অস্বস্তি ও ভয়ের রাজত্বে আছি আমরা

দৃশ্যত আন্দোলন কিছুটা থেমেছে বলে মনে হলেও আবারও উত্তপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় ১০ দিন ধরে কার্যত বন্ধ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও একাডেমিক কার্যক্রম। ক্লাস বন্ধের ঘোষণা না থাকলেও শিক্ষকেরা অনেকেই শিক্ষার্থীদের অনুরোধে ক্লাসে যাননি। আবার কেউ কেউ ক্লাস নিতে এসে শিক্ষার্থী পাননি। শিক্ষার্থীদের ওপর টিয়ার শেলের হামলা বেশির ভাগ শিক্ষককে বিচলিত না করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসায় হামলার পর শিক্ষক সমিতি বেশ নড়েচড়ে উঠেছিল। হামলার পরের দিনই ডাকা শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় রুম উপচে পড়া শিক্ষকদের উপস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়ে একধরনের দায়িত্ববোধ তৈরি করেছিল। আর সেই দায়িত্ববোধের সমাপ্তি ঘটে মানববন্ধন, কলম বিরতি ও কোটা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার আগে শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার মধ্য দিয়ে। তারপরই সবাই ব্যস্ত হয়ে গেছেন ১৯ সেপ্টেম্বর সিন্ডিকেট নির্বাচনের প্রচারণায়।

কবি সুফিয়া কামাল হলে বৃহস্পতিবার রাত আটটার পর থেকেই শুরু হয় প্রশাসনিক অ্যাকশন। কয়েকজন ছাত্রীর ফোন জব্দ করা হয় এবং তাঁদের অভিভাবকদের জরুরি ভিত্তিতে ডাকা হয়। রাত নয়টার দিকে শুরু হওয়া ঝড়বৃষ্টির মধ্যেও অভিভাবকদের এসে ছাত্রীকে নিয়ে যেতে বলা হয়। এক অভিভাবক মোটরসাইকেল চালিয়ে রাত ১১টার পর বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন ছাত্রীকে-এই ছবি কোনো কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

অন্যান্য হলেও চলছে চাপা উত্তেজনা, ফিসফাস। আবাসিক শিক্ষকেরাও চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। কবি সুফিয়া কামাল হলে ১০ এপ্রিল যে ঘটনা ঘটেছিল, তার জের ধরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে ছাত্রলীগের ২৪ জন নেতা-কর্মীকে। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই প্রশাসনিক পদক্ষেপ। যেহেতু সেদিন প্রায় পুরো হলের মেয়েরাই ছিলেন ছাত্রলীগ নেত্রী ইফফাত জাহান ওরফে এশার বিপক্ষে, তাই অনেকেই এই অ্যাকশনের আগেই ভয়ে হল থেকে চলে গেছেন। ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেদিন সেই ‘গুজব’ই যে শুধু এশার ওপর আক্রমণের কারণ ছিল তা নয়, এর পেছনের কারণ ছিল দীর্ঘদিনের নিপীড়ন, নির্যাতন ও দাপট।

এই মেয়েদের কয়েকজন আবার কখনো রাজনীতি করেননি, শুধু হলে থাকার বন্দোবস্ত করার জন্য ক্ষমতাসীন সংগঠনের ‘রাজনীতি’র বড় আপাদের ধরে হলে উঠেছেন, থেকেছেন হলরুমে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সোনার হরিণ একটি সিটের জন্য (বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যা হয় একজনের জন্য দেওয়া ছোট একটি খাট দুজন ভাগ করে থাকেন) অনেকেই ‘পলিটিক্যাল’ পরিচয় নিয়ে হলে ওঠেন এবং এঁদের দলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে। সেদিনের এই ঘটনাকে নিয়ে তৈরি হওয়া হল ও বিশ্ববিদ্যালয় মিলে দুটি তদন্ত কমিটির চাপ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের ‘গুজব’-সব মিলিয়ে সেই হলের ছাত্রীদের মানসিক অবস্থা সহজেই অনুমেয়। হল প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি করেছে এবং সেই তদন্ত কমিটির কাজ শেষ না হওয়ার আগেই অ্যাকশনে নেমেছে হল প্রশাসন। হলের কয়েকজন ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বেশির ভাগ ছাত্রীই ভয়, আতঙ্ক আর চাপের মধ্যে আছেন, যা আমরা কোনোভাবেই দেখতে চাই না।

ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেত্রীকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেছে ছাত্রলীগ। প্রতিবাদী ছাত্রীদের বিক্ষোভকে শান্ত করতে সে রাতে জরুরি সভার চিঠি হাজির করে ছাত্রলীগ নিজের দায়মুক্তি করেছিল এশাকে বহিষ্কার করে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও মাঝরাতে বহিষ্কারের বিবৃতি দিতে হয়েছিল। আবার ৪৮ ঘণ্টা পরই সবার চেতনা ‘জাগ্রত’ হলো। ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ সবাই মনে হয় সে রাতের পর ঘুম থেকে জেগেছে এবং জেগেই জানল ‘মহা ভুল’ হয়ে গেছে। এই ১০ দিনের সর্বশেষ ছবিটি হলো, চোখ বেঁধে কানামাছির খেলার খেলোয়াড় বানিয়ে আন্দোলনের তিনজন নেতাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ডিবির কার্যালয়ে।

সামনে সেমিস্টার ফাইনালের দৌড়ানি থাকলেও আন্দোলনে সার্বক্ষণিক থাকা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে উপস্থিতি খুব কম। অনুমান করি, আন্দোলনকারীরা ভয়ে আছেন। আন্দোলনকারী তিনজনকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। শিক্ষকনেতারা প্রশ্ন তোলেননি। কোনো তদন্তের প্রয়োজনে তাঁদের ডাকা হলে কেন তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো না? যে তিনজনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাঁরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এর আগেও আমাদের ব্লগার ছাত্রদের পুলিশ প্রশাসনের অনুমতি বাদেই গ্রেপ্তার করেছিল। তখনো এর প্রতিবাদ বিশ্ববিদ্যালয় করেনি, করেছিলেন সেই শিক্ষার্থীর বিভাগের শিক্ষকেরা এবং আরও কয়েকজন সহকর্মী। তবে এখনকার আতঙ্ক নানামুখী। প্রতি মুহূর্তেই গ্রেপ্তারের আতঙ্ক আছে, আছে ক্ষমতাসীন সংগঠনের হাতে মার খাওয়ার ভয়।

আমরা সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলার। আমরা বিচার চাই উপাচার্যের বাসায় পরিকল্পিত হামলারও। সেই সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার প্রশ্নে শিক্ষক সমিতি ও প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চাই। শিক্ষার্থীদের আক্রান্ত ও ভয়ার্ত মুখ আমাদেরও বিষণ্ন করে। চলমান দুর্যোগ কাটিয়ে ভয়মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির দক্ষতা প্রশাসন ও শিক্ষকদের দেখাতেই হবে।

জোবাইদা নাসরীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
[email protected]