পাপ-পুণ্য ও প্রেমময়তার ছবি 'স্বপ্নজাল'

স্বপ্নজাল ছবির একটি দৃশ্য
স্বপ্নজাল ছবির একটি দৃশ্য

স্বপ্নজাল ছবিটি অবশেষে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। ছবিটি কেন আপনি দেখতে যাবেন? এ দেশে ভালো ছবি তৈরি হয় কম। ভালোতে আগ্রহ থাকলে খোঁজখবরও থাকে কোন ছবি কখন আসবে বা এল। জানা হলে ভালোর টানে যাবেন। স্বপ্নজাল নির্মাণ করেছেন গিয়াসউদ্দিন সেলিম, এ কারণেও দেখতে যাবেন। তাঁর প্রথম ছবি মনপুরা দর্শকদের মোহিত করেছিল। অতএব, দ্বিতীয় ছবি নির্মাণের প্রতি বিশেষ আগ্রহ থাকারই কথা। অনেকে আজ নয় কাল যাব, কাল নয় পরশু-এমন করে করে ছবি হারান।

স্বপ্নজাল দর্শক আগ্রহ নিয়ে দেখতে যাবেন, তার আরও একটা কারণ, ভরসা। তার জোর টেনে নিয়ে যাবে সিনেমা হলে। কেন এই ভরসা? পরিচালক। গিয়াসউদ্দিন সেলিম প্রথম ছবি নির্মাণের সময় মোটেও ভাবেননি রুচিতে, মানে দর্শক উন্নত নন। দর্শকের প্রতি এই শ্রদ্ধা তিনি দৃশ্যে দৃশ্যে জারি রেখেছিলেন। মনপুরা সব শ্রেণির মানুষের ভালো লেগেছিল।

স্বপ্নজাল নির্মিত হয়েছে মনপুরার নয় বছর পর। এই স্বপ্ন ও জালের বুনন অধিকতর পরিণত। আরও বড় আকার, পরিসরে হাজির হয়েছে এই ছবি। স্বপ্নজাল-এ বিচরণ বহু চরিত্রের, ঘটনার বিস্তারও ঘটে বিস্তর। তবু গল্প প্রেমেরই। এই প্রেম আরও বিস্তৃত, মিশ্রিত। বহু জটিলতাকে অনেক সহজে বয়ান করা। বয়ানের বুনন চমকপ্রদ এবং তা স্তর থেকে স্তরে কাব্যিক ব্যঞ্জনা নিয়ে উন্নীত হয়। এই স্তরবিন্যাসের সময় পরিচালক আগের মতোই দর্শকের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা জারি রেখেছেন। দর্শকের জন্য চলচ্চিত্র, সেই দর্শককে যদি অপরিণত ভাবা হয়, নির্মাণের আগেই সেই ছবি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শুধু চলচ্চিত্র কেন, কবিতা, গল্প উপন্যাস, চিত্রকলা, গান, নাচ-কোনো কলাই তো বাছাই করা বিশেষজনদের জন্য নয়।

গিয়াসউদ্দিন সেলিম যে চরিত্রগুলো নিয়ে স্বপ্নজাল বুনেছেন, তাদের সবাই চেনা। তবে সাধারণ বিবেচনায় মানুষকে ভালো আর মন্দ-এ দুই ভাগে ভাগ করে যে সাদামাটা দায় সারা হয়, তেমন দায় সারা নজরে পড়েনি। চলচ্চিত্র বিনোদনের জন্য, কিন্তু শুধু বিনোদনের জন্য হলে তার সঙ্গে কলা পরিচয়ের সংযুক্তি ঘটত না। এক ঠোঙা বাদাম বা চানাচুর উভয়ের স্বাদে টানাহেঁচড়া থাকে, যেকোনো মানুষ সেই টানে কুপোকাত হয়ে যান, যখন-তখন, কারণে-অকারণে। চিবানো শেষে দরকারি ঠোঙা হয়ে যায় বর্জ্য। মানুষ ঠোঙাও নয়, বর্জ্যও নয়। চলচ্চিত্রও নয় বাদাম বা চানাচুর। তা উপভোগ্য এবং মনোজগতে যদি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করে, সেই চলচ্চিত্র বাদাম, চানাচুর বা মসলা মাখানো মুড়ির মতোই। চলচ্চিত্র দেখলাম, ভালো লেগেছে, প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে আসামাত্র দেখে ফেরা সেই ছবি মাথা থেকে বেরিয়ে গেল-স্বপ্নজাল তেমন নয়।

কোনো দৃশ্যকল্প, ঘটনা, সংলাপ বা উপস্থাপনা রীতি মাঝেমধ্যে চমকপ্রদ মনে হলো, তা নয়। নিয়মিত, অবলীলায় সেই বিস্ময় বা চমকের বুনন চলতেই থাকে। পরিচালক মুনশিয়ানা দেখানোর জন্য তা করেছেন, এমন হলে সেই ভারে নুইয়ে পড়ত ছবিটা। সুখের বিষয়, সেই সর্বনাশ ঘটেনি। তার বদলে নির্মাতা যে জাদু জানেন, তার কুশলতায় টান টান উত্তেজনায় উপভোগ্য হয়ে ওঠে স্বপ্নজাল। নির্মিতিতে নিয়ন্ত্রণবোধও অসাধারণ। এই বাংলায় মুসলমান ও হিন্দুর মধ্যে সম্পর্কের যে উদারতা, তা ফলাও করে বলা হয়নি, আবার সংকীর্ণতাকেও চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায়নি। একটা মনভাঙা পরিবারের দেশত্যাগ বা আশা ও ভক্তি নিয়ে আবার নিজ দেশে ফেরা, কোনোটিকে নির্মাতা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর আগ্রহ দেখাননি।

