দেয়ালের স্পষ্ট লিখন

মোদির দেশের রাজনীতিতে মনমোহন সিংয়ের মতো ব্যক্তিরা যেন ‘মিস ফিট’
মোদির দেশের রাজনীতিতে মনমোহন সিংয়ের মতো ব্যক্তিরা যেন ‘মিস ফিট’

মনমোহন সিং বরাবরই অল্প কথার মানুষ। ভদ্র ও শালীন। উঁচু স্বরে কথা বলা তাঁর ধাতে নেই। রাজনীতির মানুষই নন। তাই কটু কথা বলতে শেখেননি। তাঁর ভাষণ শুনে রক্ত গরম হয় না। সাংসদ হিসেবে যে দুর্দান্ত, সে দাবিও কেউ করবে না। সংসদীয় বিতর্কে অংশ নিয়ে ক্ষুরধার যুক্তিতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে বাহবা কুড়োচ্ছেন, এমন দৃশ্য কখনো দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। মনমোহন সিংকে ব্যাখ্যা করতে গেলে অতিশিক্ষিত, ভদ্র, সৎ, সজ্জন, শালীন ও নিপাট ভালো মানুষের বিশেষণগুলোই মনে পড়বে। সমসাময়িক রাজনীতিতে তিনি যেন চূড়ান্ত ‘মিস ফিট’, অর্থাৎ বেখাপ।

এই মনমোহন সিং যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, বিজেপির তাবড় নেতারা সেই সময় তাঁকে ‘মৌন মনমোহন’ বলে কটাক্ষ করতেন। শব্দবন্ধটি প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি, যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লক্ষ্যে আসরে নেমে জনসভাগুলো মাতিয়ে দিচ্ছিলেন। কয়লার ব্লক ও তরঙ্গ বণ্টন নিয়ে কংগ্রেস সেই সময় জেরবার। বিরোধীরা প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন, মনমোহন সিং নির্বাক। সেই মৌনতা ভাঙার পরামর্শ দিতেন নরেন্দ্র মোদি। বলতেন, ‘মৌন না থেকে মনমোহনজি মুখ খুলুন।’ মনমোহন সিং ঠিক সেই বাক্যটাই ফিরিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমাকে যে উপদেশ দিতেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উচিত সেই পরামর্শ মেনে চলা। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে ওঁর মুখ খোলা উচিত।’

