প্লাস্টিক নিপাত যাক, ধরিত্রী মুক্তি পাক

প্লাস্টিকেই খেয়ে ফেলবে আমাদের ভবিষ্যৎ ?
প্লাস্টিকেই খেয়ে ফেলবে আমাদের ভবিষ্যৎ ?

প্লাস্টিকের কি কোনো বাংলা প্রতিশব্দ আছে? নেই।ęপ্লাস্টিক প্লাস্টিকই। তার কোনো অনুবাদের প্রয়োজন পড়ে না। প্রতিশব্দ ছাড়াই পৃথিবীর তাবৎ মানুষ তাকে চিনতে পারে। মরুভূমি, জলাভূমি, বরফে ঢাকা মেরু অঞ্চল, যেখানেই মানুষ, সেখানেই প্লাস্টিক। এই মুহূর্তে পৃথিবী প্রায় ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ে হাঁসফাঁস করছে। ৬০ থেকে ৭০ বছর আগেও প্লাস্টিকের এমন রমরমা অবস্থা ছিল না। ছয় থেকে সাত দশকের মধ্যে আমাদের প্রতিদিনের প্রয়োজনে প্লাস্টিক এমনভাবে ঢুকে পড়েছে যে তাকে বাদ দিয়ে চলা বা ভাবা দিনকে দিন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। চণ্ডীপাঠ থেকে জুতা সেলাই, কাপড় বুনন, রান্না ব্যবস্থাপনা, প্রকৌশল বা পণ্যের নকশা তৈরি, কোথায় তার সম্পৃক্ত নেই? বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স অ্যাডভান্স (১৯ জুলাই ২০১৭) জানাচ্ছে, পৃথিবী গত কয়েক দশকে ৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিকসামগ্রী উৎপাদন করেছে। এর মধ্যে ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন টন এখন বর্জ্য। এসব বর্জ্যের আবার সিংহভাগ (প্রায় ৭৯ শতাংশ) মাটির মধ্যে বা প্রকৃতির নানা স্তরে বা অঙ্গে জিন্দা থেকে যাচ্ছে। এরা নানাভাবে আমাদের শরীরে ঢুকছে।

প্লাস্টিক মানে যে শুধু প্লাস্টিকের চেয়ার, টেবিল, গ্লাস, ঘটি, বাটি, বদনা, চপ্পল, তা কিন্তু নয়; মাইক্রোবিডস নামে পরিচিত একটি প্লাস্টিকজাত উপাদান এখন অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় প্রসাধনসামগ্রীতে লাগামহীনভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। টুথপেস্ট থেকে শুরু করে ফেশিয়াল, নেইলপলিশ, গ্লিটার, ডিটারজেন্ট পাউডার ইত্যাদিতে মেশানো হচ্ছে যেন সবকিছু ঝকঝকে আর তকতকে দেখায়। ব্যবহারের পর এসব প্রসাধনী আর পরিষ্কারকসামগ্রীতে মেশানো মাইক্রোবিডসগুলো নালা, নর্দমা, নদী, পুকুর হয়ে আমাদের ভূগর্ভস্থ জলে গিয়ে মিশছে। কিন্তু ধ্বংস হচ্ছে না, থেকে যাচ্ছে অবলীলায়। বছর কয়েক আগে একটি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোবিডস দূষণের হাল অবস্থার ওপর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছিল। গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রধান তিনটি শহরে (ঢাকা, চট্টগ্রাম আর সিলেট) যে পরিমাণ ফেসওয়াশ, ডিটারজেন্ট আর টুথপেস্ট ব্যবহার হয়, তার থেকে প্রতিবছর প্রায় ৮ বিলিয়ন মাইক্রোবিডস প্রকৃতিতে গিয়ে পড়ে। বেশির ভাগ চলে যায় নানা নদী, খাল, পুকুর প্রভৃতি জলাধারে। জলাধারে যাওয়ার পর মাইক্রোবিডস জলজ প্রাণীর শরীরে ঢুকে পড়ে এক ভয়ানক দূষণ চক্রের সূচনা করে।

গবেষকেরা পাঁচ ধরনের মাছ সংগ্রহ করে দেখার চেষ্টা করেন, তাদের শরীরে কী পরিমাণ এই বিষাক্ত মাইক্রোবিডসের অস্তিত্ব আছে। সরপুঁটি, ইলিশ, মৃগেল, কাতলা আর রুই মাছের মধ্যে মাইক্রোবিডসের সবচেয়ে বেশি অস্তিত্ব ধরা পড়ে। রুই মাছে ৩৫ শতাংশ, কাতলায় ২৫ শতাংশের বেশি, মৃগেলে প্রায় ২২ শতাংশ, ইলিশে প্রায় ২৪ শতাংশ আর সরপুঁটিতে ২ শতাংশ। মাছের পেট, মুখ, ডিম, এমনকি মাছের ফিলেটেও মাইক্রোপ্লাস্টিক আর মাইক্রোবিডসের অস্তিত্ব মেলে। মাইক্রোবিডস আর মাইক্রোপ্লাস্টিকের সমস্যা নিয়ে সমাজসচেতন উন্নত দেশগুলোও বড় চিন্তায় আছে। নরওয়ের এক গবেষণা বলছে, সাগরঘেরা এই দেশটি বছরে প্রায় আট হাজার টন প্রাথমিক মাইক্রোপ্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করছে। এর প্রায় অর্ধেক চলে যাচ্ছে তার চারপাশের সাগরে। নরওয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের শহরে বার্গের (বার্যেন) শহরতলিতে যদি এক বছরের বর্জ্য ঢেলে দেওয়া হয়, তাহলে শহরের সবার হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যাবে।

টেকসই, সস্তা আর আরামের খোঁজে আমরা যে প্লাস্টিকের ফাঁদে পা দিয়ে সর্বনাশের দিকে ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছি, সেটা একটু ঠান্ডা মাথায় খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। শিশুকে বারবার পরিষ্কার করার ঝামেলা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আর রাতের ঘুমটা ষোলো আনা উপভোগের জন্য শিশুকে যে ন্যাপি পরাচ্ছি, তা আমরা ফেলে দেওয়ার পরেও পৃথিবীতে থেকে যাবে প্রায় ৪৫০ বছর। পাঁচ পুরুষ শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু ন্যাপি বেঁচে থাকবে। ন্যাপির পাহাড়ে কি তাহলে সভ্যতা হারিয়ে যাবে? গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে পরিবেশবাদীরা ব্রিটেনের সাগরসৈকতগুলো স্বেচ্ছাশ্রমে পরিষ্কারের এক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ব্রিটেনের ৩৩৯টি ছোট-বড় সৈকতে সাত হাজার মানুষ স্বেচ্ছায় এ কাজে সাড়া দেয়। তারা এক দিনে (ঘণ্টা তিনেক) প্রায় আড়াই লাখ টুকরা বর্জ্য অপসারণ করে। তার মানে, প্রতি ১০০ মিটারে পাওয়া যায় প্রায় ৭১৮ টুকরা বর্জ্য। বলা বাহুল্য, এসব বর্জ্যের একটা বড় অংশ ছিল প্লাস্টিক বা প্লাস্টিকজাত দ্রব্য। সারা দুনিয়ায় প্লাস্টিক বর্জ্যের মধ্যে প্লাস্টিকের বোতল দিন কে দিন সব বর্জ্যকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতি সেকেন্ডে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ২০ হাজার প্লাস্টিক বোতল। ২০১৬ সালে পৃথিবীতে বিক্রি হয় প্রায় ৪৮০ বিলিয়ন প্লাস্টিক বোতল। এসবই শেষ পর্যন্ত নদী হয়ে সাগরে গিয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ২০৫০ সালের মধ্যে সাগরে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ বেড়ে যাবে।

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে প্লাস্টিক উৎপাদনের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। এক হিসাবে দেখা যায়, এই খাত বছরে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করছে। এর প্রায় সবটুকুই অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য। সামান্য কিছু রপ্তানিও হচ্ছে (০.৮ বিলিয়ন)। বছরে প্রায় ৩ লক্ষ ৩৬ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য চলে আসছে আমাদের প্রকৃতি আর পরিবেশে। ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার এখন প্রায় শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এই শিল্পে অনেক প্রান্তিক মানুষ তাদের জীবিকা খুঁজে পাচ্ছে। ২০১৫ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, (সৈয়দ তাহসিন হক) বর্জ্যের প্রায় ৬৯ শতাংশ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার বা রিসাইকেল্ড হচ্ছে। এই গবেষণা ইঙ্গিত দেয়, ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের নগরগুলোর প্রতিদিনের বর্জ্য হবে প্রায় ৫০ হাজার টন। এই অতিরিক্ত বর্জ্যের চাপ আমরা কীভাবে সামাল দেব?

প্লাস্টিক ব্যবহারে আমাদের সচেতন আর কৃপণ হতে হবে। সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে আমাদের রিসাইকেলিং ক্ষমতা। পুনর্ব্যবহার বা রিসাইকেলিং এই খাতকে নিরাপদ আর আকর্ষণীয় লগ্নি খাতে পরিণত করতে হবে।

গওহর নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণকর্মী এবং শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।