কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা প্রয়োজন

দেশে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রধান বাণিজ্যিক জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাসের জানা মজুত দ্রুত সংকুচিত হওয়ার কারণে আমদানি করা তেল, তরল গ্যাস (এলএনজি) ও কয়লা দিয়ে জ্বালানির চাহিদা মেটানোর চেষ্টা চলছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ নির্মিত হচ্ছে উপকূল এলাকায়, প্রধানত জ্বালানি পরিবহনে সমুদ্র ও নদীপথ ব্যবহারের সুবিধা কাজে লাগানোর বিবেচনা থেকে। প্রথম আলোর সাম্প্রতিক কিছু প্রতিবেদন থেকে কক্সবাজারের নিকটবর্তী মহেশখালী, পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর এবং বাগেরহাটের মোংলা বন্দরসংলগ্ন অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি, কয়লা ও এলপিজি আমদানি অবকাঠামো নির্মাণের খবর জানা গেছে। মহেশখালী দ্বীপ ও পটুয়াখালীর কলাপাড়াকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র বা ‘এনার্জি হাব’ হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

দেশের শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জ্বালানি ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ ও প্রাথমিক জ্বালানির সরবরাহ অবকাঠামো গড়ে তোলার সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ এগিয়ে নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জমির স্বল্পতা ও পরিবহন অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় শিল্পকারখানা গড়ার ক্ষেত্রে ভূমির পরিকল্পিত ব্যবহার অপরিহার্য। গুচ্ছাকারে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা এবং তার পরিচালনা অবশ্যই ভূমি ব্যবস্থাপনার ভালো নজির। প্রাথমিক জ্বালানির আমদানি, সরবরাহ ও উৎপাদিত বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য গুচ্ছাকারে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনার সুবিধা বেশি। প্রকল্প পরিচালনার সঙ্গে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর স্পষ্ট হওয়া প্রভাব পরিবীক্ষণ ও তার প্রশমন ব্যবস্থাপনা কার্যকর করতেও গুচ্ছাকারে শিল্প-বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা সুবিধাজনক।

কিন্তু বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের নদ-নদীগুলোর মধ্য দিয়ে অসংখ্য কয়লা, তেল ও এলএনজিবাহী নৌযানের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করে সন্নিহিত এলাকার জীব ও জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশের ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে সীমিত রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, পটুয়াখালীর কলাপাড়া-কুয়াকাটা বাংলাদেশের ইলিশ মাছের প্রধান বিচরণকেন্দ্র। সমুদ্রের মাছ ইলিশ এই অঞ্চলের নদ-নদীতে খাবারের জোগান ও অনুকূল পরিবেশ পায় বলে জাটকা থেকে ইলিশ হওয়ার সময়কালে ব্যাপকভাবে বিচরণ করে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় কলাপাড়ায় ‘এনার্জি হাব’ গড়ে উঠলে তার বৈরী প্রভাব দূষণ সংবেদনশীল ইলিশসহ জলজ প্রাণীর ওপর ব্যাপকভাবে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

একই কথা প্রযোজ্য সুন্দরবন এলাকার ডলফিনের অভয়ারণ্য বহাল রেখে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যান্য শিল্পকারখানা পরিচালনার ক্ষেত্রেও। সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৯০টি শিল্পকারখানা স্থাপন উদ্যোগের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। পরিবেশগত সংবেদনশীলতার বিবেচনায় বিভিন্ন শ্রেণিভুক্ত এসব শিল্পকারখানার প্রভাব সুন্দরবনের পরিবেশে ও জীববৈচিত্র্যের জীবনাচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। গত বছরের জুলাই মাসে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে সুন্দরবন ও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নিকটবর্তী বিভিন্ন শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অবকাঠামো উন্নয়নের প্রভাব নিরূপণে একটি কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা (এসইএ) পরিচালনার কথা বলা হয়েছিল। এই সমীক্ষা সম্পন্ন করার আগে সুন্দরবনসংলগ্ন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্প ও অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ঝুঁকির কারণ হতে পারে। দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্রমেই বেড়ে চলা চাহিদা পূরণে সরকারের তৎপর হওয়ার বিকল্প নেই। বিদ্যুৎ-জ্বালানি এবং অন্যান্য শিল্প উদ্যোক্তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে পৃথক পরিবেশগত ছাড়পত্র সংগ্রহের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এককভাবে প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ এবং তার বৈরী প্রভাব নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা প্রণয়নও হয়তো করা হচ্ছে। কিন্তু গুচ্ছ প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে নীতিনির্ধারকদের সন্নিহিত এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ সম্পর্কে সঠিক তথ্য এবং প্রকল্পসমূহের পরিবেশগত প্রভাব ও তার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে ‘কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা’ বা ‘এসইএ’ সহায়ক হয়। ‘এসইএ’ বৃহত্তর ভৌগোলিক এলাকার টেকসই ও সমন্বিত পরিকল্পনার অধীনে উন্নয়নের কৌশল নির্ধারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নির্মাতাদের সহায়তা করে।

