হার্ট অ্যাটাক: বাংলাদেশ-পরিস্থিতি, সচেতনতা ও আধুনিক চিকিৎসা

২০ মার্চ ২০১৮, প্রথম আলোর আয়োজনে এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সহযোগিতায় ‘হার্ট অ্যাটাক: বাংলাদেশ–পরিস্থিতি, সচেতনতা ও আধুনিক চিকিৎসা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো।

যাঁরা অংশ নিলেন
আব্দুল মালিক: জাতীয় অধ্যাপক, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ
কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: চেয়ারম্যান, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)
এ কে এম মহিবুল্লাহ: সভাপতি, বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটি
খন্দকার আব্দুল আউয়াল রিজভী: মহাসচিব, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ
ফজিলাতুন্নেসা মালিক: বিভাগীয় প্রধান, কার্ডিওলজি বিভাগ, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট
মোহাম্মদ আরিফুল আলম: কর্মসূচি প্রধান, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচি, ব্র্যাক
সোহেল রেজা চৌধুরী: বিভাগীয় প্রধান, এপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট
তওফিক শাহ্‌রিয়ার হক: সহযোগী অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট
মোহাম্মদ মিজানুর রহমান: এজিএম, মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ডিপার্টমেন্ট, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লি.
গওহার নঈম ওয়ারা: উপদেষ্টা, প্রথম আলো

সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনায় সুপারিশ
 হার্ট অ্যাটাক মোকাবিলায় প্রতিরোধের ওপর জোর দিতে হবে
 অস্বাস্থ্যকর খাবার ও তামাক পরিহারের পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি
 রোগীদের মানসম্মত চিকিৎসার জন্য চিকিৎসাব্যবস্থার সমন্বয় করতে হবে
 হৃদ্‌রোগের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন
 স্বাস্থ্যবিমা প্রবর্তন করে রোগীদের সুষ্ঠু চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে
 চিকিৎসাসেবাকে ঢাকা শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা প্রয়োজন

আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম: হার্ট অ্যাটাক (হৃদ্‌রোগ) বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পরিণত হয়েছে। এ ঝুঁকি মোকাবিলায় সচেতনতা একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সচেতন হয়ে হার্ট অ্যাটাক থেকে দূরে থাকা সম্ভব। আজ বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে হার্ট অ্যাটাক পরিস্থিতি, প্রতিরোধ ও প্রতিকারে সচেতনতার ভূমিকা এবং আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হবে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় বিভিন্ন দিক আসবে। এখন আলোচনার সূচনা করবেন আব্দুল মালিক।

আব্দুল মালিক
আব্দুল মালিক

আব্দুল মালিক
হার্ট অ্যাটাক শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের সমস্যা। এ ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাব একটি বড় কারণ। হৃদ্‌রোগ এক দিনে হয় না। অনেক সময় জীবনযাপনে বেপরোয়া হওয়ার কারণে রোগটি হয়। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, কায়িক পরিশ্রম না করা, তামাকজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার এবং দুশ্চিন্তা করোনারি হৃদ্‌রোগের অন্যতম কারণ।
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে হৃদ্‌রোগের চিকিৎসায় অনেক উন্নতি হয়েছে। হার্ট অ্যাটাক মোকাবিলায় দুই ধরনের সচেতনতা প্রয়োজন। প্রথমত, রোগ প্রতিরোধ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত, হার্ট অ্যাটাক হলে সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা নিতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে হার্ট অ্যাটাকের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। রাজধানী ঢাকা শহরের বাইরেও এই চিকিৎসা–সুবিধা নিয়ে যেতে হবে। হার্ট অ্যাটাকমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে চিকিৎসক, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বিত কার্যক্রম প্রয়োজন।

ফজিলাতুন্নেসা মালিক
ফজিলাতুন্নেসা মালিক

ফজিলাতুন্নেসা মালিক
হার্ট বা হৃদ্‌যন্ত্র একটি পাম্প। এই পাম্প শিশুর গর্ভকালীন অবস্থা থেকে কাজ করতে শুরু করে। পাম্পটির কাজ বিশুদ্ধ রক্ত শরীরের প্রতিটি অঙ্গে পৌঁছে দেওয়া। আর দূষিত রক্তকে ফেরত নিয়ে ফুসফুসে দেওয়া এবং ফুসফুস থেকে সেই রক্ত আবার বিশুদ্ধ করে নিয়ে আসা। পাম্পটি শিশুর গর্ভকালীন অবস্থা থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করে।
হৃদ্‌যন্ত্রের সুষ্ঠুভাবে কাজ করার জন্য অক্সিজেন, নিউট্রিয়েন্ট প্রয়োজন। হৃদ্‌যন্ত্র করোনারি ধমনির মাধ্যমে অক্সিজেন ও নিউট্রিয়েন্ট পায়। আমাদের শরীরে হৃদ্‌যন্ত্রের দুটি করোনারি ধমনি আছে। একটি ডান দিকে, অন্যটি বাঁ দিকে।
হার্ট অ্যাটাকের সময় হৃৎপিণ্ডের ধমনিতে জমাট বেঁধে যাওয়া রক্ত প্রাইমারি এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে দ্রুত অপসারণ করাই এ রোগের সর্বাধুনিক চিকিৎসা। ফাস্টফুড খাওয়া, ডায়াবেটিস, ধূমপান ইত্যাদির কারণে করোনারি ধমনিতে চর্বি জমতে শুরু করে। নদীতে তলানি পড়ার মতো রক্তনালিতে আস্তে আস্তে চর্বি জমে। ফলে রক্তনালির রক্তপ্রবাহের পথ বাধাগ্রস্ত হয়।
অনেক রোগী রক্তনালিতে চর্বি জমার এই প্রক্রিয়া প্রাথমিক পর্যায়ে উপলব্ধি করতে পারে না। তাই মোটামুটি স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ যেকোনো কারণে চর্বির জায়গাটিতে ফাটল সৃষ্টি হতে পারে। এতে ফাটলের জায়গায় রক্তকণিকা জমে একটি ক্লট তৈরি হয়। একপর্যায়ে রক্ত জমাট বেঁধে রক্তনালি বন্ধ হয়ে যায়। এটিই হলো হার্ট অ্যাটাক। রক্তনালি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে হৃদ্‌যন্ত্রের বিশাল অংশে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়।
হার্ট অ্যাটাক হলে ২৫ শতাংশ রোগী হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যায়। বুকে ব্যথা হলে অনেকে গ্যাস ভেবে বাসায় বসে থাকে। যখন তাকে হাসপাতালে আনা হয়, ততক্ষণে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। আধুনিক চিকিৎসায় রক্তনালিতে তৈরি ক্লটটি তাৎক্ষণিকভাবে সরিয়ে ফেলা হয়। যেন দ্রুত রক্তের প্রবাহ নিশ্চিত করা যায়। যত তাড়াতাড়ি এটি করা যাবে, তত দ্রুত রোগী সুস্থ হয়ে উঠবে।

