নওয়াজের পতনে আলোচনার পথ বন্ধ

নওয়াজ শরিফ । ফাইল ছবি
নওয়াজ শরিফ । ফাইল ছবি

পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে যেকোনো সরকারি দপ্তরের দায়িত্ব গ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করে যে রায় দিয়েছেন, সেটিকে খুবই রূঢ় এবং বিতর্কিত সাজা হিসেবে দেখা হচ্ছে। আদালত শুধু তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন; কিন্তু তাঁকে সাজা দেওয়া হবে কি হবে না তা দেশটির পার্লামেন্টের দেখার বিষয়। আর এ কারণেই দেশটির পার্লামেন্ট সদস্যরা, বিশেষ করে নওয়াজের দল মুসলিম লিগের পার্লামেন্ট সদস্যরা বিক্ষোভ করছেন।

পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি তদন্তের পর গত জুলাইয়ে নওয়াজকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে চলা তদন্তে নওয়াজ তাঁর ছেলে হুসেইন নওয়াজের দুবাইয়ের একটি কোম্পানি থেকে সরকারকে না জানিয়ে অর্থ নিয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে নওয়াজ তাঁর ছেলের কোম্পানি থেকে পয়সাকড়ি নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন এবং আদালতের আদেশকে তাঁকে গদিচ্যুত করার ‘চক্রান্ত’ হিসেবে দাবি করেছেন।

গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্ট তাঁর রায়ে বলেছেন, পাকিস্তানের সংবিধান মোতাবেক কোনো ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক অযোগ্য ঘোষিত হলে তিনি আর কোনো সরকারি পদে আসতে পারবেন না। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি মিয়া সাকিব নিসারের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চের লেখা ৬০ পৃষ্ঠার রায় বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল পড়ে শোনান। নির্বাচন থেকে নওয়াজকে অস্থায়ী নাকি স্থায়ীভাবে দূরে থাকতে হবে, তা সম্পর্কে এ রায়ে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।

রায় ঘোষণার আগে পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি মিয়া সাকিব নিসার বলেন, সৎ ও চরিত্রবান নেতা জনগণের ন্যায্য পাওনা। অনুচ্ছেদ ৬২(১) (এফ) অনুযায়ী, সরকারি দায়িত্ব পালনে নওয়াজকে বিরত রাখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটি স্থায়ী সাজা’। অর্থাৎ আজীবনের জন্য নওয়াজ নির্বাচনে
দাঁড়াতে পারবেন না বা পার্লামেন্ট সদস্য হতে পারবেন না। অনুচ্ছেদ ৬২(১) (এফ) অনুযায়ী, পার্লামেন্ট সদস্য হওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে প্রত্যেককেই স্বচ্ছ ও সৎ হতে হবে।

গত জুলাইয়ে সুপ্রিম কোর্ট অসৎ ঘোষণার পর নওয়াজ পদত্যাগ করেন; আর এই রায়ের পর তাঁর ফের ক্ষমতায় আসার সব আশা শেষ হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাসীন পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) এই রায় প্রত্যাখ্যান করেছে। দলটি বলছে, রাজনৈতিকভাবে নওয়াজকে অকেজো করে দেওয়ার উদ্দেশেই এই রায় দেওয়া হয়েছে। রায়ের পরপরই এটিকে চূড়ান্ত রকমের বিতর্কিত হিসেবে আখ্যা দিয়ে তথ্যমন্ত্রী মরিয়ম আওরঙ্গজেব বলেছেন, কোনো রাজনীতিক নির্বাচন করার যোগ্য নাকি অযোগ্য তা ঘোষণা করা আদালতের কাজ নয়। এটি পার্লামেন্ট এবং নির্বাচন কমিশনের কাজ।

আর মাত্র মাস কয়েক বাদেই পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। ঠিক এমন একটি সময়ে এই রায় ক্ষমতাসীন দলকে ধাক্কা দিয়েছে। এখনো নওয়াজ শরিফ এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। তিনি বলেছেন, তিনি রাজনীতি করবেন কি করবেন না সেই রায় নিতে তিনি জনগণের আদালতে যাবেন।

সম্প্রতি ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে নির্বাহী বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপেরসমালোচনা জোরদার হয়েছে। এসব দেশের অনেক প্রধানমন্ত্রী আদালতের এ ধরনের অনেক রায় মেনে নেননি। ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় থাকাকালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তাঁকে অযোগ্য
ঘোষণা করেছিলেন।

যে আইনের বলে আদালত ইন্দিরাকে অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন, ইন্দিরা ক্ষমতা ছাড়ার বদলে জরুরি অবস্থা জারি করে সেই আইনটিকেই বদলে ফেলেছিলেন। এটা তিনি করতে পেরেছিলেন এ কারণে যে, তখন শ্রীনগরের শামীম আহমেদ শামীম ছাড়া বিরোধী সব পার্লামেন্ট সদস্যই আটক ছিলেন। শামীম একাই পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ইন্দিরার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। শামীমের প্রতি জওহরলাল নেহরুর বন্ধু শেখ আবদুল্লাহর সমর্থন ছিল বলে ইন্দিরা শামীমকে কিছু বলেননি।

আদালত যে রায়ই দিন না কেন, নওয়াজ শরিফ এখনো জনগণের শক্তির ওপরই নির্ভর করে আছেন। ভারতের কাছে শত্রুদেশ পাকিস্তানে তিনিই সবচেয়ে পছন্দসই বিকল্প নেতা। নয়াদিল্লি পাকিস্তানকে বলে দিয়েছে, ইসলামাবাদ সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেওয়া বন্ধ না করা পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে কোনো আলোচনা হবে না। পাকিস্তানে ভারত সার্জিক্যাল স্ট্রাইকও করে ফেলেছে। তারপরও দুই দেশের মধ্যে আলোচনা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই। আজ হোক কাল হোক, নিজেদের ভিন্নতা নিয়ে আলোচনা করতে এই দুই দেশকে টেবিলে বসতেই হবে।

ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করা সঠিক পথেই এগোচ্ছিল। কিন্তু নওয়াজকে পাকিস্তানের রাজনীতি থেকে উৎখাত করা পুরো পরিস্থিতিকে হতাশার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এখন পাকিস্তান আবার কবে নাগাদ এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসবে, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া ভারতের সামনে আর কোনো বিকল্প রাস্তা নেই। পাকিস্তানে বর্তমানে যে অবস্থা চলছে, সে অবস্থায় আলোচনার দিকে যাওয়া আর অন্ধকারে ঢিল ছোড়া হবে একই ব্যাপার।

ইংরেজি থেকে অনূদিত

কুলদীপ নায়ার ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক