ড্রাকোনীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

আইনের শাসন ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উপযুক্ত আইন আবশ্যক। রাষ্ট্র তার প্রয়োজনে অনেক আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করে। বিশেষ করে অপরাধ দমনের লক্ষ্যে শাস্তিদানের বিধিসংবলিত আইনকে ইংরেজিতে বলে পেনাল কোড। আইন প্রণয়ন একটি দার্শনিক বিষয়। বিশেষ করে নৈতিক দর্শন বা মোরাল ফিলসফি এর সঙ্গে জড়িত। কেন আইনটির প্রয়োজন, আগে আইনটির দরকার হয়নি কেন, আইনটি না করলে সমস্যা কোথায়, আইনটি দেশের সব মানুষের উপকার করবে কি না, আইনটি দ্বারা নির্দোষ কারও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে কি না, অপরাধের তুলনায় আইনটিতে শাস্তির মাত্রা বেশি কঠোর কি না-এসব বিষয় বিবেচনা না করে আইন প্রণয়ন করলে আইনটি নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দেয় এবং তা থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দেয় উদ্বেগ। আইন একটি দার্শনিক বিষয় বলেই প্লেটো, অ্যারিস্টটল থেকে ইবনে খালদুন এবং কান্ট, হেগেল পর্যন্ত দার্শনিকেরা আইনের দার্শনিক দিকগুলো পর্যালোচনা করেছেন।

অতি কঠোর ও অমানবিক আইন রচনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন প্রাচীন গ্রিসের ড্রাকো, যিশুখ্রিষ্টের জন্মের সোয়া ছয় শ বছর আগে। তাই আজও অতি কঠোর ও নিকৃষ্ট আইনকে আখ্যায়িত করা হয় ড্রাকোনিয়ান ল বা ড্রাকোনীয় আইন বলে। ড্রাকোর প্রণীত আইন অভিজাত শাসকগোষ্ঠীর জন্য কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেনি। সে আইনে জীবন বিপন্ন হয় অ্যাথেন্সের সাধারণ নাগরিকদের। ড্রাকোর আইন ছিল শাসকের দ্বারা রচিত এবং শাসকের স্বার্থ রক্ষায়; তা নাগরিকদের প্রতিনিধিদের দ্বারা রচিত ছিল না। তাতে জনগণের অনুমোদন ছিল না। নাগরিকদের প্রতিনিধিদের দ্বারা যা তৈরি, তাকে মানুষ সম্মান করতে বাধ্য। অবিবেচনাপ্রসূত অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ভীতি থাকা স্বাভাবিক।

এ বছরের ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রিসভা ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮’ -এর খসড়া অনুমোদন করে। ৯ এপ্রিল সেটি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি মানুষের হাতের মধ্যে। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ বা সাইবার ক্রাইম উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। অপরাধপ্রবণ ও অশুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আমাদের সমাজে বিরল নয়। সে জন্য একটি আইন থাকা দরকার বলে সরকার মনে করায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া রচনা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে একটি আইন ২০০৬ সালে করা হয়েছিল। ২০১৩ সালে সেটিতে শাস্তির মাত্রা বাড়ানো হয়। এবারেরটি আরও কঠোর। বিশেষ করে সেটির ৫৭ ধারার সমালোচনা করেন গণমাধ্যমসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। ৫৭ ধারায় ছিল মানহানি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চক্রান্ত প্রভৃতি অবাধে কঠোর শাস্তির বিধান। জনমতের চাপে সরকার ৫৭ ধারা বাতিল করে। কিন্তু বর্তমান সংশোধিত বিলটিতে ৩২ ধারায় যা আছে, তা স্বাধীন মতপ্রকাশ ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য বিষাক্ত কাঁটাবিশেষ।

অনুমোদিত খসড়ার ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ-প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকের কাজই বিভিন্ন উপায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা, জাতীয় স্বার্থে ও জনস্বার্থে সত্য খুঁজে বের করে পাঠককে জানানো। গুপ্তচর শব্দটি খুবই অবমাননাকর। গুপ্তচর হলো সেই ব্যক্তি, যে কারও দ্বারা নিযুক্ত হয়ে শত্রুর গোপন কথা জানার চেষ্টা করে। সাংবাদিক তা করেন না। তিনি কোনো ব্যক্তির এজেন্ট নন। গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ করাতে তাঁর নিজের বা তাঁর প্রতিষ্ঠানের কোনো স্বার্থ নেই। গণতন্ত্রে তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার।