সোহেল রেজা চৌধুরী
সোহেল রেজা চৌধুরী

সোহেল রেজা চৌধুরী
বাংলাদেশে বর্তমানে সংক্রামক রোগ অনেকাংশে কমে গেছে। ফলে আমাদের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল বেড়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ, বিশেষ করে হৃদ্‌রোগ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ৬৭ শতাংশ মৃত্যু অসংক্রামক রোগের কারণে হয়। অসংক্রামক রোগগুলোর মধ্যে হৃদ্‌রোগ, ক্যানসার, ডায়াবেটিস ও শ্বাসতন্ত্রের রোগ প্রধান। অসংক্রামক রোগের কারণে মৃত্যুর অর্ধেকই হৃদ্‌রোগে হয়। এর মধ্যে ২২ শতাংশ মৃত্যু হয় অপরিণত বয়সে।
বাংলাদেশে হার্ট অ্যাটাক অনেক অপরিণত বয়সে হয়। উন্নত দেশগুলোতে হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়া রোগীর গড় বয়স ৬০ বছর। কিন্তু বাংলাদেশে হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়া রোগীর গড় বয়স ৫০ বছর।
বাংলাদেশে অপরিণত বয়সে হার্ট অ্যাটাকের অনেকগুলো কারণ রয়েছে, যেমন তামাকজাতীয় দ্রব্যের ব্যাপক ব্যবহার। আমাদের দেশে প্রায় ৪৩ শতাংশ পুরুষ তামাক ব্যবহার করেন। নারীদের মধ্যে ধূমপায়ীর সংখ্যা কম হলেও ২৫ শতাংশ। পান খাওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে তামাকজাতীয় দ্রব্য ব্যবহার করেন তাঁরা।
আমাদের দেশে প্রায় ২১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন, যা হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম প্রধান কারণ। অথচ অবাক করা বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ জীবনে কখনো রক্তচাপ মাপেনি। তামাকের ব্যবহার ও উচ্চ রক্তচাপের হার কমিয়ে আনলে বাংলাদেশে অপরিণত বয়সে হার্ট অ্যাটাক অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।
উন্নত বিশ্বে দেখা যায়, হৃদ্‌রোগের কারণে মৃত্যুর হার কমে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এমন মৃত্যুর হার বাড়ছে। এই পার্থক্যের কারণ হচ্ছে উন্নত বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ, তামাকের ব্যবহার, ডায়াবেটিস ইত্যাদি ঝুঁকির কারণগুলো কমিয়ে এনেছে। পাশাপাশি সেখানে ব্যয়সহনশীল আধুনিক চিকিৎসা রয়েছে। বাংলাদেশে হৃদ্‌রোগ কমাতে হলে এ দুটি বিষয়কে সমান গুরুত্ব দিয়ে এগোতে হবে।

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান
মোহাম্মদ মিজানুর রহমান

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান
হার্ট অ্যাটাক মোকাবিলায় সচেতনতা সৃষ্টি এবং আধুনিক চিকিৎসা জরুরি। হার্ট অ্যাটাকের আধুনিক চিকিৎসার সঙ্গে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটানো প্রয়োজন। কারণ, চিকিৎসকেরা রোগ নির্ণয় করে সুস্থতার জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সুপারিশ করেন। তখন রোগীর কাছে কম দামে মানসম্পন্ন ওষুধ সহজলভ্য করার দায়িত্ব ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর।
উন্নত বিশ্বে হার্ট অ্যাটাক কমে আসার অন্যতম কারণ আধুনিক চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি মানসম্মত ওষুধের সহজলভ্যতা। বাংলাদেশের ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে একটি গর্ব করার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এর অন্যতম কারণ বাংলাদেশের ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পেটেন্ট আইনের বাইরে আছে। ২০৩২ সাল পর্যন্ত এটি বিদ্যমান থাকবে। যার অর্থ হচ্ছে বিশ্বের যেকোনো দেশে আধুনিক চিকিৎসার অংশ হিসেবে কোনো ওষুধ বাজারজাত হলে বাংলাদেশ তার জেনেরিক ভার্সন তৈরি করতে পারবে।
এটি আমাদের দেশের জনগণের জন্য একটি আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ওষুধ আমদানি করে আমাদের সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য করা যাবে না।
সুষ্ঠু দামে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ওষুধ সহজলভ্য করতে পারার কারণে বাংলাদেশের ওষুধের চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ দেশীয় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরবরাহ করতে পারছে। পাশাপাশি বিশ্বের প্রায় ১৫০টি দেশে বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানি করছে।
হৃদ্‌রোগের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আধুনিক ওষুধ উৎপাদন করতে সক্ষম। মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ জনবল তৈরি হচ্ছে। রোগীদের জন্য এটি একটি সুখবর। ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কম দামে মানুষের কাছে মানসম্পন্ন ওষুধ সহজলভ্য করার চেষ্টা করছে।

এ কে এম মহিবুল্লাহ
এ কে এম মহিবুল্লাহ

এ কে এম মহিবুল্লাহ
বাংলাদেশ ও সমগ্র বিশ্বে হার্ট অ্যাটাক বর্তমানে একটি আশঙ্কাজনক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ লোক হৃদ্‌রোগের কারণে মারা যায়। এমন অনুপাতে চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ২ কোটি ৩০ লাখে দাঁড়াবে।
হার্ট অ্যাটাকের প্রধান কারণ করোনারি হৃদ্‌রোগ। বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটির ২০১৭ সালের গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের ৫-৬ শতাংশ মানুষ করোনারি হৃদ্‌রোগে ভোগে। অসংক্রামক রোগের কারণে মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ হৃদ্‌রোগে ভোগে এবং ১৭ শতাংশ করোনারি হৃদ্‌রোগের কারণে মারা যায়।
হার্ট অ্যাটাকের কারণে মৃত মানুষের ২৫ শতাংশের আকস্মিক মৃত্যু হয়। তারা হাসপাতালে আসার কিংবা চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পায় না। হাসপাতালে যারা আসে, তাদেরও মৃত্যুহার কম নয়। সাম্প্রতিক একটি জরিপে দেখা যায়, হার্ট অ্যাটাকের পর হাসপাতালে আসা রোগীদের মৃত্যুর হার প্রায় ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। কয়েক বছর আগেও এটি ১১ শতাংশ ছিল। সচেতনতা ও আধুনিক চিকিৎসার কারণে বর্তমানে হাসপাতালে আসা রোগীদের মৃত্যুর হার কিছুটা কমেছে।
হার্ট অ্যাটাকের কিছু পূর্বলক্ষণ রয়েছে, যেমন বুকে ব্যথা হওয়া, বুক ভার লাগা, বমি ভাব হওয়া, মাঝেমধ্যে মাথা ঝিমঝিম করা, উচ্চ রক্তচাপ কিংবা ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়া। এগুলো সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। লক্ষণগুলো প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশে বর্তমানে হৃদ্‌রোগের সর্বাধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। করোনারি ব্যবস্থাপনা, হৃদ্‌যন্ত্রের বাইপাস সার্জারিসহ রোগীদের মানসম্পন্ন ওষুধ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে হৃদ্‌রোগের বিশেষজ্ঞের ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে ১০ লাখ লোকের জন্য মাত্র ৫ দশমিক ৭ জন হৃদ্‌রোগের বিশেষজ্ঞ আছেন। ১০ লাখ লোকের জন্য হৃদ্‌রোগ শল্যবিদ আছেন মাত্র ১ দশমিক ২ জন। হৃদ্‌রোগের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত বিছানা আছে ৪ হাজার।
হার্ট অ্যাটাকের রোগীর জন্য বিশেষ বিছানা আছে মাত্র ১ হাজার ৩০০টি। কার্ডিয়াক সার্জারির জন্য আছে মাত্র ৫০০ বিছানা। হার্ট অ্যাটাকের এক লাখ রোগীর জন্য বিশেষ বিছানার ব্যবস্থা আছে মাত্র দশমিক ৮৩টি করে। অথচ আন্তর্জাতিকভাবে এক লাখ লোকের জন্য চার-পাঁচটি বিশেষ বিছানার সুপারিশ করা হয়।
এ চিকিৎসার ৯০ শতাংশ ঢাকা শহরকেন্দ্রিক। দেশের বিরাটসংখ্যক রোগী, বিশেষ করে গ্রামের রোগীরা চিকিৎসা-সুবিধা থেকে দূরে আছে। হৃদ্‌রোগ মোকাবিলায় এ বিষয়গুলো চিহ্নিত করে সুষ্ঠু সমাধানের পথ খুঁজে বের করা জরুরি।