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কানে তুলবেন, এমন কোনো ইঙ্গিত অবশ্য নেই। চার বছর ধরে নরেন্দ্র মোদি তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তিতই রেখেছেন। গোটা দেশ অথবা বিরোধীরা যা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন, তাঁর কাছে তা গুরুত্বহীন। যে বিষয়ে কথা বলা জরুরি বলে তিনি মনে করেন, শুধু সেই বিষয়েই তিনি মন ও মুখ খুলেছেন। গোরক্ষা নিয়ে সরকারি নির্দেশে অর্থনীতি বেহাল, দেশজুড়ে কোলাহল, তিনি নির্বিকার। গোহত্যা বন্ধে মুসলমান ও দলিতদের বিজেপিশাসিত রাজ্যে পিটিয়ে মারা হচ্ছে, তিনি চুপ। ললিত মোদির সঙ্গে বসুন্ধরা রাজে ও সুষমা স্বরাজের দহরম-মহরম নিয়ে বিরোধীরা সংসদ অচল করে রেখেছেন, মোদি অটল। বিজয় মালিয়া ১৭টা স্যুটকেস নিয়ে কীভাবে দেশত্যাগী হলেন, গোটা দেশ জানতে চাইলেও মোদির মুখে কুলুপ। নীরব মোদি ও মেহুল চোকসিরা সরকারি ব্যাংক লুট করে পগারপার হলেন, বিদেশে প্রধানমন্ত্রীর সভায় উপস্থিত থেকে ছবি তুললেন, মোদি ‘মেহুল ভাই’ বলে সম্বোধন করলেন, অথচ প্রধানমন্ত্রী আজ পর্যন্ত টুঁ শব্দটি করলেন না! রাজ্যে রাজ্যে কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে, প্রধানমন্ত্রী মোদি অবিচলিত। মুসলমান ও দলিতদের ওপর অত্যাচারে অসহায় বোধ করে দলের দলিত সাংসদেরা চিঠি লিখছেন, প্রধানমন্ত্রী তার উত্তর দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করছেন না। রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেনাবেচায় দুর্নীতি নিয়ে বিরোধীরা সরব হলেও মোদির মুখে একটি শব্দও নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ এভারেস্টের চুড়ো ছুঁয়ে ফেললেও তাঁকে উদ্বিগ্ন হতে দেশবাসী দেখেনি। ডোকলামে ঢুকে পড়ে চীন তুলকালাম করে দিল, নেপাল ও মালদ্বীপে ভারতীয় আধিপত্যকে ট্যাঁকে পুরে ফেলল, শ্রীলঙ্কার দিকে নতুন করে থাবা বসিয়ে ভুটান ও বাংলাদেশের দিকে নজর দিয়েছে, চার বছরে এসব নিয়ে মোদিকে কেউ কিছু বলতে শুনল না। শুনবেই বা কী করে, তাঁকে প্রশ্ন করার কোনো অধিকারই যে তিনি কাউকে দেননি! তিনি দেশের একমাত্র প্রধানমন্ত্রী, সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়ার কোনো সুযোগ যিনি চার বছরে দেননি। গত চার বছরে ভারতীয় গণতন্ত্রকে তিনি ‘ওয়ানওয়ে ট্রাফিক’ করে ছেড়েছেন। যা বলার, যতটুকু বলার, তিনিই বলবেন, অন্যরা শুনবে। ছিটেফোঁটা সংলাপের অবকাশও তিনি রাখেননি। শুধুই ‘মনোলগ’!

এই যে এবার, দেশ যখন জম্মুর কাঠুয়া ও উত্তর প্রদেশের উন্নাওয়ের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় তোলপাড়, তখনো বহুদিন যাবৎ প্রধানমন্ত্রীর স্বর শোনা যায়নি। শোনা গেল, দেশে-বিদেশে এ নিয়ে ব্যাপক নিন্দা-প্রতিবাদ ও জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করার পর। এক সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশবাসীকে ‘আশ্বস্ত’ করে বললেন, মা-বোনদের রক্ষা করা হবে। এই মুখ খোলাটা অবশ্যই তাঁর চারিত্রিক বিচ্যুতি। কিন্তু সেই বিচ্যুতিকে গ্রাহ্য করতে রাজি নন দেশের ৪৯ জন সাবেক আমলা। প্রধানমন্ত্রীকে এক চিঠিতে ক্ষোভ ও বিরক্তি প্রকাশ করে তাঁরা বলেছেন, ‘আপনি সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন। ভেবেছিলাম, আপনার দল ও সরকার অবক্ষয় রুখবে। নড়েচড়ে বসবে। দুর্বল ও সংখ্যালঘুদের নতুনভাবে আশ্বস্ত করে বলবে, তাদের জীবন ও স্বাধীনতা হারানোর ভয় নেই। অথচ তা হলো না। আমাদের আশা ভেঙেচুরে তছনছ।’

সাবেক আমলাদের উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কারণ, যে সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় এমন ঘটনা ঘটে, যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবেশ এমন ধরনের ঘৃণ্য ও বিকৃত মানসিকতার জন্মদাতা, প্রধানমন্ত্রী সেসবের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি! শুধু তা-ই নয়, যে দুই রাজ্যে এই ঘটনা ঘটেছে, দুটোই বিজেপিশাসিত। দুটিতেই তাঁর দলের লোকজন জড়িত। দুটি অপকর্মেই বিজেপির স্থানীয় পান্ডারা জড়িত। দুটি ক্ষেত্রেই পুলিশ ও প্রশাসন দলীয় অভিযুক্তদের আড়াল করেছে বহুদিন। অথচ তিনি দৃষ্টিহীন ও বধির হয়ে ছিলেন!

জম্মুর ঘটনাকে তো স্থানীয় বিজেপি নেতারা সাম্প্রদায়িক রূপ পর্যন্ত দিয়েছেন। কেন? কোন যুক্তিতে? না, কাশ্মীরের এই ভবঘুরে মুসলমান সম্প্রদায়, যারা বাকারওয়াল বলে পরিচিত, পশুপালনই যাদের একমাত্র কাজ, শীতের সময় যারা কাশ্মীরের পাহাড় ও উপত্যকা ছেড়ে সমতল জম্মুর গ্রামাঞ্চলের জঙ্গলে ঘোড়া-ভেড়া-ছাগল নিয়ে চলে আসে, তাদেরকে জঙ্গিদের জন্মদাতা, মানববোমার সৃষ্টিকর্তা ইত্যাদি বলে অপপ্রচার চালিয়েছেন স্থানীয় বিজেপি নেতারা। তাঁদের কথা হলো, এই বাকারওয়ালদের এমন শিক্ষা দেওয়া দরকার, যাতে জম্মু কলুষিত করতে না পারে! কিন্তু বিজেপির ওই নেতারা ভুলে গিয়েছিলেন, এই বাকারওয়াল পশুপালকেরাই কারগিলের পাহাড়ে পাকিস্তানি সেনাদের উপস্থিতি প্রথম জানতে পেরেছিল। ভারতীয় সেনাদের তারাই সচকিত করে দিয়েছিল।

সেদিন খবরের কাগজে একটা ছবি দেখে চমকে গেলাম। ধর্ষণকাণ্ডের প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন এক নারী। তাঁর হাতে ধরা একটা পোস্টার। তাতে ওপরের দিকে লেখা ‘প্রিয় প্রধানমন্ত্রী’, বাঁ দিকে লেখা ‘মন কি বাত’। এর বাইরে বড় বড় করে যা লেখা, তা নির্ভেজাল হুঁশিয়ারি। ‘আপনি রাতারাতি কারেন্সি নোট, কর ব্যবস্থা ও সরকারের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। এবার ধর্ষণের সংস্কৃতি বদলান। নইলে আমরা আমাদের ভোট বদলে দেব। ২০১৯ বেশি দূরে নয়।’

মোদির নেকনজরে না থাকা যশোবন্ত সিনহা দলীয় সাংসদদের বিদ্রোহ করার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁদের উদ্দেশে ভণিতাহীন বলেছেন, ‘আপনাদের মধ্যে কতজন আগামী বছর টিকিট পাবেন, সন্দেহ। অভিজ্ঞতা বলছে, আদ্ধেকের বেশি টিকিট পাবেন না। যাঁরা পাবেন, তাঁদের মধ্যে কজন জিতবেন, বলা কঠিন। কেননা, ২০১৪ সালে বিজেপি পেয়েছিল ৩১ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ ৬৯ শতাংশ ছিল বিরুদ্ধে। বিরোধীরা একজোট হলে ভেসে যাবেন। দেশের স্বার্থে তাই গর্জে উঠুন।’ লালকৃষ্ণ আদভানি ও মুরলি মনোহর যোশির মতো প্রবীণ নেতাদেরও ‘দেশের স্বার্থে’ সক্রিয় হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। মনমোহন সিংও যে পরামর্শটা মোদিকে ফিরিয়ে দিলেন, তার মোদ্দা কথা: কোমর কষুন। নইলে...।

কোমর কষে নরেন্দ্র মোদি কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন, জানা নেই। চার বছর ধরে তাঁর যে ভাবমূর্তি আঁকা হয়েছে, তাতে মচকানোর কোনো ইঙ্গিত নেই। দেয়ালের লিখনও মোটেই অস্পষ্ট নয়। সে লিখন নরেন্দ্র মোদি পড়বেন কি না, তা তাঁর ব্যাপার।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর দিল্লি প্রতিনিধি