ে যেতে পারে, সে জন্য আমরা শুরু থেকে সজাগ ছিলাম। বাম-ডান-মধ্য-কোনো ছাত্রসংগঠনকে ভিড়তে দিইনি। পুলিশ নির্বিচারে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে শতাধিক শিক্ষার্থীকে আহত না করলে আন্দোলন আগাগোড়া শান্তিপূর্ণ থাকত।

আলাপকালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, ‘এটি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। আমরা পকেটের পয়সা খরচ করেছি, কেননা এতে আমাদের প্রত্যেকের স্বার্থ রয়েছে। অথচ এখন নানা ধরনের অপপ্রচার চলছে।’ এ ব্যাপারে তিনি একটি পত্রিকার প্রতিবেদনকে দায়ী করে বলেন, ‘তাঁর বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বরাবর আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে এসেছেন। তারপরও তাঁকে বিএনপির লোক বানানো হয়েছে। পরে অবশ্য পত্রিকাটি দুঃখপ্রকাশ করেছে। কিন্তু যা ক্ষতি হওয়ার, তা হয়েছে।’

হাসান আল মামুন বলেন, ‘আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছি। কিন্তু উপাচার্যের বাসভবনে হামলা নিয়ে যে মামলা হয়েছে, সে সম্পর্কে কিছু বলিনি। অথচ প্রচার চালানো হচ্ছে, আমরা উপাচার্যের বাসভবনে হামলার মামলাও প্রত্যাহার চাইছি। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের কেউ উপাচার্যের বাসভবনে হামলা চালাননি। তাহলে কারা সেখানে হামলা করেছে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি নিজের মোবাইল সেটে রক্ষিত এটিএন বাংলার একটি ভিডিও ক্লিপ দেখালেন, যাতে উপাচার্যের বাসভবনে ঢুকছেন এমন এক তরুণের ছবি আছে, যাঁর পোশাকের পেছনে লেখা ঢাকা কলেজ।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের এই নেতা কোটা সংস্কার আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আমরা আন্দোলন স্থগিত করেছি। এখন নানা মহল আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। একজন মন্ত্রীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা হচ্ছে। অথচ এই আন্দোলনে আমরা মুক্তিযোদ্ধা কোটা সম্পর্কে কিছু বলিনি। আমরা কোটা যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসার কথা বলেছি। কোনো নির্দিষ্ট কোটা বাতিল করতে বলিনি।’

গত কয়েক দিন ক্যাম্পাস ঘুরে মনে হয়েছে, আমাদের দেশে রাজনৈতিক বা ছাত্র আন্দোলন নেতারা পরিচালনা করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনটি চালিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরাই।

গতকাল দুপুরে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাই, চারুকলার সামনে দেখি সড়ক বিভাজকে রাখা মঙ্গল শোভাযাত্রার বাঁশের খাঁচার ওপর বসানো শ্বেতকপোত একদিকে হেলে পড়েছে। ঝড়বৃষ্টির কারণেও সেটি হতে পারে। মনটা বিষণ্ন হলো। মানুষের তৈরি হলেও শ্বেতকপোতকে আমরা ঊর্ধ্বমুখী দেখতে চাই। বিকেলে ফেরার পথে চোখে পড়ল, খাঁচাটি সোজা। সেই সঙ্গে খাঁচার ওপরে থাকা শ্বেতকপোতটিও। হয়তো কেউ দায়িত্ববোধ থেকে কাজটি করেছেন।

এর আগে কলাভবনের সামনে একদল শিক্ষার্থীকে দেখলাম, ক্লাসের ফাঁকে কানামাছি খেলছেন। একবার একটি ছেলের চোখ বেঁধে দিয়ে চারপাশ থেকে বন্ধুরা তাঁকে ছুঁয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, ‘বল তো আমি কে?’ চোখ বাঁধা ছেলেটি কাউকে শনাক্ত করতে না পেরে চারদিকে হাতড়াচ্ছেন। আরেকবার একটি মেয়েকেও একই পরীক্ষায় ফেলা হলো। মনে হলো, তিনিও কাউকে শনাক্ত করতে পারছেন না।

সঙ্গে থাকা সহকর্মী গোলাম মর্তুজার কাছে জিজ্ঞেস করি, সরকারও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কানামাছি খেলছে কি না। তিনি মৃদু হাসলেন। ক্যাম্পাসে হেলে পড়া শ্বেতকপোত ও কানামাছি খেলা-দুটোই প্রতীকী মনে হলো।