তওফিক শাহ্‌রিয়ার হক
তওফিক শাহ্‌রিয়ার হক

তওফিক শাহ্‌রিয়ার হক
হার্ট অ্যাটাক সন্দেহ হলে স্থানীয় চিকিৎসক ও পরিবারের সদস্যদের যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে প্রাইমারি এনজিওপ্লাস্টি করতে সক্ষম এমন হাসপাতালে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। হৃদ্‌রোগীরা সাধারণত মনে করেন, শুধু বুকে ব্যথা হওয়ার পাশাপাশি শরীর ঘেমে বমি হওয়ার সঙ্গে হৃদ্‌রোগের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু এটিই হৃদ্‌রোগের একমাত্র লক্ষণ নয়।
যেমন কারও বুক জ্বলতে পারে, সাধারণভাবে এটিকে গ্যাস্ট্রিক মনে করা হয়। আবার অনেকের পরিশ্রম করলে বুক ধড়ফড় করতে পারে, হাঁটার কারণে মাথা ঘোরাতে পারে।
তাই শরীরে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহতকারী কোনো উপসর্গ দেখা দিলে বসে না থেকে কিংবা হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

মোহাম্মদ আরিফুল আলম
মোহাম্মদ আরিফুল আলম

মোহাম্মদ আরিফুল আলম
হৃদ্‌রোগের মতো রোগগুলো দারিদ্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। হার্ট অ্যাটাকের কারণে দারিদ্র্যের ওপর তিনভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
প্রথমত, হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর কারণে পরিবার অর্থনৈতিকভাবে কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়তে পারে। পরিবারের আয়-উপার্জনকারী ব্যক্তি মারা যাওয়ার কারণে পরিবারের আয় কমে যায়, এমনকি সন্তানের বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, হার্ট অ্যাটাকের সুচিকিৎসা না পেলে রোগী দীর্ঘদিন ধরে রোগে ভোগে। এতে ব্যক্তি ও পরিবারের উৎপাদনক্ষমতা কমে যায়। তৃতীয়ত, হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। কিন্তু বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবিমার মাধ্যমে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত রোগীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা নেই। তাই দারিদ্র্যসীমা থেকে বের হয়ে আসা ব্যক্তি বা পরিবারও আবার দারিদ্র্যের মধ্যে চলে যেতে পারে।
মানসম্মত চিকিৎসাব্যবস্থার পাশাপাশি হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি জরুরি। সে জন্য মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। ব্র্যাক সারা বাংলাদেশের ৬১টি জেলায় কাজটি করে যাচ্ছে, যেখানে মানুষকে মূলত পাঁচটি বিষয়ে শিক্ষিত করে তোলা হয়। প্রথমত, তাকে খাদ্যাভ্যাসের বিষয়ে সচেতন করার চেষ্টা করা হয়।
দ্বিতীয়ত, কর্মসূচিগুলোতে মানুষের শারীরিক পরিশ্রম বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়। সপ্তাহে তাকে পাঁচ দিন এক থেকে দেড় ঘণ্টা হাঁটার সুপারিশ করা হয়।
তৃতীয়ত, ধূমপানবিরোধী কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষকে অধূমপায়ী করে তোলার চেষ্টা করা হয়। হার্ট অ্যাটাকের সঙ্গে মানসিক দুশ্চিন্তার একটি সম্পর্ক রয়েছে। তাই আমাদের কর্মসূচিতে মানুষের অর্থনৈতিক চাপ কমিয়ে আনার চেষ্টার পাশাপাশি তাদের কাউন্সেলিংয়ের ওপর জোর দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সারা বাংলাদেশে ব্র্যাকের প্রায় ৫০ হাজার স্বাস্থ্যসেবিকা রয়েছেন। তাঁদের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ বিষয়ে শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন বিদ্যালয়ে প্রচারণা কর্মসূচি চালানোর একটি উদ্যোগ রয়েছে। সারা বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে চার হাজার বিদ্যালয়কে চিহ্নিত করে ব্র্যাক ছয় মাসব্যাপী একটি প্রচারণা কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক পরিশ্রমসহ জীবনযাপনের ১৬টি দিক সম্পর্কে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অনেক অঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের ১০টি জেলাকে বেছে নিয়ে লবণাক্ততা বৃদ্ধির সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ব্র্যাকের পক্ষ থেকে মানুষকে সুদমুক্ত স্বাস্থ্য ঋণসুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ফলে হঠাৎ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত রোগীরাও এই ঋণসুবিধা পেতে পারে। মানসম্মত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্যবিমার সুযোগ বাড়ানোর বিষয়টি চিন্তাভাবনা করে দেখতে হবে।