স্বপ্নজাল-এ দর্শকদের মুখোমুখি হতে হয় অসংখ্য আকস্মিকতার। সেসবও মুগ্ধ করার বিষয় হয়ে ওঠে। গল্পের নেত্র দুটি। এক, সমাজ সংসার মানুষ ও তার জীবন এবং দ্বিতীয় নেত্রটি প্রেমময়তায়। উভয়কে সম্পন্ন দৃষ্টিতে দেখার যে সাধ্য পরিচালক দেখিয়েছেন, তাতে চলচ্চিত্রের ভালো দিনের আশা এবং এই ভূমিতে জন্মের গৌরববোধ জাগিয়ে তোলে। মফস্বল শহরের যুবক-যুবতীর প্রেমের এমন কাব্যময় উপস্থাপনা এখনকার চলচ্চিত্রে বিরল। অহরহ ভিন্নতর উপস্থাপনার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসী পরিচালক জানান দেন, দর্শককে তিনি কতখানি উচ্চাসনে আসীন দেখে থাকেন। চারপাশে অহরহ ঘটে চলে অসংখ্য হীন ঘটনা। সেসবের চর্চা মানুষ ও জীবনকে হীনম্মন্য করে তুলেছে।

মহত্ত্ব, সুন্দর, শোভন শিল্পিত বিষয়ের চর্চা মনের সংকীর্ণতা ঘুচিয়ে দিতে পারে আলোর দিশা। দিতে পারে বিশালত্বের অনুভব। স্বপ্নজাল বুননে তাই নাটকের মহড়া আকারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্তকরবীর সংলাপ যুক্ত হয়। ছবির দুই চরিত্রের প্রেম, অনুভব একই সমান্তরালে দেখানোর ভাবনা নিছক চমক সৃষ্টির জন্য, তা মনে হয় না। এই সংযোজন স্বপ্নজালকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে দাঁড় করায়।

চিত্রায়ণকালে মনপুরার সৌন্দর্যের চেয়ে সুন্দরকে আবিষ্কারের চেষ্টা চোখে পড়ে। ছবি দেখে বের হওয়ার পর অনেকের অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তা থেকে একটা প্রশ্ন, ‘কার অভিনয় সবচেয়ে ভালো লেগেছে?’ উত্তর বড়ই কঠিন। ছবি মর্মে গাঁথে সব মিলিয়ে। সবার মিলিত চেষ্টাতেই ছবি সার্থক হয়ে ওঠে। সবাই নিবেদিত ছিলেন বলে চরিত্রগুলো আলাদা আলাদা করে মনে থাকে। একজন পিয়নকে চিঠি বিলির জন্য আসতে-যেতে দেখা গেছে, তাকেও তো বিশেষ করে মনে বয়ে ফিরতে হয়। তাহলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁদের তো বহুদিন মনে বয়ে বেড়ানো ছাড়া উপায় নেই। নায়ক-নায়িকা বিষয়ে অনেকের কৌতূহল। তাঁরা কেমন!

ইয়াশ রোহানের এটি প্রথম অভিনয় আর অভিনেত্রী পরীমনি প্রচুর ছবিতে অভিনয় করেছেন। উভয়ের নাম-পরিচয় ভুলে তাঁদের সত্যি সত্যি ছবির চরিত্র মনে করেছেন দর্শক। এমন বিশ্বাস তৈরি করতে পারা সাধারণ ঘটনা নয়। দর্শককে আমরা বলি সাধারণ। কোনো অসাধারণে যখন তাঁরা বিস্মিত হন, তাঁরা সাধারণ থাকেন না। যখন সুন্দরে মোহিত হন, যখন ভালো ও মন্দের দ্বন্দ্বে এলোমেলো না হয়ে থাকেন ভালোর সঙ্গে, যখন অন্যের একাগ্রতা নিষ্ঠা ও ভালোবাসাকে অনুভব করতে পারেন, সেই অনুভব তাঁদের বিশেষ করে তোলে। মানুষের মধ্যে বহু বৈচিত্র্য। অনেক আলো, পাশাপাশি অন্ধকারও। শিল্প ও সৌন্দর্যের ভূমিকা হচ্ছে সাধারণের মধ্যে বিশেষের অনুভব জাগিয়ে তোলা। স্বপ্নজাল সেই অনুভব জাগিয়ে দিতে পারবে, তেমনই ছবি।

পুনশ্চ: গিয়াসউদ্দিন সেলিম, প্রথম ছবির ব্যবসায়িক সাফল্যে আপনি নিশ্চয়ই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তা আপনাকে প্রভূত আনন্দে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারত। নিজেকে সামলে রেখেছেন। সময়কে বয়ে যেতে দিয়েছেন। অস্থিরতা আমল পায়নি। নিজ লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন। দ্বিতীয় ছবির গল্প নির্বাচনে বিরাট ঝুঁকি নিয়েছেন। মানুষের বলার সুযোগ ছিল-আবারও প্রেম! আপনি অসংখ্যবার প্রেমের ছবি নির্মাণ করুন। বর্তমান সময়ে যে প্রেমকে আপনি পর্দায় এনেছেন, চিরকালীনকে যে আধুনিকতায় উপস্থাপন করেছেন, চলচিত্রে তা বিরল ঘটনা। পুরো স্বপ্নজাল এবং আলাদা করে কাব্যময় প্রেমের জন্য আপনাকে মন উজাড় করে অভিনন্দন।

আফজাল হোসেন অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, লেখক ও নির্দেশক
afzalhossain 1515 @yahoo. com