নির্বাচনী প্রচারে সাংসদ!

স্থানীয় সরকার নির্বাচনের চেহারা ‘স্থানীয়’ রাখতে ক্ষমতাসীন দল ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) আগ্রহী নয় বলেই ধারণা করি। এ কারণে সাংসদদের নির্বাচনী প্রচারে সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব আসামাত্রই ইসি তা বাস্তবায়নে তৎপর হয়েছে। দিন যতই যাচ্ছে ততই এটা পরিষ্কার হচ্ছে যে, শুধু দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন করার মতো পদক্ষেপ নিয়ে তাদের চলছে না।
বিশ্বে যেসব দেশে দলীয় সরকারের অধীনে যুগ যুগ ধরে শান্তিতে নির্বাচন হচ্ছে, সেসব দেশের ক্ষমতাসীন দল লিখিত-অলিখিত কতগুলো আচার-আচরণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে চলে। এ রকম একটি পরিস্থিতি কল্পনা করা দুরূহ যে রাজনীতিবিদেরা, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ব্যক্তিরা ক্রমাগতভাবে ইসির ওপর চাপ প্রয়োগ করে যাবেন, আর ইসি শুধু সাংবিধানিক সংস্থা হওয়া এবং সরকারের চাপমুক্ত থাকার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে গলদঘর্ম থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো কিছুই যেন আর পরিমিতিবোধের মধ্যে থাকতে চাইছে না। আত্মসংযম, চক্ষুলজ্জা দুটোই উঠে যাচ্ছে। সরকারি দল সাংসদদের নির্বাচনী প্রচারে নামার সুযোগ থাকা যে ক্ষতিকর, সেটা এই বর্তমান শাসনামলেই মেনে নিয়েছিল। তাদেরসহ সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইসি ২০১০ সালে আচরণবিধি সংশোধন করেছিল। এর আওতায় সাংসদসহ সব ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির’ নির্বাচনী প্রচারে নামার সুযোগ নেই।
সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সরকারের মন্ত্রী, চিফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদ উপনেতা, প্রতিমন্ত্রী, হুইপ, উপমন্ত্রী বা তাঁদের সমপদমর্যাদার কোনো ব্যক্তি, সংসদ সদস্য এবং সিটি করপোরেশনের মেয়রকে বোঝাবে।’ এখন এই তালিকা থেকে তাঁরা শুধু আলাদা হবে কেন, বিধানে যদি সংশোধনী আনতেই হয়, তাহলে অন্যরা বাদ থাকবেন কেন। সংসদীয় ব্যবস্থাটাই এমনভাবে সাজানো, যেখানে সাংসদেরাই সর্বেসর্বা, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকার তাঁদের দ্বারাই সৃষ্টি, সুতরাং তাঁরাই যদি নির্বাচনী প্রচার শুরু হয়ে যাওয়ার পরে আইন সংশোধন করে নতুন করে প্রচারে নামার আবদার করতে পারেন, তাহলে এই বিধানটি রেখে কী লাভ। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, যেখানে ইসির সামনে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করার বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বড় পরীক্ষার জন্য যখন তাদের কাছে মানুষ সাহসী ও দৃপ্ত ভূমিকা ও মনোবল প্রদর্শন আশা করছে, তখন তারা চাহিবামাত্র আচরণবিধি সংশোধন করার মনোভাব কী অবলীলায় ব্যক্ত করেছেন।
ইসি সচিব একটি অকপট স্বীকারোক্তির জন্য সাধুবাদ পেতে পারেন। কারণ, চাপের কাছে নতি স্বীকার বিষয়ে যখন প্রশ্ন করা হয়েছে, তখন তিনি বলেছেন, ‘সব রাজনৈতিক দলই ইসির অংশীজন। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়েই ইসিকে কাজ করতে হয়। তাদের সুবিধা-অসুবিধাগুলো বিবেচনায় নিতে হয়।’ আমাদের জানামতে, বিরোধী দল অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলের যারা প্রতিপক্ষ, তারা এই দাবি তোলেনি। এমনকি ইসি একবার মুখ ফসকেও বলেনি যে, আইন বা বিধিবিধান কারও সংকীর্ণ সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা থেকে হয় না। ভালো বিধান করতে বা তা শোধরাতে হলে একটা ন্যূনতম নৈতিকতা বা সাধারণ একটা গ্রহণযোগ্যতা দরকার। প্রস্তাবিত সংশোধনী অনৈতিক, অন্যায় এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর। তৃণমূলের রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন বরাদ্দের কলকাঠি তাদের হাতে তুলে দেওয়ার পর এখন নির্বাচনী প্রচারণায় নামার বৈধ ছাড়পত্র তারা হাতে পাওয়ার পরে তাদের আর কী চাহিদা মেটাতে ইসিকে তটস্থ হতে হয় কে জানে!
সাংসদদের অন্যায্য ও অপ্রয়োজনীয় দাবি পূরণে আচরণবিধি সংশোধন করলে তাতে ইসির সামর্থ্য আরও প্রশ্নের মুখে পড়বে।