সড়কে বিপজ্জনক বিশৃঙ্খলা

প্রকট যানজটের ফলে রাজধানীর ভেতরের রাস্তাঘাটে মোটরযানের গড় গতি কমতে কমতে ঘণ্টায় প্রায় ছয় কিলোমিটারে নেমেছে। কেউ কেউ এখন রসিকতা করে বলে: ঢাকায় গাড়ি হাঁটে, মানুষ দৌড়ায়। কিন্তু বিস্ময়ের কথা, এই মন্থর যানবাহনের মহানগরীতেই প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারাচ্ছে। অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটতে হলে উচ্চগতিতে যানবাহন চলতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। মন্থরগতির যানবাহনও মুহূর্তের মধ্যে অনেক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। আমাদের প্রিয় রাজধানী ঢাকার বাস্তবতা তা-ই বলছে। কিছুদিন আগে তরুণ রাজীব হোসেনের একটা হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এবং সেই ধকলে শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুর ঘটনা তার একটা করুণ দৃষ্টান্ত।

কিন্তু কেন এই মহানগরীর রাস্তাঘাটগুলো একেকটা মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে? কারণ, এখানে যানবাহন চলাচলে ভয়ংকর নৈরাজ্য চলছে। চালকদের সড়কের লেন অনুসরণ করার বালাই তো নেই-ই, উপরন্তু তাঁরা আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে মহাবিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। প্রতিটি বাস-মিনিবাসের শরীরে সেই প্রতিযোগিতার ক্ষতচিহ্ন দেখা যায়। রাজীব হোসেনের একটি হাত বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনা দুটি বাসের চালকদের মধ্যে এ রকম প্রতিযোগিতারই ফল। আর ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করা, যেখানে-সেখানে বাস-মিনিবাস থামিয়ে যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা চলছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। যাত্রীকল্যাণ সমিতির এক সমীক্ষা অনুযায়ী রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস চরম বিশৃঙ্খলভাবে চলাচল করে।

এমনিতে রাজধানীতে রাস্তাঘাটের সংখ্যা ও পরিসরের তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা মাত্রাতিরিক্তভাবে বেশি। এ শহরে চলাচলকারী শুধু বাস-মিনিবাসের সংখ্যাই প্রায় আট হাজার। ব্যক্তিগত গাড়ি, ট্যাক্সি ক্যাব, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, টেম্পো, হিউম্যান হলারজাতীয় ছোট যানবাহন, মোটরসাইকেল, রিকশা ইত্যাদি হরেক রকম ও আকারের যানবাহনের সংখ্যা মোট রাস্তাঘাটের ধারণক্ষমতার তুলনায় অনেক বেশি। তা ছাড়া যান্ত্রিক ত্রুটিযুক্ত, পুরোনো ও চলাচলের অনুপযুক্ত ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যাও প্রচুর। এ রকম পরিস্থিতিতে যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা প্রয়োজন, প্রয়োজন সামগ্রিক সুব্যবস্থাপনা। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো কর্তৃপক্ষের তেমন তাগিদ বা আগ্রহ লক্ষ করা যায় না।

নৈরাজ্যের পেছনে একটা বড় কারণ হলো চাঁদাবাজি। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকাগুলোর রাস্তাঘাটে যেসব বাস-মিনিবাস চলাচল করে, সেগুলোর প্রতিটিকে প্রতিদিন ৭০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদার বাড়তি অর্থ সংগ্রহ করতে এসব যানবাহনের মধ্যে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের প্রতিযোগিতা চলে। এই চাঁদাবাজি একটা স্থায়ী ও নিয়মিত ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। এই ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় মন্ত্রী, সাংসদ, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের দ্বারা। অনেক বাস-মিনিবাসের মালিক রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী লোকজন। তাঁদের ফিটনেসবিহীন বাস-মিনিবাস চলাচল পুলিশ থামাতে পারে না, তাঁদের মালিকানাধীন বাস-মিনিবাসের চালকেরা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালান, ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে বচসা করেন এবং সরকারের বেঁধে দেওয়া ভাড়ার তুলনায় দু-তিন গুণ বেশি ভাড়া আদায় করা হয়।

খোদ রাজধানীর রাস্তাঘাটে এমন নৈরাজ্য বছরের পর বছর ধরে চলতে দেওয়া যায় না। এই নৈরাজ্যের কুফল শুধু দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি-অঙ্গহানিই নয়, অর্থনীতির বিরাট ক্ষতিও বটে। কারণ, যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলার ফলে যানজটও সৃষ্টি হয় এবং তার ফলে প্রচুর কর্মঘণ্টার অপচয় হয়। তাই রাজধানীর রাস্তাঘাটে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি। এর জন্য প্রথমেই প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিক পদক্ষেপ।