প্রস্তাবিত আইনের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রচারণা চালালে বা তাতে মদদ দিলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ। সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।

অপরাধের যে ফিরিস্তি দেওয়া হয়েছে, তার কোনো সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। আমি কয়েকজন মাননীয়কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, অনুভূতিতে আঘাত মাপার মানদণ্ড কী? তাঁরা সদুত্তর দিতে পারেননি। এই সব ধারার কারণে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দেশের মাটিতে বসে কেউ বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার আগ্রহ দেখাবেন না। কোনো ব্যক্তিই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। মহাত্মা গান্ধীর যৌনজীবন নিয়েও বই লেখা হচ্ছে। কোনো মানুষ তাঁর মহৎ কর্মটির জন্যই চিরস্মরণীয় ও শ্রদ্ধেয়। তাঁর কোনো দুর্বল দিক আলোচনা করলে তার মহত্ত্ব ক্ষুণ্ন হয় না। বরং বাধা দিলে নেতিবাচক দিক বেশি আলোচিত হয়।

দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ একসঙ্গে ১ কোটি টাকা চোখে দেখেনি। কোনো একটা মতামত প্রকাশের জন্য কাউকে ১ কোটি টাকা জরিমানা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ব্যাংকের শত শত কোটি টাকা লোপাট করে যাঁরা বুক ফুলিয়ে সভা-সেমিনার করে বেড়ান, রাষ্ট্র তাঁদের জেলে ঢোকাতে পারে না। আর কোনো মন্তব্যের জন্য এমন সর্বোচ্চ শাস্তি!

এই আইন বলবৎ হলে সংবাদপত্রের সম্পাদক, প্রকাশক ও প্রতিবেদকের মাথার ওপরে খাঁড়া ঝুলে থাকবে। সেই উদ্বেগ থেকেই গত বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্ট তিন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদের নেতারা। পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বৈঠকে বলেন, তাঁদের উদ্বেগ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১,২৫, ২৮,৩১, ৩২ ও ৪৩ ধারা নিয়ে। এই ধারাগুলো বাক্স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতার পরিপন্থী। তাঁদের বক্তব্য শুনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আপত্তিগুলো ‘অনেকাংশে যৌক্তিক’।

জনগণের প্রতিনিধিদের যাঁরা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁরাই ১৯৭২-এ সংবিধান দিয়ে গেছেন। সংবিধান হলো রাষ্ট্রের মৌলিক ও সর্বোচ্চ আইন। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় আইনের শাসনের অঙ্গীকার করা হয়েছে। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি হচ্ছে সংবিধান। সেই সংবিধানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া আছে। এর অর্থ হলো এই যে জনগণের জন্য কল্যাণকর আইন রচিত হবে এবং সেই আইনের সুফল সবাই ভোগ করবে।

ড্রাকোনীয় জাতীয় কোনো আইন প্রণয়নের অধিকার আমাদের পার্লামেন্টের সদস্যদের দেওয়া হয়নি। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন রচনার অধিকার কোনো সরকারের নেই। আমাদের সংবিধান গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছে। তার অর্থ হলো এমন কোনো আইন রাষ্ট্র করতে পারে না, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কোনো আইন যদি সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে, সেই আতঙ্ক যদি অমূলকও হয়, তা ভালো আইন নয়।

কোনো কল্যাণ রাষ্ট্রে অপরাধ দমনের জন্য শাস্তিমূলক আইন হওয়া উচিত কম কঠোর, কিন্তু তার প্রয়োগ হওয়া উচিত অত্যন্ত সুষ্ঠু ও অতি কঠোর। যে আইন প্রয়োগে অপব্যবহারের সুযোগ থাকে, তা ভালো আইন নয়। সদিচ্ছা থেকে আইনটি করা হলেও হিতে বিপরীত হতে পারে।

অপরাধ দমন আইনের অপপ্রয়োগ আরেক অপরাধ। সেই অপরাধ ব্যক্তির দিক থেকে নয়, রাষ্ট্রের দিক থেকে। সুতরাং কোনো আইন করার আগে দশবার চিন্তা করে, বিচার-বিশ্লেষণ করে করাই সরকারের কর্তব্য।

অতীতে দেখা গেছে, ড্রাকোনীয় আইন যাঁরাই করেছেন, একসময় সেই আইনের শিকার হয়েছেন তাঁরাই অথবা তাঁদের দলের লোকেরা। সুতরাং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তাড়াহুড়া করে পাস করানোর আগে সরকার সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে পুনর্বিবেচনা করবে, সেটাই প্রত্যাশিত।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক