লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতি কি সফল হবে?

হোর্স্ট সিহোফার
হোর্স্ট সিহোফার

যেহেতু লোকরঞ্জনবাদ সুনির্দিষ্ট কারও মতাদর্শ নয়, তাই মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটারদের সমর্থন পেতে এর ব্যবহার করতে দেখা যায়। ভোটারদের মন জয় করার জন্য রাজনীতিবিদেরা সব সময়ই লোকরঞ্জনবাদী স্লোগান ও পদ্ধতি ব্যবহারে আগ্রহী থাকেন, এমনকি তা যদি তাঁদের দলকে ভেঙেও দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান, যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ ও লেবার এবং ফ্রান্সের লে রিপাবলিকেইনসরাতা-ই প্রমাণ করেছে।
এখন এই অশুভ প্রবণতা জার্মানির ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন বা ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়নের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। গত বছরের পার্লামেন্ট নির্বাচনে সিডিইউ বা সিএসইউর দুর্বলতা প্রকাশ পায়, যখন ডানপন্থী দল অল্টারনেটিভ ফার ডয়েচল্যান্ড (এএফডি) অনেক আসনে জয়লাভ করে। এই ঘটনা সিডিইউ বা সিএসইউর মধ্যে নতুন করে বিভেদের সৃষ্টি করেছে।

পূর্ব জার্মানির অন্য সাবেক কমিউনিস্ট রাজ্যগুলোর চেয়ে এএফডি সবচেয়ে ভালো করেছে সিএসইউর শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ব্যভারিয়া রাজ্যে। আগামী অক্টোবর মাসে এ রাজ্যে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখন এএফডি হচ্ছে সিএসইউর সবচেয়ে বড় উদ্বেগ।

সিএসইউর দীর্ঘদিনের নেতা হোর্স্ট সিহোফার ইতিমধ্যে দলের জন্য নতুন লোকরঞ্জনবাদী কর্মসূচি ঠিক করেছেন। তিনি সম্প্রতি ব্যভারিয়া রাজ্যের মন্ত্রী-প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে গিয়ে তা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী উচ্চাভিলাষী ও অপেক্ষাকৃত কম বয়সী লোকরঞ্জনবাদী নেতা মার্কাস সোডারের কাছে হস্তান্তর করেন। তিনি সম্প্রতি আঙ্গেলা ম্যার্কেলের জোট সরকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়ে তাঁর নিজের লোকরঞ্জনবাদী ভাবমূর্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা উজ্জ্বল করার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে রয়েছে হেইমাত (তাঁর মন্ত্রণালয়ের নাম) শব্দটির পুনরুদ্ধার করা, যার অর্থ মাতৃভূমি।

কিন্তু অন্যান্য জার্মান রক্ষণশীলের তুলনায় সিহোফার সব সময় আলাদা চিন্তাভাবনা নিয়ে আবির্ভূত হন। প্রকৃতপক্ষে এত দিন তিনি হাঙ্গেরির কর্তৃত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের রাজনৈতিক গডফাদার হিসেবে কাজ করেছেন। এখন তিনি সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে মনোযোগী হয়েছেন।

জার্মানির নতুন সরকার যেদিন শপথ গ্রহণ করল, সেদিন থেকেই বোঝা গেছে যে সম্ভাব্য সমালোচকদের দমন করা বা শান্ত রাখার জন্য আঙ্গেলা ম্যার্কেলের কৌশল দীর্ঘদিন কাজ করবে না। আর সিহোফার তাৎক্ষণিকভাবে শাসক জোটের মধ্যে একটি ঠান্ডা লড়াই চালু করে দেন।

গত মার্চ মাসে ট্যাবলয়েড পত্রিকা বিল্ডকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সিহোফার লোকরঞ্জনবাদী কেতায় বলেন, ‘ইসলাম জার্মানির জন্য নয়।’ এ ধরনের বিবৃতি দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং তিনি যে অভিবাসনবিরোধী ভোটারদের পক্ষে রয়েছেন তা তুলে ধরা, যেসব ভোটার গত বছর এএফডিকে ভোট দিয়েছিলেন।

এখন সিহোফার আক্রমণাত্মক ভূমিকায় আছেন। তিনি যেকোনো বিষয়ে মন্তব্য করছেন এবং ম্যার্কেলকে সরাসরি আক্রমণ না করে তাঁর উদ্দেশে অবমাননাকর বক্তব্য রাখছেন।

কিন্তু আবারও সিহোফারের ‘পূর্ব ইউরোপীয়’ আচরণ একেবারে চমক হিসেবে দেখা দেয়নি। গত বছরের মার্চ মাসে ম্যার্কেল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর প্রথম বৈঠক করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন সিহোফার মস্কোয় যান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরি করার জন্য। এরপর থেকে রাশিয়ার ওপর যেকোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিরোধিতা করে আসছেন তিনি।

সিহোফার পোল্যান্ডের লোকরঞ্জনবাদী ল অ্যান্ড জাস্টিস সরকারের সঙ্গেও আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলছেন। পোল্যান্ডের সম্মান ও মর্যাদার প্রতি অবমাননাকর মনোভাব প্রদর্শনের জন্য তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমালোচনা করছেন। চলতি মাসের গোড়ার দিকে নির্বাচনে জয়লাভ করায় তিনি অরবানকে অভিনন্দন জানান এবং তাঁর সিএসইউ দলের নেতা আলেক্সান্ডার ডবরিনডিট খোলাখুলিভাবে অরবানকে ‘আমাদের বন্ধু’ বলে উল্লেখ করেন।

সিহোফারের নেতৃত্বে সিএসইউ তার দৃষ্টি অর্থনীতি থেকে সাংস্কৃতিক বিতর্কের দিকে নিবদ্ধ করে। এটা ইউরোপের লোকরঞ্জনবাদী প্রবণতা। এই প্রবণতা শুধু হাঙ্গেরি বা পোল্যান্ডে নয়, চেক প্রজাতন্ত্র, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস ও ইতালিতেও দেখা গেছে; যেখানে ফাইভ স্টার মুভমেন্ট ও ডানপন্থী লিগ পরবর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করছে।

ম্যার্কেল এবং জার্মান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সিহোফারের এই জোর লড়াইয়ের একটি ফল হলো যে সরকারের আরেকটি দল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটস দৃশ্যপট থেকে প্রায় মুছে গেছে। তবে তিনি অনুধাবন করুন আর না-ই করুন, সরকার বড় ধরনের কোনো ভুল করলে তার সুবিধাভোগী হবে এএফডি। দলটি এখন বুন্দেসটাগের সবচেয়ে বড় বিরোধী দল।

তবে এখন যদি সিহোফারের লোকরঞ্জনবাদী চাল ব্যর্থও হয়, তাতেও সমস্যা নেই। কেননা, তিনি ইতিমধ্যে সরকারকে ডানপন্থার দিকে টেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করেছেন। জার্মানি সুস্পষ্টভাবেই পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি এবং পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাপ সহজ করার জন্য ভূমিকা পালন করছে, যেসব দেশ কিনা আইনের শাসনকে এবং ইউরোপীয় সংহতিকে অবজ্ঞা করছে।

এ ছাড়া জার্মানি সম্ভবত ইউরোজোনের যেকোনো ধরনের সংস্কারকে থামিয়ে দেবে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ইতিমধ্যে সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন।

সিহোফার হচ্ছেন জার্মানির জন্য একটি দুঃসংবাদ, যে দেশটির কিনা এখন অন্য যেকোনো ইউরোপীয় রাষ্ট্রের চেয়ে গতিশীলতা, উন্মুক্ততা এবং সাহসিকতা বেশি প্রয়োজন। জার্মানির সীমিত সামরিক সামর্থ্য, অতি নিয়ন্ত্রিত পরিষেবা খাত এবং অবকাঠামোয় বিনিয়োগের অভাব—এই সবকিছু এই ইঙ্গিত দেয় যে দেশটি উন্নয়নের কিছু কিছু এককে পূর্ব ইউরোপের চেয়ে এক দশক পিছিয়ে আছে, যদিও জার্মানি ইউরোপের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি।

পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে যেকোনো বাজারে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পণ্যের মূল্য পরিশোধ করা যায়, যা কিনা জার্মানির দামি রেস্তোরাঁগুলোতে সম্ভব হয়ে ওঠে না। একইভাবে সারা বিশ্বে ইন্টারনেট গতির ক্ষেত্রে জার্মানির অবস্থান ৪২তম এবং এর ব্রডব্যান্ড অবকাঠামোর অবস্থাও বেশ নাজুক। এসব ক্ষেত্রে জার্মানির পিছিয়ে থাকাটা বিস্ময়কর।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত

স্লাওমির সিয়েরাকোওস্কি ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডি ইন ওয়ারসের পরিচালক