খন্দকার আবদুল আউয়াল রিজভী
খন্দকার আবদুল আউয়াল রিজভী

খন্দকার আবদুল আউয়াল রিজভী
হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থাকে সমন্বিত করার পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে উন্নত করা প্রয়োজন। হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি মোকাবিলায় সচেতনতা খুব জরুরি। যেমন কারও হার্ট অ্যাটাক হলে যদি কোনো কারণে খুব দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া না যায়, তাকে ৩০০ মিলিগ্রাম অ্যাসপিরিন খাওয়ালে বাঁচার হার বেড়ে যায়। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, অনেক চিকিৎসকই বিষয়টি জানেন না।
হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর ১২ ঘণ্টার মধ্যে প্রাইমারি পিসিআইয়ের (পারকিউটেনিয়াস করোনারি ইন্টারভেনশন) সুবিধা আছে—এমন হাসপাতালে রোগীকে নিতে পারলে মৃত্যুঝুঁকি অনেক কমে যায়।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের ‘মিশন লাইফলাইন’ নামের একটি কর্মসূচি আছে। যেখানে তারা চারটি কার্যক্রম পরিচালনা করে।
প্রথমত, প্রাইমারি পিসিআইয়ের মতো আধুনিক চিকিৎসাকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করে।
দ্বিতীয়ত, অসুস্থ ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ সাহায্য করার ওপর জোর দেয়। তৃতীয়ত, চিকিৎসাব্যবস্থাকে সমন্বিত করার চেষ্টা করে। চতুর্থত, মিশন লাইফলাইন কর্মসূচির মাধ্যমে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন ধারাবাহিকভাবে চিকিৎসাব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণের চেষ্টা করে। আধুনিকীকরণ রাতারাতি হয়ে যাবে না। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
বাংলাদেশের হাসপাতালগুলো অনুরূপ কার্যক্রম হাতে নিতে পারে। বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থা সমন্বিত নয়। হাসপাতাল থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকেন না, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকলে আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকে না। হার্ট অ্যাটাক মোকাবিলায় পুরো চিকিৎসাব্যবস্থাকে সমন্বিত করা প্রয়োজন।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের সাশ্রয়ী মূল্যে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার মতো সক্ষমতা রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশের হার্ট ফাউন্ডেশনের এই সক্ষমতা নেই। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের হাসপাতালে কোনো গরিব মানুষও হার্ট অ্যাটাক নিয়ে এলে চিকিৎসা পেতে পারেন। বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে তাঁদের সাশ্রয়ী মূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে গত বছর ১৫ হাজার ২৮৫ জনের ক্যাথ ল্যাব প্রসিডিউর (এনজিওগ্রাম, এনজিওপ্লাস্টি, পেসমেকার প্রতিস্থাপন) ও ২ হাজার ৬৬৬ জনের অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৮৯ জনের ক্যাথ ল্যাব প্রসিডিউর এবং ২৬ হাজার ৪৭১ জনের অস্ত্রোপচার করা হয়েছে।
হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। তাই অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তিরা অনেক ক্ষেত্রে মানসম্মত চিকিৎসা নিতে পারেন না। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এ জন্য বিমা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে স্বাস্থ্যবিমার বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আগের তুলনায় বেড়েছে। তাই সরকারিভাবে মানুষকে আধুনিক চিকিৎসা প্রদানের জন্য সহযোগিতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
হৃদ্‌রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে আরেকটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়া। কিন্তু বাংলাদেশেই সুচিকিৎসা দেওয়ার মতো দক্ষ জনবল ও চিকিৎসাব্যবস্থা আছে। দেশে সুচিকিৎসা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিলে আমাদের কষ্টার্জিত অর্থ বিদেশে চলে যায়। তাই সম্ভাব্য ক্ষেত্রে মানুষকে বিদেশে যাওয়া নিরুৎসাহিত করতে হবে।

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ
কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ
গ্রামের মানুষ পর্যাপ্ত কায়িক শ্রম করে। তাদের কায়িক শ্রমের দাওয়াই দেওয়া জরুরি না। তাদের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। কোন খাদ্য হৃদ্‌রোগের প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়ে জানাতে হবে। গ্রামের নিম্নবিত্তরা গরু কিংবা খাসির মাংস খুব বেশি খাওয়ার সুযোগ পায় না। যাঁরা হৃদ্‌রোগের বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলেন, তাঁদের খেয়াল রাখতে হবে কার জন্য সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে।
উচ্চবিত্তের ক্ষেত্রে এক রকম পরামর্শ হবে। নিম্নবিত্তের জন্য ভিন্ন রকম পরামর্শ হবে। সবাইকে এক কথা বলা যাবে না। উপকূলের মানুষকে হৃদ্‌রোগের প্রতিরোধে যে পরামর্শ দেওয়া হবে, অন্য অঞ্চলের মানুষকে সেই পরামর্শ দিলে হবে না। কারণ, উপকূলীয় অঞ্চল লবণাক্ত।
গ্রামের অনেক মানুষ উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতন নয়। তাই এ বিষয়ে তাদের সচেতন করে তুলতে হবে। ব্র্যাক, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহযোগী বিভিন্ন সংগঠন এমন সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন ১ কোটি ৩০ লাখ পরিবারকে নিয়ে সরাসরি কাজ করছে।
সংগঠনটির তামাকবিরোধী বড় একটি আন্দোলন রয়েছে। তামাকবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয় করে আন্দোলনটি পরিচালিত হচ্ছে। অতিসম্প্রতি পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন কুষ্টিয়ায় তামাক চাষ বন্ধ করার একটি প্রয়াস হাতে নিয়েছে।
১০০ পরিবারকে বিকল্প আয়ের উৎসের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিকল্প ফসল চাষের ব্যবস্থার পাশাপাশি তাদের বাড়তি আয়ের জন্য গরু, ছাগল ইত্যাদি পালনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, রসুন চাষ করা কৃষকেরা তামাক চাষের চেয়ে তিন গুণ বেশি মুনাফা করেছেন। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের পাশাপাশি অন্যরাও তামাক চাষ বন্ধে এমন উদ্যোগ নিতে পারেন।
কুষ্টিয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম ও উত্তরবঙ্গে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে তামাক চাষ বন্ধে এমন উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ধীরে ধীরে এটিকে সরকারি কর্মসূচিতে পরিণত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে কাজ রয়েছে। এটি হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারবিষয়ক গণসচেতনতা গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। জাতীয়ভাবে বাংলাদেশের আয় অনেক বেড়েছে। কিন্তু শুধু গড় আয় দিয়ে নিম্নবিত্ত পরিবারের পরিস্থিতি বোঝা যায় না। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে। সবার জন্য সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য এই আর্থিক বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে।
হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হলে প্রতি মাসে প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকার ওষুধ লাগে। দরিদ্র শ্রেণির জন্য এই ব্যয় বহন করা সম্ভব নয়। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের সহযোগী সংস্থার বেশ কয়েকজন হাসপাতাল তৈরি করেছেন। যেখানে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এই হাসপাতালগুলোর সঙ্গে নিজেদের কার্যক্রম যুক্ত করার চিন্তাভাবনা করতে পারে।

গওহার নঈম ওয়ারা
গওহার নঈম ওয়ারা


গওহার নঈম ওয়ারা
হৃদ্রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা থাকা উচিত। বিভিন্ন নামকরা হাসপাতাল বিজ্ঞাপন দিচ্ছে বাইপাসের কোনো দরকার নেই, বিশেষ যন্ত্রের ওপর দাঁড়িয়ে হাঁটাহাঁটি করলে রোগী ভালো হয়ে যাবে।
চটকদার বিজ্ঞাপনগুলো মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে। তাই এগুলো বন্ধ করা উচিত। খুব তাড়াতাড়ি বিজ্ঞাপনগুলোর বার্তা মানুষের মধ্যে পৌঁছে যায়। বিজ্ঞাপনগুলো বন্ধ করার জন্য নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। পাশাপাশি নির্দিষ্ট রোগের ক্ষেত্রে দেখা যায় বিভিন্ন হাসপাতালে বিভিন্ন রকম খরচ। নির্দিষ্ট চিকিৎসার জন্য ব্যয় নির্দিষ্ট করে দেওয়ার নীতিমালা থাকাও জরুরি। স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিমাব্যবস্থার বিকাশের প্রসঙ্গ আলোচনায় এসেছে। ব্র্যাক ইতিমধ্যে জীবনবিমার ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে। এখন তারা স্বাস্থ্যবিমা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারে। পাশাপাশি অন্যদেরও এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
এক গবেষণায় এসেছে, কুড়িগ্রাম ও জামালপুরের মানুষের হৃদ্‌রোগ কম হয়। বিষয়টির কারণ নিয়ে গবেষণা করা হয়নি। হয়তো বিশেষ খাদ্যাভ্যাসের কারণে তাদের মধ্যে এ রোগের প্রবণতা কম। এই সূক্ষ্ম বিষয়গুলো গবেষণার মাধ্যমে বের করে আনা প্রয়োজন।

আব্দুল মালিক
১৯৭৮ সালে যখন হার্ট ফাউন্ডেশন শুরু করা হয়, তখন একটি ছোট পুস্তিকায় লেখা হয়েছিল হৃদ্‌রোগ আজকের শত্রু ও আগামী দিনের মহামারি। এ রোগ এখন মহামারিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে হৃদ্‌রোগ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যৎ খুব ভালো হবে না। তাই এ রোগ প্রতিরোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
হৃদ্‌রোগের চিকিৎসা খুব ব্যয়বহুল। মানুষকে রোগ প্রতিরোধের ওপর বেশি জোর দিতে হবে।
রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গণসচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য শুধু চিকিৎসকেরা নন, গণমাধ্যমও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সরকারের একার পক্ষেও সচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।
হৃদ্‌রোগ হলে যত দ্রুত সম্ভব রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশে হৃদ্‌রোগের চিকিৎসার অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। কিন্তু সেটি যথেষ্ট নয়। এখনো অধিকাংশ চিকিৎসা-সুবিধা ঢাকাকেন্দ্রিক। হৃদ্‌রোগ চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা ঢাকার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়ে যাওয়ার জন্য শুধু আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলে চলবে না, দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করতে হবে।
চিকিৎসক, সরকারি, বেসরকারি সব পক্ষের সমন্বয়ে একটি উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সবার জন্য মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিতের বিষয়টিকে সামাজিক আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ হৃদ্‌রোগ চিকিৎসার ব্যয় বহন করার সামর্থ্য রাখে না। তাই অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল রোগীদের চিকিৎসার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিমা ও স্বাস্থ্যঋণ খুব ভালো ভূমিকা পালন করতে পারে।
শুধু হাসপাতাল সৃষ্টি করে অসংক্রামক রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। আবারও বলছি, রোগ প্রতিরোধ করার ওপর বেশি জোর দিতে হবে। এক দিনে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে সমন্বিত ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশ হৃদ্‌রোগ মোকাবিলায় সক্ষম হয়ে উঠবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

আব্দুল কাইয়ুম: আজকের আলোচনায় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রতিকারের পাশাপাশি প্রতিরোধের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে জোর দেওয়া হয়েছে। কতগুলো কাজ খুব সহজেই করা যায়। যেমন ধূমপান ছেড়ে দেওয়া, প্রতিদিন হাঁটা কিংবা কায়িক পরিশ্রম করা ইত্যাদি। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য সবাইকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।