তা ছাড়া, সরকারের গৃহীত নীতি ও রূপকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে অংশীজন, প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়নে যাঁদের লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা ও সুযোগ রয়েছে, এসইএ তাঁদের মতামত সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ তৈরি করে। এর ফলে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সাধারণভাবে যে অস্বচ্ছতা, অনিয়মের অভিযোগ আসে, তার অনেকটুকুই প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে আলোচনার সুযোগ থাকায় সংকুচিত হয়। এসইএ সমীক্ষা প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন পরিকল্পনার আগে সম্পন্ন করা হয়, তাই এলাকার সামগ্রিক উন্নয়ন কৌশল ও তার অগ্রাধিকার নিরূপণ সহজ হয়। প্রকল্পের জন্য যখন পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ সমীক্ষা (ইআইএ) পরিচালনা করা হয়, তখন আঞ্চলিক পর্যায়ে জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ুর পরিবর্তনসংক্রান্ত বিষয়সমূহ বিবেচনায় নেওয়া দুরূহ। এসইএ এ ক্ষেত্রে কার্যকর অবলম্বন হতে পারে। তবে এসইএ সমীক্ষা ও তার সুপারিশ বিবেচনায় নেওয়ার ক্ষেত্রে সমীক্ষার পরিধি নির্ধারণ, কার্যকর গণসম্পৃক্তি নিশ্চিত করার পদ্ধতি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আইনি এখতিয়ার এর বিস্তৃতি নিয়ে বিরোধ উপস্থিত হতে পারে। বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানসমূহ কৌশলগত প্রভাব নিরূপণের জন্য বাধা দিতে পারে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষ তাদের অভ্যস্ত পদ্ধতিতে সমীক্ষা ও প্রকল্প বাস্তবায়নের যে কৌশল নিতে আগ্রহী, এসইএ তাদের জন্য পছন্দের না-ও হতে পারে। সর্বোপরি আমলাতন্ত্র খণ্ডিতভাবে বিষয় দেখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করায় সমন্বিত বৃহত্তর পটভূমিতে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও উন্নয়ন কৌশলকে বাধাগ্রস্ত করতে আগ্রহী হতে পারে।

নীতিনির্ধারক পর্যায়ে সম্ভাব্য প্রকল্প বাস্তবায়নের আর্থিক, রাজনৈতিক ও পরিবেশগত বাধাগুলো সম্পর্কে অবহিত থাকা গুরুত্বপূর্ণ। সামগ্রিক আঞ্চলিক উন্নয়ন কৌশল প্রণয়নের তাগিদ এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়নের ইচ্ছাশক্তি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা বিদ্যমান বাধাগুলো অতিক্রম করার শক্তি ও সাহস জোগাতে পারে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের প্রতি সংবেদনশীল থেকে প্রকল্প উন্নয়ন করা গেলে চূড়ান্ত বিচারে উন্নয়নকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থবহ এবং টেকসই করা সম্ভব। সেই পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকায় ব্যাপক ও বহুমুখী উন্নয়ন উদ্যোগ বাস্তবায়নের আগে এসইএ সমীক্ষা নীতিনির্ধারকদের জন্য নির্ভরযোগ্য অবলম্বন হতে পারে।

ড. মুশফিকুর রহমান খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক